জামাল ভূঁইয়া এখন পুরো 'বাংলাদেশি'

সব বাধা পেরিয়ে জামাল ভূঁইয়া হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের। ছবি: সৌরভ দাশ
সব বাধা পেরিয়ে জামাল ভূঁইয়া হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের। ছবি: সৌরভ দাশ
>ডেনমার্কে জন্ম, বেড়ে ওঠা। এ কারণেই তাঁর পক্ষে বাংলাদেশে মানিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু জামাল ভূঁইয়া জয় করেছেন সব বাধা।

আন্তর্জাতিক ম্যাচের দিন সংবাদমাধ্যম থেকে দূরে থাকেন ফুটবলাররা। কিন্তু শেখ কামাল কাপ কাপে তা নয়। সেই দলে আছেন এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে আলোচিত ফুটবলার জামাল ভূঁইয়াও। বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক শেখ কামাল টুর্নামেন্টে স্বাগতিক চট্টগ্রাম আবাহনীর অধিনায়ক। সাইফ স্পোর্টিং থেকে তাঁকে ধারে নিয়েছে চট্টগ্রাম আবাহনী। কাল সন্ধ্যায় মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টসের মুখোমুখি হওয়ার আগে দুপুরে স্বাগতিক দলের অধিনায়ককে পাওয়া গেল আগ্রাবাদ হোটেলের লবিতে। চট্টগ্রাম আবাহনীর নীল-হলুদ টি-শার্ট গায়ে। একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে জামালকে। জাতীয় দল, ক্লাব, অনুশীলন, ম্যাচ-দম ফেলার ফুরসত যেন নেই।

জামাল অবশ্য বলেন, ‘এটা এমন কিছু নয়। পেশাদার ফুটবলে ব্যস্ত সময়ই কাটাতে হবে আপনাকে। কাজেই মানিয়ে নিতে চাই সব সময়।’ কিন্তু সত্যিই কি মানিয়ে নিতে পারছেন? তাঁর জন্ম ডেনমার্কের আধুনিক অগ্রসর সমাজে। বেড়ে ওঠা কোপেনহেগেনের অলিগলিতে। সেখানে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলে আজকের এই জায়গায়। অনেকে বলেন, জামাল বিদেশি। পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ তো কী, জামালের নাগরিকত্ব ডেনিশও। বাংলাদেশের জল, হাওয়া, খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে মানিতে নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ নয়।

জাতীয় দলের সতীর্থদের অনেকেই শুরুর দিকে তাঁকে মন থেকে স্বাগত জানাননি। তাঁরা মনে করতেন, এ তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। জাতীয় দলে শুরু ২০১৩ সালে। ২০১৫ কেরালা সাফে কাছ থেকে দেখা গিয়েছিল জামালের অসহায়ত্ব। রুমমেট ডিফেন্ডার আতিকুর রহমান মিশু ছিলেন তাঁর খুব কাছের। দেখা যেত এই দুজন অন্যদের থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। জামাল অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারতেন না। দলের মধ্যে ফিসফাস চলত। কেউ কেউ বাঁকা চোখেও তাকাতেন।

সেই জামাল দেশের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার শুরু থেকেই। ২০১৪ সালের এক তালিকায় তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার নবম সেরা খেলোয়াড় বলা হয়েছিল। জাতীয় দলের সাবেক কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের তকমা দেন জামালকে। ২০১৪ সালে শেখ জামালের জার্সিতে ভুটানের কিংস কাপ ও বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু কাপের সেরা খেলোয়াড় এই জামাল। ‘পরদেশি’ জামাল এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রাণভোমরা। গত বছর জাকার্তা এশিয়ান গেমসে কাতারকে হারাতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের জয়সূচক একমাত্র গোলটি তাঁরই। কদিন আগে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে লাল-সবুজের দল এগিয়ে গিয়েছে সাদ উদ্দীনের দারুণ এক হেডের গোলে। কলকাতার মাটিতে যে গোলটির কারিগরও জামাল ভূঁইয়া। তাঁর অসাধারণ ফ্রি-কিকে ফ্লাইট মিস করেন ভারতের গোলরক্ষক।

