আমিনুলের সামনে উদাহরণ স্মিথ, সাকিবরা

কাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমিনুলের মাথায় আস্থা ও স্নেহের পরশ সাকিবের। তাঁর সময় এখন নিজেকে প্রস্তুত করার। ছবি: প্রথম আলো
কাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমিনুলের মাথায় আস্থা ও স্নেহের পরশ সাকিবের। তাঁর সময় এখন নিজেকে প্রস্তুত করার। ছবি: প্রথম আলো

এক ম্যাচ দেখেই কাউকে দুর্দান্ত বলা যায় না। অভিষেকের আগে তাঁকে নিয়ে যত কথা হয়েছে, সেসব ভাবলে তো আরও না। তা অভিষেক যত ভালোই হোক না কেন, ঝুঁকি থেকেই যায়। অভিষেকের মঞ্চ রাঙিয়ে পরে হারিয়ে যাওয়ার নজিরও বাংলাদেশ ক্রিকেটে কম নেই। আমিনুল ইসলাম কোন পথে হাঁটবেন, সে কথা তাই এখনই বলা যায় না। ব্যাটসম্যানই থাকবেন, না চৌকস লেগ স্পিনার হয়ে উঠবেন—সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও আমিনুলের।

লেগ স্পিনারের জন্য হাপিত্যেশ বাংলাদেশ ক্রিকেটে পুরোনো রোগ। স্থায়ী নয় তাৎক্ষণিক দাওয়াই হিসেবে জাতীয় দলে নিয়ে আসা হয়েছে আমিনুলকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হলেও কাল থেকে আমিনুলকে লেগি হিসেবেই চেনার সংখ্যাই হয়তো বেশি হবে। কিন্তু ভেবে দেখুন, জাতীয় দলে আসার আগে ছেলেটি কখনো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেনি, অভিজ্ঞতা বলতে ১৯টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ আর দুটি টি-টোয়েন্টি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে খেলেছেন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। পাশাপাশি খণ্ডকালীন লেগ স্পিনার।

বোলিংয়ে আমিনুলের মনোযোগ বেড়েছে সবশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পর। কিন্তু এমন কেউ যখন জাতীয় দলে ঢুকে পড়েন লেগ স্পিনার হিসেবে, তখন বিস্ময় জাগাই স্বাভাবিক। সে বিস্ময় আরও বাড়ে যখন অভিষেকেই পারফরম্যান্সটা হয় দুর্দান্ত। কাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমিনুলের বোলিং-পরিসংখ্যান ৪-০-১৮-২। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ব্যাটসম্যান হয়েও লেগ স্পিনার হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার আলাদা কোনো চাপ নেননি আমিনুল। ছিল না কোনো ভয়-ডর। মাহমুদউল্লাহর ভাষায়, ‘ওকে আজ শুধু বলছিলাম যাই করো, বুকে সাহস নিয়ে করবে। ভয় নিয়ে খেললে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা যায় না। যা করবে মন খুলে। মনে হচ্ছিল কথাগুলো সে অনুভব করছিল এবং সেভাবেই বোলিং করেছে।’

ভাগ্য সাহসীদের সহায় হয়। অভিষেক ম্যাচেই সেই প্রমাণ রাখলেন আমিনুল। এখন সামনের পথেও তাঁকে আরও সাহসী হতে হবে। চোটে পড়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজে তাঁকে আর নাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু সামনে তো দিন পড়েই আছে। সেসব দিন ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে আমিনুলের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা—কোন পথে হাঁটবেন আমিনুল? ব্যাটসম্যান, লেগ স্পিনার না বোলিং অলরাউন্ডার? এ নিয়ে সমালোচনাও নিশ্চয়ই কম হবে না। এ দেশে তো ক্রিকেটপ্রেমী ‘নানা মুনির নানা মত’। কিন্তু লোকের কথায় কান না দিয়ে আমিনুল নিশ্চয়ই সাড়া দেবেন মনের ডাকে? আর সে জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভূরি ভূরি উদাহরণ পড়ে আছে তাঁর সামনে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দু রকম উদাহরণই আছে। ব্যাটসম্যান থেকে বোলার হয়েছেন, আবার বোলার থেকে ব্যাটসম্যান। কিংবা ছিলেন ব্যাটসম্যান, সাড়া ফেললেন খণ্ডকালীন বোলার হিসেবে। একদম নিজ ঘর থেকেই শুরু করা যায়। অলক কাপালিকে নিশ্চয়ই মনে আছে? টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিকের কীর্তি এ লেগ স্পিনারের। ভ্রুকুটি জাগছে? কাপালি তো ব্যাটসম্যান ছিলেন! ঠিকই ধরেছেন। তবে ওই হ্যাটট্রিক দিয়ে কাপালিকে মানুষ মনে রেখেছে বেশি এবং তারপর থেকে ম্যাচে তাঁর হাত ঘোরানোর পরিমাণও বেড়েছিল।

ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ৫ উইকেট শিকারিও একজন ব্যাটসম্যান— আফতাব আহমেদ। নিউজিল্যান্ডকে কাত করেছিলেন নিরীহ দর্শন মিডিয়াম পেসে। মোহাম্মদ আশরাফুলের পাঁচ মিশালি স্পিনও মাঝে মধ্যে বেশ কাজে লেগেছে। আর সাকিব আল হাসান তো এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাকি ক্রিকেটারদের জন্য উদাহরণ। আগে ছিলেন শুধু ব্যাটসম্যান সাকিব, বিশ্বমানের স্পিনার হয়ে উঠেছেন পরে। দেশের বাইরে তাকালে সাম্প্রতিক সময়ে সবার আগে উঠে আসবে স্টিভ স্মিথের নাম। টেস্ট আঙিনায় বর্তমান বিশ্বের সেরা এ ব্যাটসম্যানের ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক ঘটেছিল লেগ স্পিনার হিসেবে। বাকিটা ইতিহাস।

স্মিথ যেভাবে নিজেকে বদলেছেন সেটি ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়েই থাকবে। আমিনুল সে ‘রূপকথা’ থেকে দীক্ষা নিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন নিজের পথ। এমন রূপকথা আরও আছে। ওয়ানডেতে সর্বকালের সেরাদের একজন সনাথ জয়াসুরিয়া শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলে মূলত সুযোগ পেয়েছিলেন স্পিনার হিসেবে। পরে ‘পিঞ্চ হিটার’ হিসেবে কোচ ডেভ হোয়াটমোর তাঁকে ব্যাটিং অর্ডারে ওপরের সারিতে তুলে আনেন।

কিংবা শহীদ আফ্রিদি। পাকিস্তান দলে তাঁরও অভিষেক ঘটেছিল লেগ স্পিনার হিসেবে। পরে নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও ক্রিকেট বিশ্বে কিন্তু তাঁর পরিচিতি ‘বুম বুম আফ্রিদি’। পাকিস্তানের আরও দুজনের উদাহরণ টানা যায়। শোয়েব মালিক ও আবদুর রাজ্জাক। নিজেদের ক্যারিয়ারে দুজনেই বড় মাপের অলরাউন্ডার। কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন বোলার হিসেবে। অবশ্য ভারতের রবিচন্দ্রন অশ্বিন তাঁদের চেয়ে এক কাঠি সরেস। শুরুটা পেসার হিসেবে, এরপর হলেন ভারতের অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ওপেনার! কিন্তু জাতীয় দলে ঢুকলেন স্পিন অলরাউন্ডার হিসেবে।

উঠে আসবে কেভিন পিটারসেনের নামও। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অফ স্পিনার হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল ইংল্যান্ডের সাবেক এ ব্যাটসম্যানের। এই ইংলিশ ক্রিকেটেরই আরেক খ্যাতনামা সন্তান নাসের হুসেইন তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন একজন সম্ভাবনাময় লেগ স্পিনার। ব্যাটসম্যান হয়ে উঠলেন পরে, ওপেনও করলেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যামেরন হোয়াইটকেও এড়ানো যায় না। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন লেগ স্পিনার হিসেবে। এমন আরও অনেক নাম আছে। ল্যান্স ক্লুজনার ও রবি শাস্ত্রী যেমন বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে শেষ দিকে ওপেনও করেছেন জাতীয় দলে।

তাই এখনকার লেগ স্পিনার আমিনুল পরে কী হয়ে উঠবেন না ঝরে পড়বেন—তা সময় হলেই দেখা যাবে। আপাতত তাঁর জন্য এ সময়টা নিজেকে ঘষে-মেজে প্রস্তুত করার। তার ফলে যে আকৃতি পাবে, সেটাই হবে তাঁর পরিচিতি—ব্যাটসম্যান, লেগ স্পিনার কিংবা বোলিং অলরাউন্ডার। এ পথে উদাহরণ সৃষ্টি করা ক্রিকেটারেরা কিন্তু নিজেদের তৈরি করতে প্রচুর খেটেছেন। তাই আমিনুলের সময়টা এখন খাটুনির, পরিচয় খোঁজার না।