শুভ জন্মদিন, অধিনায়ক

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক গোলরক্ষক ও অধিনায়ক আমিনুল হক। প্রথম আলো ফাইল ছবি
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক গোলরক্ষক ও অধিনায়ক আমিনুল হক। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক গোলরক্ষক ও অধিনায়ক আমিনুল হকের আজ জন্মদিন।

কোন তারকা খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ লাগবে নিয়ে নাও!

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনে (বাফুফে ভবন) জাতীয় দলের ক্যাম্পে প্রথম বিকেল। অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে ইমন বাবু ও মেজবাবুল মানিক ভাইয়ের সঙ্গে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এই প্রতিবেদকেরও। রিপোর্টিং শেষে দলীয় সভায় আমিনুল হক, মতিউর মুন্না, রজনী কান্ত বর্মণদের মতো তারকাদের সঙ্গে প্রথম বসা। চোখেমুখে বিস্ময় ও মুগ্ধতা দেখে জাতীয় দলের তৎকালীন ব্রাজিলিয়ান কোচ এডসন সিলভা ডিডো বলে দিলেন, ‘কার অটোগ্রাফ লাগবে নিয়ে নাও।’

আমিনুল ভাইয়ের কাছে নাম-পরিচয় দিলাম। সত্যি কথা বলতে পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই নেই। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগে ফুটবল পৃথিবীতে পুঁজি বলতে অনূর্ধ্ব-১৪, ১৭ ও ১৯ পর্যায়ে জাতীয় দলে খেলা। প্রিমিয়ার লিগ তো দূরের কথা, স্টেডিয়ামে বসে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলের একটি ম্যাচও দেখা হয়নি। সেই আমি আমিনুল হকের সতীর্থ। প্রথম পরিচয়ে সম্পর্কটা সহজ করে নিলেন নিজেই, ‘তোমাকে আমি চিনি, মারুফ (কোচ মারুফুল হক) ভাই তোমার ব্যাপারে আমাকে বলেছেন।’

ব্যস, দেশসেরা গোলরক্ষক হয়ে উঠলেন আমার অভিভাবক। যাঁর খেলা টিভিতে দেখে হাততালি দিয়েছি, অনুশীলন দেখার জন্য ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিকেএসপির ফুটবল মাঠে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি, সেই আমিনুল হয়ে উঠলেন আমার সতীর্থ ও অভিভাবক। যেন মাথার ওপর ছায়া দিয়ে বেড়ানো বটগাছ। ভালো বুট নেই বা ছুটির প্রয়োজন, বাফুফে ভবনের চতুর্থ তলার আমিনুল হকের ৪০১ নম্বর রুমের দরজা খোলা। সেই থেকে তরুণ এক ফুটবলারের হৃদয়ের অধিনায়ক।

শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন চলছে? তত দিনে পড়ালেখা বাদ দিয়ে মূল জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার লড়াইয়ে নিজেকে দিয়েছি সঁপে। কিন্তু বাবা-মাকে কে বোঝাবেন?

ক্যাম্পে চাউর, এইচএসসি পরীক্ষার ‘প্যারা’ টেনে ধরেছে আমাকে। কোচ ডিডো হাসেন, জাতীয় দলের খেলার সুযোগ পেয়েও কিনা পড়াশোনার চিন্তা করছে কেউ। এই দোটানা মনোভাব থেকে উদ্ধার করার জন্য কোচের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো অধিনায়ক আমিনুলকেই। ফরিদপুরে থাকা মা-বাবাকে বুঝিয়ে বন্দোবস্ত করা হলো খেলার। গোলরক্ষক আমিনুলের কথা না শোনার সাহস দেখাতে পারেননি আমার ফুটবলপাগল বাবাও।

তাঁর অধিনায়কত্বেই ২০০৯ সালে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে এই প্রতিবেদকের। গোলপোস্টের নিচে তিনি থাকলে একজন ডিফেন্ডার কতটা নির্ভার হয়ে খেলতে পারেন, সে অভিজ্ঞতা সবারই জানা। গোলরক্ষক আমিনুল যেন দলের পোস্টার। যাঁর প্রতি বিদেশি কোচদের মুগ্ধতা দেখেছি। ফুটবলের অন্ধকার গলিতেও যিনি ছড়াতেন আলো। বাংলাদেশ দল বিমানে উঠেছে, একই পোশাকে এতজনকে দেখে সাধারণ যাত্রীদের জিজ্ঞাসা, আপনারা কারা? কিন্তু আমিনুলকে ভাইকে দেখলেই বলে উঠতেন, ওহ ফুটবল দল। তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশের ফুটবলের শেষ বড় তারকা।

১৯৯৮ থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত গোলপোস্টের নিচে রাজত্ব করেছেন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের তিনটি বড় ট্রফির দুটির (২০০৩ সাফ ও ২০১০ এসএ গেমস) বিজয়ী দলেরই গোলরক্ষক ছিলেন তিনিই। বিদেশি কোচেরা নিয়মিত বলতেন, জন্মটা অন্য দেশে হলে খেলতে পারতেন বিদেশের বড় লিগে। সবকিছু ঠিক থাকলে খেলতে পারতেন সৌদি আরবের আল হেলাল ক্লাবেও। কিংবা অবসর নিতে পারতেন ইউরোপের কোনো ক্লাব থেকে। কিন্তু যোগাযোগের অভাবে আমিনুলের মতো প্রতিভার সে সুযোগ হয়নি।

আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা পা রেখেছে ৩৮-এ। ক্রিকেটার মাশরাফির জন্মদিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বাসের অভাব নেই। একই প্রজন্ম কি জানে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষকের জন্মদিনটাও আজই। ১৯৮০ সালের ৫ অক্টোবর ভোলায় জন্মগ্রহণ করা মানুষটির আজ ৩৯তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, অধিনায়ক।