দলবদলের পর: কেমন হলো আর্সেনাল?

নতুন মৌসুমে নতুন রূপে দেখা যাবে আর্সেনালকে। ছবি: এএফপি
নতুন মৌসুমে নতুন রূপে দেখা যাবে আর্সেনালকে। ছবি: এএফপি
>

গত পরশু শেষ হয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর দলবদল। নিজেদের শক্তিমত্তা বিবেচনা করে প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো এর মধ্যেই প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় এনেছে, অপ্রয়োজনীয় খেলোয়াড় ছেড়ে দিয়েছে। আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো আর দলে খেলোয়াড় আনতে পারবে না। দলবদল শেষে দলগুলোর অবস্থা কেমন হলো? এই পর্বে আমরা দেখে নেব আর্সেনাল সম্পর্কে।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর মধ্যে এবার দলবদলের জানালায় উত্তর লন্ডনের ক্লাবগুলোই বাজিমাত করেছে। উত্তর লন্ডনের আর্সেনাল এবার বেশ কিছু খেলোয়াড় নিয়ে এসেছে, যারা আর্সেনালে খেলবে বলে এই দলবদলের শুরুতে যদি কেউ বলত, হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সেটা হয়নি। দলবদলের শুরুতে জানা গিয়েছিল, এবার আর্সেনালের বাজেট মাত্র ৪৫ মিলিয়ন। কিন্তু এই ৪৫ মিলিয়নের সর্বোচ্চ ব্যবহার কীভাবে-কোন উপায়ে করা যায়, সেটা আর্সেনাল দেখিয়ে দিয়েছে। ফলে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পরে হলেও, কোচ উনাই এমেরি দলটাকে মোটামুটি নিজের দর্শন অনুযায়ী সাজাতে পেরেছেন।

এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন আর্সেনালের নতুন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এডু গাসপার ও হেড অব ফুটবল রাউল সানিয়েহি। এর আগে ব্রাজিলের ক্লাব করিন্থিয়ানসের স্পোর্টিং ডিরেক্টর ছিলেন এডু, ছিলেন ব্রাজিল জাতীয় দলের মূল সমন্বয়ক। তাঁর সময়েই করিন্থিয়ানস কোপা লিবার্তোদোরেস কাপ জেতে, ব্রাজিলের সর্বশেষ কোপা আমেরিকা জয়ের সময়ও দলের সঙ্গে ছিলেন। অনেকের মতেই বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পোর্টিং ডিরেক্টর খেলোয়াড়ি জীবনে আর্সেনালে পাঁচ বছর কাটানো এই সাবেক সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। এডু যে কত ভালো, সেটা আর্সেনাল হাড়ে হাড়ে বুঝল এবার। আক্রমণভাগ থেকে শুরু করে রক্ষণভাগ, যেখানে যা দরকার, এডুর নেতৃত্বে আর্সেনাল সেটাই পেয়েছে। দলবদলের পর নতুন আর্সেনালের চেহারা তাহলে কেমন হলো?

আর্সেনালের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় এখন পেপে। ছবি: টুইটার
আর্সেনালের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় এখন পেপে। ছবি: টুইটার

পিওতর চেক অবসর নিয়ে নিয়েছেন। তাই গোলবারে জার্মান গোলরক্ষক বার্নড লেনোই মূল ভরসা। তাঁর বিকল্প হিসেবে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক দামিয়ান মার্টিনেজের ওপর সন্তুষ্ট কোচ উনাই এমেরি। ফলে চেকের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো গোলরক্ষককে নিয়ে আসেনি আর্সেনাল।

আর্সেনালের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল রক্ষণভাগে। সেন্টারব্যাক হিসেবে জার্মান তারকা শকোদ্রান মুস্তাফি ভালো খেলোয়াড় হলেও, মাঝে মাঝে এমন বিব্রতকর কিছু ভুল করে বসেন, যা ক্ষমার অযোগ্য। ফরাসি সেন্টারব্যাক লঁরা কসিয়েলনিও নয় বছর আর্সেনালে কাটানোর পর আর দলে থাকতে চাননি। এক রকম জোর-জবরদস্তি করে যোগ দিয়েছেন নিজের দেশের ক্লাব বোর্দোতে। ফলে আর্সেনালের মূল একাদশে গত বছর বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে দলে আসা গ্রিক সেন্টারব্যাক সক্রাতিস পাপাস্তোপোলোসের জায়গাই পাকা শুধু। দলে ক্যালাম চেম্বার্স আর রব হোল্ডিংয়ের মতো দুই সেন্টারব্যাক থাকলেও তাদের মূল একাদশে খেলার মতো যোগ্যতা আছে, এ কথা এমেরি নিজেও স্বীকার করবেন না হয়তো। সমস্যা সমাধানে আর্সেনাল তাই দুটি সেন্টারব্যাক নিয়ে এসেছে। এবং নজরে রেখেছে আরও একজনকে।

