এক জার্মানের আগুনে পুড়ল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালিস্টরা

একাই চার গোল করে টটেনহামকে ডুবিয়েছেন সার্জ গেন্যাব্রি। ছবি : এএফপি
একাই চার গোল করে টটেনহামকে ডুবিয়েছেন সার্জ গেন্যাব্রি। ছবি : এএফপি
>কে বলবে কিছুদিন আগে এই দলটাই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছিল? গতবারের ফাইনালিস্ট টটেনহামকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করল জার্মান পরাশক্তি বায়ার্ন মিউনিখ। টটেনহামের মাঠেই টটেনহামকে গোলের মালা পরিয়েছে তারা। চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের ম্যাচে জিতেছে ৭-২ গোলে। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের মূল কুশীলব জার্মান তারকা সার্জ গেন্যাব্রি।

এককালে খেলতেন আর্সেনালের হয়ে। মূল দলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। শুধু আর্সেনাল কেন, ওয়েস্ট ব্রমের মতো দলের মূল একাদশেও এককালে জায়গা হয়নি সার্জ গেন্যাব্রির। সে কারণে ইংলিশ লিগের ওপরে তাঁর ক্ষোভ আছে কী না, কে জানে! আবার আর্সেনালের যুবদলের খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে টটেনহামের সঙ্গে বৈরিতাটাও তাঁর মজ্জাগত। সব মিলিয়ে গত রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগে টটেনহামের বিরুদ্ধে নিজের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ ও বৈরিতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন যেন গেন্যাব্রি। করলেন এক হালি গোল। আর তাতেই নিজেদের মাঠে গোলের মালা পরেছে টটেনহাম। ৭-২ গোলের বিশাল জয় নিয়ে জার্মানি ফিরল বায়ার্ন মিউনিখ।

অথচ এই গেন্যাব্রিকেই বছর তিনেক আগে মাত্র ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ওয়ের্ডার ব্রেমেনের কাছে বেচে দিয়েছিলেন সে সময়কার আর্সেনালের কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। আর দেবেন না-ই বা কেন? আর্সেনালের হয়ে নিজের প্রতিভার বিকাশ তেমন করতে পারতে পারেননি। না খেলতে খেলতে বিরক্ত মাঝে এক মৌসুম ধারে গিয়েছিলেন ইংলিশ লিগের নিচু সারির দল ওয়েস্ট ব্রমে। সেখানেও কোচ টনি পিউলিসের পছন্দের পাত্র হতে পারেননি তিনি। পিউলিস খোলাখুলিই বলেছিলেন তখন, ওয়েস্ট ব্রমে খেলার যোগ্যতা গেন্যাব্রির নেই। ওয়েস্ট ব্রমের হয়ে মাত্র একটা লিগ ম্যাচ খেলেছিলেন গেন্যাব্রি। যে কারণে গেন্যাব্রিকে ধারে ওয়েস্ট ব্রমে পাঠানো, সে উদ্দেশ্যই যদি পূরণ না হয়, তাহলে খামোখা তাঁকে সেখানে রেখে কি লাভ?

ছয় মাস যেতে না যেতেই তাই গেন্যাব্রিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়েঙ্গার। ২০১৫-১৬ মৌসুমের বাকি সময়ে এফএ কাপ ও কার্লিং কাপের অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে একটু একটু করে খেলেই কেটেছে গেন্যাব্রির সময়। এরপরেই গেন্যাব্রিকে ডাক দিল ওয়ের্ডার ব্রেমেন।

নিজের দেশে ফিরে গেন্যাব্রি নিজেকে খুঁজে পেলেন যেন। সে মৌসুমে লিগে ২৭ ম্যাচ খেলে করলেন ১১ গোল। চোখে পড়ল গোলমুখে তাঁর দুরন্ত ক্ষিপ্রতা ও কার্যকারিতা। গেন্যাব্রির দুর্দান্ত ফর্মে চড়ে ব্রেমেনও লিগ শেষ করল অষ্টম অবস্থানে থেকে।

