এবার চলছে পাতানো ম্যাচের উৎসব

প্রথম ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে চলছে ম্যাচ পাতানোর উৎসব। ফাইল ছবি
প্রথম ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে চলছে ম্যাচ পাতানোর উৎসব। ফাইল ছবি
>এবারের ঘরোয়া ক্রিকেটে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ খুব বেশি শোনা যাচ্ছে না। তবে প্রথম ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে এবার চলছে পাতানো খেলার উৎসব!

প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে ২ নভেম্বর ছিল এক্সিওম ক্রিকেটার্সের সঙ্গে কাকরাইল বয়েজের ম্যাচ। বিকেএসপির ওই ম্যাচের পর সন্ধ্যায় কাকরাইল বয়েজের এক ক্রিকেটার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘ফার্স্ট ম্যাচ ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেট লিগ...আলহামদুলিল্লাহ।’ 

স্ট্যাটাসটি দেখে এবং তার নিচে অসংখ্য অভিনন্দনবার্তা পড়ে মনে হতেই পারে, তাঁর দল বুঝি জয় দিয়ে লিগ শুরু করেছে। কিন্তু মন্তব্যের ঘরে একজনের আচমকা প্রশ্ন, ‘ম্যাচ ছাড়লি কেন?’ অর্থাৎ ওই ক্রিকেটারের দল আসলে হেরেছে। জবাবে ক্রিকেটারটি সহজ-সরলভাবেই লিখে দিলেন, ‘ভাই, মুরাদ ভাই (কাকরাইল বয়েজের কর্মকর্তা) বলল বোর্ড থেকে কল দিছে ওনাকে ম্যাচ ছাড়ার জন্য। এর জন্য। ফুল ম্যাচ গেম খেললে আমরা উইন হতাম।’
তা নিজের দল হারার পরও কেন ওই ক্রিকেটার সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন? স্ট্যাটাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া স্কোরকার্ডের স্ক্রিনশটই বলে দিচ্ছে তা। ৪৯ তম ওভারের প্রথম বলে ২ উইকেটে হেরে যাওয়া ম্যাচটাতে তিনি নিজে যে গেছেন ফিফটির কাছাকাছি! কাল সন্ধ্যায় স্ট্যাটাসে উল্লেখিত ক্লাব কর্মকর্তা সোলাইমান মেহবুব এলাহীর (মুরাদ) কাছে মুঠোফোনে ম্যাচ ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘আমি তো এখন রাস্তায়’ বলে তিনি আর কথা বাড়াতে চাইলেন না।
২ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৩৩ মিনিটে দেওয়া ওই স্ট্যাটাস এবং এর নিচের মন্তব্যগুলো কাল রাতেও ফেসবুকে দেখা গেছে। ঢাকা লিগের অন্ধকার জগৎকে সামনে নিয়ে আসার মতো এ রকম স্ট্যাটাস, মন্তব্য, ভিডিও, ছবি গত মৌসুমেও কম আসেনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু এসব নিয়ে কারও ভাবতে বয়েই গেছে। আাসলে নিচের লিগগুলোতে এসব ঘটনা এখন এতটাই ডাল-ভাত যে ফেসবুকের দেয়ালে কেউ এ রকম চিকা মারলেও তা নিয়ে মাথা ঘামানোর লোক নেই। যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের সবকিছু গা সওয়া হয়ে গেছে। আর যাঁদের কলকাঠি নাড়ানোতে কলুষিত হচ্ছে ক্রিকেট, তাঁরা সবাই কচুপাতার মতো। কোনো সমালোচনাই গায়ে মাখেন না।
ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ একসঙ্গে চলছে এখন। তৃতীয় বিভাগের শুরুতেই ধ্রুব স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে ম্যাচে তিনটি নো বলকে কেন্দ্র করে ইয়ং পেগাসাস পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ তোলে। অধিনায়কের রিপোর্টে বিসিবির আম্পায়ার্স বিভাগকেও বিষয়টি লিখিতভাবে জানায় ক্লাবটি।
তবে এবার আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক এখন পর্যন্ত এটিই। বিসিবির একটি সূত্র অবশ্য দাবি করেছে, যে দু-একজন বোর্ড পরিচালকের নির্দেশে আম্পায়াররা বিভিন্ন ক্লাবের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতেন, আম্পায়ারদের সংস্থার দুই নেতাকে ডেকে তাঁরাই নাকি বলে দিয়েছেন, এবার যেন আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। সুষ্ঠু আম্পায়ারিং নিশ্চিত করতে মাঠগুলোতে ক্যামেরাও বসানো হয়েছে।
