দেশিদের মূল্য নেই, ২০ গুণ পান বিদেশি কোচরা

কাল শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ১১ দফা দাবি পেশ করে ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন ক্রিকেটারেরা। ছবি: প্রথম আলো
কাল শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ১১ দফা দাবি পেশ করে ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন ক্রিকেটারেরা। ছবি: প্রথম আলো
>কাল ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে দেশি কোচদের সঙ্গে বিদেশি কোচদের বেতনবৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন তামিম ইকবাল। এ নিয়ে পেছনের কারণটা বললেন দেশের ক্রিকেটে শ্রদ্ধাভাজন কোচ নাজমুল আবেদীন

অভিযোগ বহু পুরোনো। কাল তা আবারও সামনে টেনে নিয়ে এলেন তামিম ইকবাল। ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়ার আগে বিসিবির কাছে ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করেন ক্রিকেটাররা। তার মধ্যে কোচ নিয়ে পুরোনো ইস্যুটা মনে করিয়ে দেন তামিম, ‘একজন স্থানীয় কোচের কথা যদি বলি, আমরা নিজেরাই বাংলাদেশি কোচদের তুলে ধরতে চাই না। বিদেশি কোচদের পেছনে যে টাকা ব্যয় করা হয়, তাতে আমাদের ২০ জন স্থানীয় কোচের বেতন হয়ে যায়!’

তামিমের মন্তব্যে বিপিএলের প্রসঙ্গে মনে পড়বে সবার আগে। এ টুর্নামেন্টে টম মুডি, ওয়াকার ইউনিস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, ডেভ হোয়াটমোর, ডিন জোনস, ল্যান্স ক্লুজনার, মিকি আর্থারের মতো নামীদামি কোচরা কাজ করে গেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, বিপিএলে সবচেয়ে সফল স্থানীয় কোচরাই। গত চার বিপিএলে শুধু মুডিই (২০১৭ বিপিএলে রংপুরের হয়ে) ফাইনালে উঠেছেন। বাকি সাত ফাইনালিস্টের সবাই স্থানীয় কোচ। স্থানীয় কোচদের এ সাফল্যের পরও কিন্তু তাঁরা উপেক্ষিত।

এ উপেক্ষা বিদেশি কোচদের সঙ্গে পারিশ্রমিক, সম্মান—যেকোনো তুলনায়। দেশি কোচদের যথাযথ সম্মান ও পারিশ্রমিক দেওয়ার দায়িত্ব যাঁদের, সেই বিসিবি-ই যেন এ ব্যাপারে ‘এক চোখে তেল আরেক চোখে নুন’ বেচছে! অথচ ঘরোয়া কোচদের তুলে আনার দায়িত্ব কিন্তু দেশেরই ক্রিকেট বোর্ডের। আদতে কী ঘটছে? ‘একটা সফরে দেখা গেল বাংলাদেশি কোচের অধীনে খেলোয়াড়েরা ভালো করেছেন। দেখা যাবে পরের সফরে ওই কোচকে আর রাখা হচ্ছে না’—বাস্তবতাটা কাল বলেই দিয়েছেন তামিম।

আর তামিমের এ কথার পেছনের কারণটা বললেন দেশের ক্রিকেটে শ্রদ্ধাভাজন কোচ নাজমুল আবেদীন। ১৪ বছর বিসিবির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পর এ মাসেই বোর্ড ছেড়েছেন তিনি। বিকেএসপির সাবেক এ কোচ লম্বা সময় কাজ করেছেন বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগে। গত এক যুগে পাইপলাইন সমৃদ্ধকরণে তাঁর অবদান তো আছেই। গত দুই বছরে বোর্ড তাঁর কাজের পরিধি ছোট করে ফেললেও সাফল্য পেয়েছেন। গত বছর মেয়েদের এশিয়া কাপ জয়ে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। দেশি কোচদের পদে পদে অবহেলার শিকার হওয়াটা তাই খুব কাছ থেকেই দেখেছেন নাজমুল আবেদীন।

