পারলে 'ওয়ান ট্রিক পনি' হয়েই দেখাক সবাই

কোর্টের রাজা আপাতত নাদালই। ছবি: এএফপি
কোর্টের রাজা আপাতত নাদালই। ছবি: এএফপি
>২০০৫ সালে চোটের পর চিকিৎসক বলে দিয়েছিলেন, তোমার ক্যারিয়ার শেষ হতে চলল। সেদিন থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ আজও চলছে। ১৯ গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের পরও ৩৩ ছোঁয়া নাদালকে সামনে এগোনোর তাগিদ দিচ্ছে এই যুদ্ধটাই

ম্যাচ পয়েন্টের খুব কাছাকাছি গিয়েও জেতা হয়নি। ব্রেক করতে পারলেই শিরোপাটা ঘণ্টাখানেক আগেই বগলদাবা করতে পারতেন রাফায়েল নাদাল। পঞ্চম সেটে তাই আর মিস করেননি। ম্যাচ পয়েন্টের শটটা বেশ জোরেশোরেই খেললেন রাফায়েল নাদাল। পড়িমরি করে মেদভেদেভ ফেরালেন বটে, কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। কোর্টের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে ড্রপ করার আগেই চোখ বুজে কোর্টে শুয়ে পড়লেন নাদাল। ব্যস, আপাতত তাঁর কাজ শেষ। এবার না হয় একটু পেছনে ফেরে দেখা যাক।

পেছনে ফিরতে বললেই তো আর হয় না। কোথা থেকে শুরু করতে হবে সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে। মায়োর্কার ম্যাটাডোরকে তিনবার ভাবতে হবে। ছোট্ট থেকেই শুরু করা যাক। এক চাচার পায়ে ফুটবল, অন্য চাচার হাতে টেনিস র‍্যাকেট। পছন্দের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিলেন রাফার ওপর। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত পায়ের কারিকুরি কিংবা টেনিসের শট, দুটোতেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিল ছোট্ট রাফার। ফুটবল পায়ে নিলে কেমন করতেন কে জানে, কিন্তু ভাগ্য ঠিক রেখেছিল অন্য কিছু।

ফেদেরার যুগ শুরু হয়েছে মাত্র। আগাসির বয়স হয়ে গেছে। মারিত সাফিন, অ্যান্ডি রডিকেরা শুধু মাঝে মধ্যে হুংকার ছুড়েই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন। রজার ফেদেরার নামের ঝড়ের সামনে সবাই ভেসে যাচ্ছিলেন। এ সময় বুক ফুলিয়ে হাজির হলেন ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ। প্রথমবারেই জানিয়ে দিলেন, একা একা রাজত্ব ভোগ করার সুযোগ নেই ফেদেরারের। টাইব্রেকারে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত দিলেন না, সরাসরি সেটেই জিতলেন। এরপর ফ্রেঞ্চ ওপেন ফাইনালেও একইভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো। সেই থেকে নাদালের দাপিয়ে বেড়ানো শুরু টেনিস দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত; যেমনটা কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়ান।

সেই পরিচিত উদযাপন ভঙ্গি। ছবি: এএফপি
সেই পরিচিত উদযাপন ভঙ্গি। ছবি: এএফপি

পাওয়ার টেনিসের রাজত্ব গড়েছেন নাদাল। লাল মাটি তাঁর দুর্গ। আর কোথাও না পারলেও এই লাল মাটির রাজত্বে কোনো নড়ন-চড়ন নেই। রোলাঁ গারোতে গুনে গুনে মাত্র দুটি হার। একটা সোডারলিং, অন্যটি জোকোভিচের বিপক্ষে। সে দুই ম্যাচ না হারলে সম্ভবত এখনো ফেদেরার ও জোকোভিচের সব কটি গ্র্যান্ড স্লাম জেতা স্বপ্নই হয়ে রইত। তবু, ‘ওয়ান ট্রিক পনি’ ট্যাগটা নাদালের গায়েই ঠেসে আছে। ফ্রেঞ্চ ওপেনের ট্রফিটা গত ১৫ বছরে মাত্র তিনবার তাঁর হাতে যায়নি। এমন কীর্তিতে কোথায় সবাই অবিশ্বাস্যে তাকাবে তা নয়, ক্যারিয়ারে লাল মাটির কোর্টে দাপিয়ে বেড়ানোই যেন দোষ হয়েছে নাদালের। অথচ অস্ট্রেলিয়া ওপেনে টানা ফাইনালে উঠেছেন, উইম্বলডনেও খেলেছে ফাইনাল, আছে দুই শিরোপা। ইউএস ওপেনও জিতেছেন চারবার। তবু নাদালকে খাটো করার জন্য সেই একই খোঁটা, ‘ওয়ান ট্রিক পনি!’

