গ্যালারিতে বসেই ওয়াহ-পন্টিংয়ের 'রেকর্ড' ভেঙেছেন তিনি

অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে লর্ডসের লং রুমে গিলিয়ান। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে লর্ডসের লং রুমে গিলিয়ান। ছবি: ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া দলের সমর্থক হিসেবে ২০০তম টেস্ট দেখে ফেললেন লুক ‘স্প্যারো’ গিলিয়ান


মাঠে খেলোয়াড়েরাই কি শুধু খেলেন? গ্যালারিতে যাঁরা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যান প্রিয় দলকে তাঁরাও তো ‘একরকম’ খেলোয়াড়ই। মাঠের ব্যাট-বলের লড়াইয়ে তাঁদের হয়তো কোনো অবদান নেই কিন্তু একাগ্র মনে সমর্থন দিয়ে ভূমিকা রাখেন ‘দ্বাদশ’ খেলোয়াড় হিসেবে। সে হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট ম্যাচ ‘খেলা’র রেকর্ডটি স্টিভ ওয়াহ কিংবা রিকি পন্টিংয়ের নয়!

লুক ‘স্প্যারো’ গিলিয়ান। নামটি অপরিচিত ঠেকবে সেটাই স্বাভাবিক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ ১৬৮ টেস্ট খেলেছেন ওয়াহ-পন্টিং। ক্রিকেটের এ নিরেট পরিসংখ্যানে লুক গিলিয়ানের নামটা থাকবে না। অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড় থেকে নানা দেশের দর্শকদের কাছে তিনি ‘স্প্যারো’ নামেই পরিচিত। এই গিলিয়ান আসলে মাঠের খেলোয়াড় নন, গ্যালারির ‘খেলোয়াড়’।

গিলিয়ান অস্ট্রেলিয়া দলের কতটা পাঁড় সমর্থক সেটি তাঁর জীবন বৃত্তান্ত জানলে বোঝা যাবে। গত ২৫ বছরে অস্ট্রেলিয়া যেখানেই টেস্ট খেলতে গিয়েছে গিলিয়ানকে দেখা গেছে গ্যালারিতে। অস্ট্রেলিয়ার পতাকা ওড়াচ্ছেন। টেস্ট খেলুড়ে সব কটি দেশে পা পড়েছে তাঁর। এখন যেমন মাতাচ্ছেন লর্ডসের গ্যালারি। চলমান লর্ডস টেস্ট অস্ট্রেলিয়া দলের ভক্ত হিসেবে তাঁর ‘ক্যারিয়ার’-এর ২০০তম টেস্ট। গ্যালারির ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে অন্তত ওয়াহ আর পন্টিংকে বেশ আগেই পেছনে ফেলেছেন গিলিয়ান।

মাত্র ১০ বছর বয়সে গিলিয়ান বুঝে গিয়েছিলেন ক্রিকেট তাঁর ভালোবাসা। মাঝে ২৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বুঝলেন এটি তাঁর জীবিকাও। জীবনের এ ইনিংসে তিনি ‘ফিফটি’ ছুঁয়ে ফেলবেন আগামী জুলাইয়ে, কিন্তু প্রাণ-প্রাচুর্যে এতটুকু ঘাটতি নেই। সেই রঙিন শার্ট, কাঁধে একটি ব্যাট আর এক হাতে ওড়াচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার পতাকা—দলের প্রতিটি বাউন্ডারি, উইকেট নেওয়া কিংবা যেকোনো ভালো কিছু এভাবেই উদযাপন করে আসছেন গিলিয়ান, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে! আর এই দীর্ঘ পথচলার ফাঁকে তিনি প্রতিষ্ঠান করেছেন অস্ট্রেলীয় টেস্ট সমর্থকগোষ্ঠী ‘ওয়েভিং দ্য ফ্লাগ’।

ক্রিকেটকে ভালোবেসে এমন পথচলা শুধু দীর্ঘ নয় ভীষণ ক্লান্তিকরও। ন্যূনতম ১০০ টেস্ট খেলা যেকোনো ক্রিকেটারই জানেন, ক্যারিয়ারজুড়ে কত জায়গায় যেতে হয়েছে, পরিবার ছাড়া থাকতে হয় কত দিন আর ভ্রমণক্লান্তি তো রয়েছেই। গিলিয়ানের মতো ভক্তদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ক্রিকেটাররা অবশ্য তাঁদের পথচলায় যথেষ্ট নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন কিন্তু ভক্তদের জন্য তেমন কিছু নেই। যা করতে হবে নিজে নিজে। আর এই হ্যাপা পোহাতে গিয়ে গিলিয়ান নিজেও মাঝেমধ্যে সন্দেহে ভুগেছেন, ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ হবে তো!