কিন্তু মাঠের বাইরে কতটা বাংলাদেশি হতে পারলেন, এই প্রশ্নে জামাল হেসে বলেন, ‘আমি তো এখন পুরোপুরিই বাংলাদেশি। আমি এ দেশে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছি।’ পরক্ষণে মেসুত ওজিলের উদাহরণ টানেন। তুরস্ক বংশোদ্ভূত ওজিল জার্মানি হয়ে খেলেছেন মনপ্রাণ ঢেলে। জামাল বলেন, ‘ওজিলরাও মানিয়ে নিয়েছে জাতীয় দলের সঙ্গে। এটা কোনো সমস্যা নয়।’

জামাল মানুষ হিসেবেও ভালো। কারও সঙ্গে দুকথায় জড়ান না। চুপচাপ স্বভাবের। বাংলাদেশের ফুটবলাররা বছর বছর ক্লাব পাল্টান। বেশি বেশি টাকা চান। জামাল এই অস্থিরতার রোগী নন। সাইফ স্পোর্টিংয়ে এবারও থেকে গেছেন। দলটির সঙ্গে তাঁর চুক্তিও কিছুটা আলাদা। মাসে ৫ লাখ টাকা করে নেবেন।

তবে টাকা নয়। জামালের জীবনের পাতায় এখন শুধুই লেখা হচ্ছে লাল-সবুজের গল্প। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বুঝতেন না। ম্যাচের আগে ঠোঁট মিলিয়ে মানুষকে বোঝাতেন না, ‘আমি পারি’। তবে এখন অনেকটা শিখে ফেলেছেন। ঠোঁট মেলান। জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা আরও গাঢ় হয়েছে। নিজেই বলেন, ‘আমার জন্ম ডেনমার্কে হতে পারে। কিন্তু আমি এই মাটিরই ছেলে। আমার পরিবার এখানকারই। আমি নিজেকে একজন খাঁটি বাংলাদেশিই ভাবি।’

এ কারণেই পরিবার যখন বলে ডেনমার্কে ফিরে যেতে, বিয়ে করে থিতু হতে, জামাল কিছু বলেন না। খেলায় মন দেন। নতুন মোহনায় তিনি মিশে গেছেন। সতীর্থদের উজ্জীবিত করেন। ২৯ বছর বয়সের জামাল কখনো চ্যালেঞ্জ নিতে ভয়ে পান না। চট্টগ্রামের মাটিতে বসে বছর তিনেক আগে এই প্রতিবেদককে জামাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চ্যালেঞ্জে না জিতলে জীবনে কিছু আসে না। বলেছিলেন, ডেনমার্কে তাঁদের এলাকাটা ভালো ছিল না। নেশার রাজ্য ছিল। সেখানেই জামাল বড় হয়েছেন সব একপাশে রেখে ফুটবলকে জীবনের পাথেয় মেনে।

জামাল ভূঁইয়া মানে লড়াই। হার না-মানা। বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলতে ইউরোপ থেকে অনেকেই এসে জায়গা করে নিতে পারেননি। জামাল টিকে রইলেন প্রবলভাবে। জাতীয় বা ক্লাব কোচ জানেন মাঠে দলটাকে ভালো নেতৃত্ব দিতে পারবেন জামাল। তাঁর প্রতি কোচের আস্থা আর বিশ্বাস বাড়ছে। এ কারণেই আজ তিনি জামাল ভূঁইয়া। বাংলাদেশ দল তাঁর নেতৃত্বে কাতার, ভারতের সঙ্গে দারুণ ফুটবল খেলে। তাই চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ মারুফুল হকও হোটেল লবিতে লোক পাঠিয়ে তাড়া দেন, ‘জামাল জলদি এসো, টিম মিটিং আছে।’ খেলা নিয়ে রণকৌশলে যোগ দিতে ছুটে যান জামাল ভূঁইয়া।