শুধু কোর্টে নিজেকে আটকে না রেখে খুলেছিলেন রাফা নাদাল একাডেমি। চাচা টনি নিজে পারেননি, কিন্তু স্পেনের ভবিষ্যতের ব্যাটনটা তুলে দিয়েছিলেন নাদালের হাতে। সাফল্যের সঙ্গে সে ব্যাটনের সম্মান দিয়েছেন, এখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছেন সেটা। সে চেষ্টাতেই সৃষ্টি করেছেন রাফা নাদাল একাডেমি। তরুণ তারকা তৈরি করার কাজ হয়তো নিয়েছেন, কিন্তু তরুণদের এখনো শিরোপা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় নেই তাঁর। নেই ক্যারিয়ার-জুড়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ফেদালোভিচ (ফেদেরার-নাদাল-জোকোভিচ) ত্রয়ীরই। নইলে গত তিন বছরে সব কটি নিজেদের পকেটে পোরেন কীভাবে? সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল তাঁদের। কিন্তু ৩০ পেরিয়ে এসেও তিনজনই জানিয়ে দিচ্ছেন, বাতিল করার দুঃসাহস এখনো নয়।

ম্যাচ খেলতে নামার আগে এখনো চুপচাপ পাঁচ মিনিট স্প্যানিশ মিউজিক শোনেন। মাঠে নামার পর সবার আগে দুটো বোতল বের করেন। সাজিয়ে নেন জায়গামতো। বল লেগে পরে গেলে সব ছেড়ে ছুড়ে এগিয়ে যান। নিজেরই ঠিক করা লাগবে সেটা। ম্যাচ শুরুর আগে কোর্টের দাগে পা না দেওয়া, টসের আগ পর্যন্ত সর্বক্ষণ লাফানো আর শিরোপা উঁচিয়ে ধরার আগে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটা কামড় লাগিয়ে দেওয়া। আগাগোড়া কুসংস্কারে ভরা মানুষটা খেলছেন নিজের সেরাটা, সবচেয়ে আধুনিক নিয়মে। বয়সটা ৩৩ পেরিয়েছে, কিন্তু শরীরকে রেখেছেন সেই উনিশের মতোই। শরীর সায় দেয়নি, ভেঙে পড়েছে, ওভাবেই ভেঙেচুরে আবার গড়েছেন নিজেকে।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রতিটি পয়েন্টের জন্য এভাবে জীবন বাজি রেখে খেলছেন। ছবি: এএফপি
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রতিটি পয়েন্টের জন্য এভাবে জীবন বাজি রেখে খেলছেন। ছবি: এএফপি

থেমে যাওয়ার তাগাদা কম মানুষ দেননি। ১৬ বছর বয়স থেকে নিয়মিত ইনজুরির সঙ্গে সংসার পাতানো নাদালকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও কম হয়নি বটে। খেলার ধরন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে স্বাভাবিক মানুষ খেলতে পারে? এভাবে খেলতে থাকলে তো নাদালকে হুইলচেয়ারে বসতে হবে। এ বছর ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতার পর নাইকি একটা প্রমোশনাল ভিডিও বের করেছিলে, যাতে ছিল নাদালকে নিয়ে করা বিখ্যাত কমেন্ট, ‘ইজ হি গনা প্লে এভরি পয়েন্ট লাইক দ্যাট?’ নাদাল এভাবেই খেলছেন, সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। চোটের কারণে ১৪টি গ্র্যান্ড স্লামে অংশই নিতে পারেননি। বরং পুরস্কার বিতরণীতে তাঁর বাকি ১৮টা গ্র্যান্ড স্লামের ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হলো, তখন বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠে বললেন, ‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।’

আসলেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। ৩৩ হয়ে গেছে। ফেদেরারের মতো ফিটনেস কখনোই ছিল না। তাই এরপর হয়তো আর এভাবে পাওয়া যাবে না কখনোই। শিরোপা হাতে উদ্‌যাপন করতে দেখা যাবে না তাঁকে। শিরোপা জিততে জিততে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কথা এত দিনে, তবু প্রতিবার ট্রফি জিতে আনন্দে শুয়ে পড়েন কোর্টে, যেন বাচ্চা ছেলের প্রথম খেলনা পাওয়ার অনুভূতি। সেই ছোটবেলায় চাচাকে কথা দিয়েছিলেন, যত দিন টেনিসকে ভালোবাসবেন, র‍্যাকেট কখনো ভাঙবেন না। কোর্টে হরহামেশাই যখন দেখা যায় র‍্যাকেট ভাঙার ছড়াছড়ি, সেখানে আবেগের চূড়ান্ত মুহূর্তেও খেলে চলেন নাদাল।

ম্যাটাডোরের যে হাল ছাড়তে নেই!