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ওয়েবসাইটের সঙ্গে এ সপ্তাহে ২০১৬ সালের একটি স্মৃতি ভাগ করে নেন গিলিয়ান, ‘সেবার শ্রীলঙ্কায় যাই। ক্রিকেট দেখার জন্য জায়গাটার কোনো তুলনা হয় না। সেখানে ১৫ দিনের মতো সূচি ছিল। কিন্তু সেখানে নামার পর থেকে বাসায় ফেরার জন্য আর তর সইছিল না। হৃদয়টা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল।’ তারপর থেকে অনেক ঝড় গেছে গিলিয়ানের জীবনে। ভ্রমণের ব্যবসাটা মার খেয়ে গেছে, ব্রেক্সিটসংক্রান্ত নানা করের জন্য শার্ট তৈরি প্রতিষ্ঠানও ধসে পড়েছে—এতে দেউলিয়াত্বের মুখোমুখিও হতে হয়েছে গিলিয়ানকে। এসব বাধাবিপত্তির মাঝেই শুনেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের ভ্রমণসঙ্গী মস্কোর হাসপাতালে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে, আর লন্ডনের বাড়ি থেকেও উচ্ছেদ হতে হয়েছে।

যে লোকটা বছরের পর বছর ধরে অবিচলভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া দলকে কলকাতা, কেপ টাউন কিংবা চট্টগ্রামে, তাঁর দুর্দিনে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরাও দলে দলে গিলিয়ানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। লর্ডসে তাঁর ২০০তম টেস্ট নিয়ে ডেভিড ওয়ার্নারের টুইট, ‘২০০ নট আউট থাকার জন্য লুক ‘স্প্যারো’ গিলিয়ানকে অভিনন্দন। গত ২৫ বছর ধরে আপনার এই অবিশ্বাস্য প্রয়াস আমাদের সবার জন্যই অনুকরণীয়। এ সময়ে অস্ট্রেলিয়া দলের উত্থান-পতন তিনি দেখেছেন কিন্তু সমর্থন কখনো কমেনি।’

ক্রিকেটের প্রতি গিলিয়ানের ভালোবাসার শুরু স্কুলজীবনে। ১৯৮১ সালে এমসিজি টেস্টে ল্যান্স গিবসকে তুলে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির রেকর্ড গড়া দেখেছেন গিলিয়ান। তখন তাঁর বয়স ১১ বছর, দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঠের বাউন্ডারি সীমানায়। মাঠে আসার আগে সাতসকালে সাইকেলের ভেঁপু খুলে নিয়ে এসেছিলেন। লিলিকে নৈবেদ্য দিতে ওটা কাজে লেগেছিল। দুই বছর পর রাতে বাসে করে সিডনিতে এসে থেকেছিলেন খালার বাসায়। জুনিয়র সদস্য হিসেবে সেটি ছিল সিডনিতে দেখা গিলিয়ানের প্রথম টেস্ট।