টটেনহামের সঙ্গে লড়াই করে সেঁত এতিয়েন থেকে প্রতিভাধর সেন্টারব্যাক উইলিয়াম সালিবাকে নিয়ে এসেছে আর্সেনাল, ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে। তবে এই মৌসুমটা সেঁত এতিয়েনেই ধারে কাটাবেন সালিবা। সামনের মৌসুম থেকে যোগ দেবেন এমেরির দলের হয়ে। সালিবা এর মধ্যেই প্রতিভা দিয়ে মন জয় করে নিয়েছেন অনেকের। ফুটবল বিশ্লেষকদের মতে, সালিবা যেহেতু এসেই গেছেন, আগামী দশ বছরের জন্য সেন্ট্রাল ডিফেন্স নিয়ে আর চিন্তা করা লাগবে না আর্সেনালের।

সালিবাকে যেহেতু এই মৌসুমে পাওয়া যাচ্ছে না, এই সময়টুকুতে যাতে কাজ চালানো যায়, সে লক্ষ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে দলবদলের শেষ দিনে চেলসি থেকে ব্রাজিলের ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজকে নিয়ে এসেছে আর্সেনাল। নতুন কোচ ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের অধীনে চেলসির মূল একাদশে যে জায়গা হবে না, এটা বেশ ভালোই বুঝেছিলেন লুইজ। বেঞ্চে বসে থাকতে চাননি, তাই শেষ দিনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে চলে এসেছেন গানার শিবিরে। ওদিকে পিএসজির খেলোয়াড় থাকার সময়ে কিছুদিন এমেরির অধীনে খেলেছিলেন লুইজ। বল পায়ে স্বচ্ছন্দ একজন ডিফেন্ডারকে মাত্র আট মিলিয়ন পাউন্ডে পাওয়ার সুযোগটা হারাতে চাননি আর্সেনালের ম্যানেজার। দুই বছরের চুক্তিতে আর্সেনালে চলে এসেছেন লুইজ।

চেলসি থেকে আর্সেনালে যোগ দিয়েছেন লুইজ। ছবি: টুইটার
চেলসি থেকে আর্সেনালে যোগ দিয়েছেন লুইজ। ছবি: টুইটার

রক্ষণের বাঁ পাশে সাইদ কোলাসিনাচ গত মৌসুমে খেললেও নিজের জায়গা সেভাবে পাকা করতে পারেননি। অতি-আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই নিজের মূল কাজটা ভুলে যান। ফলে বহুদিন থেকেই একটা আদর্শ লেফটব্যাক খুঁজছিলেন এমেরি। সেল্টিকের স্কটিশ লেফটব্যাক কিয়েরান টের্নিতে এসে থেমেছে তাঁর খোঁজ। ২৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে দলবদলের শেষ দিনে দলে এসেছেন ২২ বছর বয়সী এই লেফটব্যাক। টের্নির বিকল্প হিসেবে কাজ করবেন কোলাসিনাচ ও স্প্যানিশ বর্ষীয়ান লেফটব্যাক নাচো মনরেয়াল। ডানদিকে হেক্টর বেয়েরিনের জায়গা পাকা, তাঁর বিকল্প হিসেবে আছেন এন্সলি মাইটল্যান্ড-নাইলস।

গত মৌসুমে দুজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কিনেছিলেন এমেরি, ফলে এবার নতুন কোনো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কেনার দরকার পড়েনি আর্সেনালের। এমেরির পছন্দের ৪-২-৩-১ ছকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডের দুটি জায়গার জন্য যথারীতি গত মৌসুমের মতো লড়বেন সুইজারল্যান্ডের গ্রানিত শাকা, ফ্রান্সের মাতেও গেনদোজি, উরুগুয়ের লুকাস তোরেইরা ও মিশরের মোহাম্মদ এলনেনি। তা ছাড়া সেন্টারব্যাক ক্যালাম চেম্বার্সও এই জায়গায় খেলতে পারেন।

আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে এত দিন মেসুত ওজিল খেললেও এবার হয়তো বেঞ্চই হতে যাচ্ছে তাঁর ঠিকানা। তাঁর জায়গায় খেলানোর জন্য রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এক বছরের ধারে আনা হয়েছে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার দানি সেবায়োসকে। শোনা যাচ্ছে, এমেরি নিজে সেবায়োসকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন, মৌসুমে অন্তত চল্লিশ ম্যাচে নামানো হবে তাঁকে। সেবায়োস আসায় এমেরির বেশ লাভ হয়েছে, কৌশলগত দিক থেকে। ওজিল আক্রমণাত্মক দিক দিয়ে দুর্দান্ত হলেও দলের প্রয়োজনে কখনো নিচে নেমে খেলতেন না। যে কাজটা সেবায়োস করেন। সেবায়োসের খেলার এই ধরনের জন্য এমেরি চাইলেই দলের ছক ৪-২-৩-১ থেকে পালটে ৪-৩-৩ করতে পারবেন। এই জায়গায় খেলার জন্য ওজিল আর সেবায়োস ছাড়াও আছেন তরুণ মিডফিল্ডার এমিল স্মিথ-রো।

