একটু বেশি বেশি সাবধানতা না হয় আজ থাক

জিম্বাবুয়ে কিংবা আফগানিস্তানের বিপক্ষে অতিরিক্ত চাপে ভোগেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা। ছবি: প্রথম আলো
জিম্বাবুয়ে কিংবা আফগানিস্তানের বিপক্ষে অতিরিক্ত চাপে ভোগেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা। ছবি: প্রথম আলো

আফগানিস্তান এবার বাংলাদেশে এসে টেস্ট জিতেছে, ত্রিদেশীয় সিরিজে জিতেছে দুই দলের প্রথম খেলাতেও। আজ তৃতীয়বারের মুখোমুখিতে বাংলাদেশ কি হার এড়িয়ে জয়ের দেখা পাবে? ফাইনালের আগে জয়টা কাজ করতে পারে টনিকের মতো। সে জন্য টি-টোয়েন্টির মেজাজ বুঝে স্বাভাবিক খেলার বিকল্প নেই। আর প্রশ্নটাও ঠিক এখানেই। স্বাভাবিক খেলাটা আর হচ্ছে কোথায়? আগে ছিল জিম্বাবুয়ে, এখন আফগানিস্তান; তাদের বিপক্ষে কোনোভাবেই হারা যাবে না—অতিরিক্ত এ চাপ কিংবা ভয় যে কোনোভাবেই তাড়ানো যাচ্ছে না!

জিম্বাবুয়ে কিংবা আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ আলাদা এক মানসিক চাপে ভুগে থাকে, সাদা চোখে এমনটাই মনে হয়। আর কথাটা খুব একটা মিথ্যেও না। দলের ক্রিকেটাররাই এর আগে স্বীকার করেছেন, এসব দলের বিপক্ষে কোনোভাবেই হারা যাবে না—সেই চাপটা থাকেই। হারলে কৌলীন্যে লাগে। কিন্তু অতিরিক্ত চাপে বেশির ভাগ সময়ই হিতে বিপরীত হয়। অন্তত আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষায় কিন্তু চাপটুকু পড়া গেছে। টেস্ট হারের ক্ষত শুকোতে ম্যাচটা জিততে মরিয়া ছিল বাংলাদেশ। পাল্টানো হয়েছিল কৌশলও। তাতে লাভ হয়নি।

সে ম্যাচে সবাইকে চমকে দিয়ে লিটন দাসের সঙ্গে ওপেন করেছিলেন মুশফিকুর রহিম। বোঝাই যাচ্ছিল, ইনিংসের শুরুতে আফগান স্পিনার মুজিব উর রহমানের ফাঁস থেকে সৌম্য সরকারকে নিরাপদে রাখতেই তাঁকে ব্যাটিং অর্ডারে নিচে নামানো হয়। কিন্তু দ্রুত উইকেট পড়ায় পাঁচ নম্বরে নেমেও সৌম্য রেহাই পাননি মুজিবের স্পিন ফাঁস থেকে। অর্থাৎ কৌশল খাটিয়েও তা কাজে লাগানো যায়নি নিজেদের ব্যর্থতার জন্যই। অতিরিক্ত চাপ নিয়ে ফেললে অবশ্য যেকোনো কৌশলই কাজে লাগানো কঠিন।

ক্রিকেট খেলা এক অর্থে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও। কৌশলগত লড়াইয়ে সব সময় প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে থাকতে হয়। আর সে লড়াইয়ে অতিরিক্ত চাপ সব সময়ই নেতিবাচক ছাপ ফেলে। যেমন ‘ডট বল’–এর কথাই ধরুন —সে ম্যাচে আফগানিস্তানের চেয়ে কমসংখ্যক বল ডট খেলেছে বাংলাদেশ। ৫২টি বল ডট খেলেছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ৪৬টি। খুব একটা পার্থক্য মনে না হলেও টি-টোয়েন্টিতে ৬ বলের পার্থক্য অনেক বেশি। কিন্তু আফগানিস্তান তা ঘুচিয়ে দিয়েছে দুর্দান্ত পাওয়ার হিটিংয়ে। নিজেদের ইনিংসে তাঁরা ছক্কা মেরেছে মোট ১০টি। বাংলাদেশ মেরেছে ১ ছক্কা, সেটিও এগারোয় ব্যাটিংয়ে নামা মোস্তাফিজুর রহমানের সৌজন্যে। তাহলে বাংলাদেশ যে কম ডট খেললে তাতে লাভটা কী হলো?

টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা কেন পাওয়ার হিটিং করতে পারেননি, সেটি একটি প্রশ্ন। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অবশ্য এরা আগে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা স্কিল হিটিংয়ে এগিয়ে কিন্তু পাওয়ার হিটিংয়ে পিছিয়ে। তবে সে ম্যাচে কিন্তু শুধু দক্ষতা দিয়ে বল বাতাসে ভাসিয়ে সীমানার ওপাশে পাঠাতেও কাউকে দেখা যায়নি। এখানেও সম্ভাব্য কারণ সেই অতিরিক্ত চাপ নিয়ে ফেলার প্রবণতা। সে ম্যাচে শুরুতে বল করা মুজিবের কাছ থেকে মাত্র একটি চার আদায় করতে পেরেছেন ব্যাটসম্যানরা। মোহাম্মদ নবীর বলে তো কেউ বাউন্ডারিই মারতে পারেননি! অতিরিক্ত সাবধানতা তার কারণ হতে পারে।

অথচ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে সেখানে অতিরিক্ত দূরের কথা, ব্যাটসম্যানদের জন্য ‘সাবধানতা’ শব্দের মূল্যই তো খুব সামান্য। বড় দলের বিপক্ষে তা হতে পারে। অনেকটাই নিজেদের মাপের দলের বিপক্ষে এমন কৌশল ইচ্ছে করে পায়ে শিকল পরে থাকার মতোই। আজ নিশ্চয়ই তেমন হবে না? ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ায় কোনো চাপ নেই। ব্যাটসম্যানরা চাইলে এ ম্যাচে ডানা মেলে দেওয়ার ‘মহড়া’ দিতে পারেন। বোলাররা ঝালিয়ে নিতে পারেন নিজেদের। বোলারদের প্রসঙ্গে অবশ্য একটি বিষয় লক্ষণীয়।

আগের ম্যাচে স্পিনারদের চেয়ে বাংলাদেশের পেসারদের বেশি ভালো খেলেছে আফগানিস্তান। চার-ছক্কা মিলিয়ে সাইফউদ্দিন, মোস্তাফিজ ও সৌম্য সরকারের কাছ থেকে মোট ১০টি বাউন্ডারি আদায় করেছে দলটি। স্পিনারদের কাছ থেকে ৭টি বাউন্ডারি। আর মোট ১০ ছক্কার মধ্যে ৭টি হজম করতে হয়েছে পেসারদের। ২৯টি ডট দিয়েছেন স্পিনাররা। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্পিনারদের খেলতে বেগ পেতে হয়েছে আফগানদের। আজকের চাপহীন ম্যাচে তাই স্পিনকে প্রাধান্য দিয়েই বোলিং আক্রমণভাগ সাজাতে পারে টিম ম্যানেজমেন্ট।

টপ অর্ডারের ব্যাটিংয়েও মানসিকতার সংস্কার প্রয়োজন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ভালো শুরু পেয়েছিলেন লিটন দাস। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে উপহার দিয়েছেন উইকেট। স্বাভাবিক থাকাটা আর হচ্ছে না। ভালো শুরু পেলে টি-টোয়েন্টিতেও কিন্তু শতভাগের বেশি স্ট্রাইক রেট রেখে ইনিংস গড়া যায়। তাতে পরের ব্যাটসম্যানদের ওপর চাপটা কমে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না বলে পরের ব্যাটসম্যানেরা ৩০-৪০ রানের ইনিংস খেলতে গিয়েও একটু বেশি বল খেলে ফেলছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ মাহমুদউল্লাহ-সাব্বির রহমানের জুটিতে ভর করে এগিয়েছিল। সে জুটিতে ৫১ বলে উঠেছে ৫৮ রান। তখন ম্যাচের পরিস্থিতি বিচারে যা একটু মন্থরই। সাব্বিরের ২৭ বলে ২৪ রান কিংবা মাহমুদউল্লাহর ৩৯ বলে ৪৪ রানে তাই সন্তুষ্টির চেয়ে আক্ষেপই বেশি থাকে। মনে হয়, কোথায় যেন একটা খামতি, একটা জড়তা কাজ করছে!

নিঃসন্দেহে তাতে মানসিক বাধা কিংবা চাপের প্রভাবই বেশি। সেজন্য একটু বেশি সাবধান থাকার মাশুল দিতে হচ্ছে। কিন্তু আজ তো এমন কোনো কিছুই নেই। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা এ ম্যাচে নির্ভয়ে উড়াল দিতে পারলে ফাইনালে উল্টো আফগানিস্তানই কিন্তু অতিরিক্ত চাপে থাকবে!