১৯৯৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। গিলিয়ান একার চেষ্টায় সুযোগটা কাজে লাগান। সে সফরেই সেন্ট কিটসে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে গিলিয়ান খেয়াল করলেন, পানি পানের বিরতির পর অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের স্পনসর সরবরাহক কোলা জাতীয় পানীয় ছাড়া কিছুই দেওয়া হয় না। দৃশ্যটা তাঁর মনে দাগ কাটল। সেখানে যে বাসায় ছিলেন পরের দিন তাঁদের কাছ থেকে ‘ট্রে’ জাতীয় একটি চ্যাপ্টা পাত্র ধার করলেন গিলিয়ান। মাঠে যাওয়ার আগে স্থানীয় বাজার থেকে কিছু ফলমূল কিনলেন। দ্বিতীয় দিনের খেলায় পানি পানের বিরতির সময় মাঠে ঢুকে পাত্রভর্তি সেসব ফলমূল তুলে দিলেন প্রাণের দলের হাতে। রচিত হলো জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্কের ভিত্তি। এরপর মার্ক টেলর, স্টিভ ওয়াহ কিংবা রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া যেখানেই সফরে গিয়েছে, দলের সবাই জানতেন গ্যালারিতে গিলিয়ান আছেন—কাঁধে ব্যাট আর হাতে অস্ট্রেলিয়ার পতাকা নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়া দলের অনুশীলন থেকে উৎসবেও ডাক পেয়েছেন গিলিয়ান এবং তাঁর সঙ্গীরা। এমনকি ড্রেসিং রুমে তাঁর নেতৃত্বে বিজয় সংগীতও গেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা। আর ১৯৯৭ অ্যাশেজ সফরে লর্ডসের সেন্টার উইকেটে তো স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে গিলিয়ান ব্যাটও করেছেন! তবে সেটা লিখিতভাবে। ওয়াহকে নিজের দিনপঞ্জি ধার দিয়েছিলেন গিলিয়ান (পরে ওয়াহর একটি বইয়ের ভূমিকাও লিখেছেন গিলিয়ান)। আর ওয়াহ সেই দিনপঞ্জি রাখার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিজের প্যাডের ভেতর। পরে ভুলেও গিয়েছিলেন! ওই প্যাড পরেই ব্যাট করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এ অধিনায়ক।

কাঁধে ব্যাট হাতে অস্ট্রেলিয়ার পতাকা—গিলিয়ানের চিরাচরিত ছবি। ছবি: টুইটার
কাঁধে ব্যাট হাতে অস্ট্রেলিয়ার পতাকা—গিলিয়ানের চিরাচরিত ছবি। ছবি: টুইটার

জীবনে বৈরী সময়ের কারণে গিলিয়ান দুশ্চিন্তায় ছিলেন, ইংল্যান্ডে এবারের অ্যাশেজ দেখতে পারবেন কি না। অস্ট্রেলিয়া দলে কিন্তু তাঁর মাইলফলকটা জানত। ওদিকে গিলিয়ানের জীবন কাটতে একটি গাড়িতে পরে অস্ট্রিয়ায় এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে থেকে স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছেন। সেখান থেকেই অস্ট্রেলিয়া দলের টিম ম্যানেজার গ্যাভিন ডোভিকে মেইল করে গিলিয়ান জানান, তিনি হয়তো ইংল্যান্ডে যেতে পারবেন না। এদিকে গিলিয়ানের বন্ধুপ্রতিম জাস্টিন ল্যাঙ্গার ও স্টিভ ওয়াহ অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে থাকায় তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেন, সে ইংল্যান্ডে আসতে পারলে থাকার ব্যবস্থা করবে দল।

গিলিয়ান ইংল্যান্ডে আসার পর লর্ডসে তাঁকে ভোজনসভায় নিমন্ত্রণ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া দলের অফিশিয়াল ছবিতেও জায়গা পেয়েছেন। ২০০তম টেস্টের স্মারক হিসেবে কেক কাটা এবং খেলোয়াড়দের সই করা স্মারক জার্সিও তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে লর্ডসের লং রুমে।

যে মানুষটা বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন গ্যালারিতে, দলকে সমর্থন দেওয়ার শক্তি জোগাতে যাঁর ভরসা ছিল শুধু পানির বোতল, সেই গিলিয়ান এমন মর্যাদা পাওয়ার পর বলেছেন, ‘আমি কখনো এসব আশা করিনি। গ্যাভিন সপ্তাহ ধরে বলেছে, সোমবার দলীয় অনুশীলনে যেন অবশ্যই হাজির থাকি। আমার জন্য নাকি আয়োজন আছে। এসব (উপহার) আমার কাছে অমূল্য। ২০০তম টেস্টের স্মারক—যা বুঝিয়ে দেয়, রুটিটা যত সরুই হোক সব সময় তার দুটি পিঠ থাকে।’

(জীবনের) সে দুটি পিঠের একটি সুখ হলে আরেকটি বুঝি দুঃখ? এমন সমর্থক পেলে যেকোনো দল তাঁকে সব সময় সুখের পিঠটাই দেখাতে চাইবে। আর গিলিয়ান তো শুধু সমর্থক নন টিম পেইনদের ‘দ্বাদশ’ খেলোয়াড়ও!