আর্সেনাল স্কোয়াডের চেহারা এখন এমন। ছবি: সংগৃহীত
আর্সেনাল স্কোয়াডের চেহারা এখন এমন। ছবি: সংগৃহীত

এবার সবচেয়ে দুর্দান্ত খেলোয়াড়টা আর্সেনাল এনেছে আক্রমণভাগের জন্য। বহু বছর ধরেই একজন আদর্শ উইঙ্গারের অভাব ভোগাচ্ছিল গানারদের। বায়ার্ন মিউনিখ, পিএসজি, লিভারপুলের মতো ক্লাবগুলোকে হারিয়ে ফরাসি ক্লাব লিলের উইঙ্গার নিকোলাস পেপেকে আনার মাধ্যমে সেই অভাব মিটিয়েছে তারা। তাঁকে আনতে খরচ হয়েছে ৭২ মিলিয়ন পাউন্ড। আর এই দলবদলেই মূলত চোখ কপালে উঠে গেছে সবার। 

এত টাকা কোত্থেকে পেল আর্সেনাল? শোনা যাচ্ছে, এবার দলবদলের প্রত্যেকটা খেলোয়াড় আনার পেছনে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছে তারা। যে ক্লাব থেকে খেলোয়াড় আনা হচ্ছে, তাদের একবারেই সব টাকা দিচ্ছে না তারা। খেলোয়াড়ের সঙ্গে যত বছরের চুক্তি হচ্ছে, তত বছর ধরে আর্সেনাল পুরো টাকা শোধ করবে। যেমন নিকোলাস পেপের সঙ্গে আর্সেনাল চুক্তি করেছে পাঁচ বছরের। ৭২ মিলিয়ন পাউন্ড এই পাঁচ বছর ধরে শোধ করবে গানাররা, বাৎসরিক ১৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড করে দেবে লিলকে। ফলে এই বছরের বাজেট ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড হলেও সমস্যা হয়নি তেমন!

তা ছাড়া বেশ কিছু খেলোয়াড় বিক্রি করেছে গানাররা, ফলে বাজেটের বাইরেও বেশ কিছু টাকা এসেছে এমেরির হাতে। কলম্বিয়ার গোলরক্ষক ওসপিনা চলে গেছেন নাপোলিতে, ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। ডার্বি কাউন্টিতে যোগ দিয়েছেন পোলিশ মিডফিল্ডার ক্রিস্তিয়ান বিয়েলিক, ১০ মিলিয়ন পাউন্ডে। ক্লাব ছেড়েছেন লঁরা কসিয়েলনি, ৪.৬ মিলিয়ন পাউন্ডে। সবচেয়ে বড় দাঁওটা আর্সেনাল মেরেছে নাইজেরিয়ান উইঙ্গার অ্যালেক্স আইওবিকে বিক্রি করে। তাঁকে বেঁচে সব মিলিয়ে ৩৪ মিলিয়ন পাউন্ডের মতো পাচ্ছে আর্সেনাল। অন্যান্য কিছু অখ্যাত খেলোয়াড় বিক্রি করেও ৬-৭ মিলিয়ন পাউন্ডের মতো আয় হয়েছে তাদের। পিওতর চেক, অ্যারন র‍্যামসে, ড্যানি ওয়েলবেক বা স্টেফান লিখস্টাইনারের মতো খেলোয়াড়দের ছেড়ে দেওয়ার কারণে বেতনও বেচেছে কিছু।

মূল স্ট্রাইকার হিসেবে যথারীতি ফরাসি স্ট্রাইকার আলেক্সান্ডার লাকাজেত ও গতবারে লিগে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াংকে পাচ্ছে আর্সেনাল। ব্রাজিল থেকে তরুণ স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেল্লিকেও পেয়েছে আর্সেনাল এবার। উইংয়ে খেলার জন্য পেপের সঙ্গে লড়াই হবে মূলত হেনরিখ মিখিতারিয়ান ও ইংল্যান্ডের তরুণ তারকা রিস নেলসনের সঙ্গে। 

পছন্দসই খেলোয়াড়দের নিয়ে এবার আর্সেনালের হয়ে কী কী জিততে পারবেন এমেরি? দেখার বিষয় সেটাই!