সাকিবদের সঙ্গে নাজমুল আবেদীন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সাকিবদের সঙ্গে নাজমুল আবেদীন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রথম আলোর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপচারিতায় তামিমের মন্তব্যকে ‘সত্য’ বলেই মনে করছেন নাজমুল আবেদীন। তাঁর ভাষায়, ‘কথাটা সত্য। বিদেশি কোচেরা অনেক পারিশ্রমিক পেলেও দেশি কোচদের উন্নয়নে বোর্ডের কোনো ভূমিকা নেই।’ দেশি-বিদেশি কোচদের মধ্যে বৈষম্যের ধরনটাও বুঝিয়ে দিলেন তিনি। বিসিবির নানা বিভাগে কাজ করছেন এমন দেশি কোচদের সঙ্গে বিদেশি কোচদের পারিশ্রমিকের পার্থক্যটা নাকি ১৫: ১ কিংবা ২০:১!

অর্থাৎ বিদেশি কোচ ১৫ টাকা বেতন পেলে দেশি কোচ পান ১ টাকা। অথচ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোয় খেলোয়াড় তৈরিতে দেশি কোচদের অবদান অনস্বীকার্য। সাকিব-তামিমরা আজও খেলা নিয়ে কোনো কৌশলগত সমস্যায় পড়লে ছুটে যান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন কিংবা নাজমুল আবেদীনের কাছে। খেলোয়াড়দের কাছে দেশি কোচদের দাম আছে ঠিকই কিন্তু বিসিবির কাছে তাঁদের দামটা নাজমুল আবেদীনের ভাষায় এমন, ‘ বিসিবিতে কাজ করা দেশি কোচদের সঙ্গে বিদেশি কোচদের পারিশ্রমিকের তুলনা করলে সেটি হবে ১৫: ১ কিংবা ২০:১।’

বাংলাদেশ জাতীয় দলের বর্তমান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ট্যাক্স বা আয়কর বাদে মাসে পাচ্ছেন ১৫ হাজার ডলারের কাছাকাছি, টাকায় যেটি ১২ লাখ ৬৮ হাজার। আয়করসহ প্রোটিয়া কোচের বেতন দাঁড়ায় ১৮ হাজার ডলারের মতো। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে কোচদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন পেয়েছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। শ্রীলঙ্কান কোচ মাসে পেতেন ২৫ হাজার ৮০০ ডলার, টাকায় যেটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার। বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এসব অঙ্ক দেখে সংগত কারণেই একটা প্রশ্ন ওঠে। জাতীয় দলে কোচদের চুক্তি লোভনীয় অঙ্কের হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তুলনায় দেশি কোচেরা কত পাচ্ছেন? আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন বেশ কিছু কোচ রয়েছেন, উচ্চ পর্যায়ে যাঁদের অভিজ্ঞতা ১০-১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। তাঁদের সঙ্গে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের বোঝাপড়াও অসামান্য। বাকি সব প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। তাহলে এমন সব শ্রদ্ধাভাজন কোচরা এ পেশায় এত বছর কাটিয়ে প্রাপ্য সম্মান কিংবা সম্মানীটুকু পাচ্ছেন কি?

জবাব দিলেন নাজমুল আবেদীন, ‘আমার মনে হয় দেশি কোচদের নিয়ে বিসিবি সন্তুষ্ট না। অনেক কোচ আছেন যাঁরা ১০-১৫ বছর ধরে কাজ করছেন। এ সময়ের ব্যবধানে আর্থিকভাবে যে জায়গায় তাঁদের উঠে আসার কথা ছিল, তা হয়নি। আর্থিকভাবে বৈষম্যটা রয়েই গেছে। দেশি কোচদের নিয়ে বোর্ড উদার হতে পারেনি।’