জার্মান লিগের অন্য ক্লাবগুলোতে কোনো তরুণ জার্মান খেলোয়াড় ভালো খেলবে, আর সেটা লিগের ‘মহাজন’ বায়ার্ন মিউনিখের চোখে পড়বে না, তা তো হয় না। সেই জার্ড মুলার, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, মিরোস্লাভ ক্লোসা, পল ব্রাইটনার, লোথার ম্যাথাউস, সেপ মাইয়ার, মাইকেল বালাক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের লাম, শোয়াইনস্টাইগার, মুলার, নয়্যার, হামেলস, বোয়াটেং, গোমেজ - সব জার্মান তারকাই ক্যারিয়ারের উত্থানপর্বে খেলে গেছেন বায়ার্নে। নতুন দিনের জার্মান তারকাদের মধ্যে এখন দলে আছেন লিওন গোরেতজকা, জোশুয়া কিমিখ, নিকলাস সুলে প্রমুখ। গেন্যাব্রির উত্থানও তাই নজর এড়ালো না বায়ার্নের। অন্য কোনো ক্লাব গেন্যাব্রির দিকে চোখ তুলে তাকানোর আগেই তাই তড়িঘড়ি করে ২০১৭ সালের জুনে চুক্তির ৮ মিলিয়ন ইউরো বাই আউট ক্লজ পরিশোধ করে তাঁকে দলে নিয়ে এল জার্মান চ্যাম্পিয়নরা।

এরপর গল্পটা শুধুই ওপরে ওঠার। বায়ার্ন থেকে এক মৌসুম ধারে হফেনহেইমে খেলে এলেন, সেখানেও একই রকম দুরন্ত গেন্যাব্রি। আর গত মৌসুম থেকে নিজেকে আরিয়ান রোবেনের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রমাণ করছেন, ডান উইং পজিশনটা নিজের করে নিয়েছেন। গেন্যাব্রি আছেন বলেই এই মৌসুমে আরিয়ান রোবেনকে অবসরে পাঠাতে দু'বারও ভাবেনি বায়ার্ন। আর রোবেনের দায়িত্ব যে যোগ্য লোকের কাঁধেই পড়েছে, গেন্যাব্রি সেটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ দিলেন গত রাতে।

এক লিওনেল মেসি ছাড়া চ্যাম্পিয়নস লিগে ইংলিশ ক্লাবের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে হালি গোল করার কৃতিত্ব আর কারওর ছিল না। গেন্যাব্রির সাবেক ক্লাব আর্সেনালের বিপক্ষেই কীর্তিটা গড়েছিলেন মেসি। এখন সেই তালিকায় নাম লেখালেন গেন্যাব্রি। এক রেকর্ডে মেসির সঙ্গে ভাগ বসিয়েছেন, তো আরেক রেকর্ডে রোনালদোর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৫ সালে সুইডিশ ক্লাব মালমোর বিপক্ষে এক হালি গোল করেছিলেন গেন্যাব্রি। এরপর গত রাতের আগ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগে এক হালি গোল আর কেউ করেননি।

সবচেয়ে মজার কথা হলো, টটেনহামের নতুন মাঠে দলটির অধিনায়ক হ্যারি কেইনের গোলই আছে সব মিলিয়ে চারটা। জার্মানি থেকে এই স্টেডিয়ামে এক ম্যাচ খেলতে এসেই কেইনের সমান গোল করে ফেললেন গেন্যাব্রি!

ম্যাচের শেষে গেন্যাব্রি নিজের আর্সেনাল-সত্ত্বাটার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে টটেনহামের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে ভোলেননি একদম। ম্যাচ শেষে নিজের চার গোলের চারটি উদ্‌যাপনের ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দিয়েছেন, 'নর্থ লন্ডন ইজ রেড!'