কিন্তু আম্পায়ারিং কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও দুই লিগেই চলছে পাতানো ম্যাচের ‘উৎসব’। এক্সিওম ক্রিকেটার্স আর কাকরাইল বয়েজের ম্যাচের কথা তো ওই ক্রিকেটার ফেসবুকেই বলে দিয়েছেন। অভিযোগ আছে, তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে ধ্রুব স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে গত পরশু বিকেএসপির ম্যাচটি ইচ্ছা করে হেরেছে ধানমন্ডি ক্রিকেট একাডেমি। মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়ে তারা ম্যাচ হারে ৪ উইকেটে। বেশ কয়েকজন নিয়মিত খেলোয়াড়কে বিশ্রাম দিয়ে এই ম্যাচে অনিয়মিতদের নিয়ে একাদশ সাজিয়েছিল ধানমন্ডির একাডেমি দল। একাডেমিরই একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের ওপর ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার চাপ ছিল। বিনিময়ে দেওয়া হয় সামনের কিছু ম্যাচে জেতানোর প্রতিশ্রুতি। তবে ক্লাব কর্মকর্তা তৈয়ব আফজালের বক্তব্য, ‘ও রকম কিছু হয়নি। আমাদের ব্যাটসম্যানরাই রান করছে না।’
লিগে এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচ খেলে পাওয়া দুটি জয়ই যাদের বিতর্কিত, সেই ধ্রুব স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে বিসিবির পরিচালক ও আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান সাইফুল আলম চৌধুরীর। কিন্তু কাল রাতে ফোন না ধরায় এ নিয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর সিসিডিএম প্রধান কাজী ইনাম আহমেদ বলেছেন, পাতানো ম্যাচ বা পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের কোনো অভিযোগই নাকি তাঁর কানে যায়নি।
কয়েক বছর ধরে হওয়া পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং এবং কিছু ক্লাবের পেশিশক্তি দিয়ে ম্যাচ জেতার সুবাদে পাতানো ম্যাচের চিত্রনাট্য লেখাটা এখন সহজ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ক্লাব একই সিন্ডিকেটের অংশ। কাজেই কোন ম্যাচে কে জিতবে, কে হারবে, সেটি ঠিক করে নিতে সমস্যা হচ্ছে না। যারা সিন্ডিকেটের বাইরে, তাদের দেওয়া হচ্ছে প্রলোভন অথবা চাপ। পাতানো ম্যাচ ঠেকানোর উপায় নেই লিগগুলোর প্লেয়িং কন্ডিশনেও।
তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য বিসিবির দুর্নীতি দমন বিধি আছে। সদিচ্ছা থাকলে সেটি প্রয়োগ করে পাতানো ম্যাচের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু সেটার জন্যও তো সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন লোকবল থাকতে হবে বিসিবিতে!
বিবিবির প্রশিক্ষিত দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা মাত্র একজন। প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ ও প্রথম শ্রেণির ম্যাচগুলোতে বিসিবির নিরাপত্তা বিভাগের কর্মীদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হলেও তা নামমাত্র। এ দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ বা জ্ঞান কিছুই নেই তাঁদের। থাকলেই-বা কী! নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দুই ক্লাব যদি আগেই জয়-পরাজয় ঠিক করে নেয়, সেখানে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য কার আছে?
আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগ যে ফিক্সিং নিয়ে কাজ করে, তাতে বেশির ভাগ সময় টাকাপয়সার লেনদেন থাকে। ঢাকার ক্রিকেটের পাতানো ম্যাচ সে রকম নয়। এখানে ম্যাচ ছাড়া হয় ক্লাবগুলোর পারস্পরিক স্বার্থে এবং ক্ষমতার দাপটের কাছে নতিস্বীকার করে। খেলোয়াড়েরাও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। এ-সংক্রান্ত নিয়মনীতিও জানা নেই তাঁদের। নিচের দিকের লিগগুলোর খেলোয়াড়দের পাতানো ম্যাচ বা ক্রিকেটের দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলার কোনো কার্যক্রমই যে নেই বিসিবির!
সাকিব আল হাসানের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও তা আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে না জানানোর মতো ভুল করে বসেছেন। ঘরোয়া লিগের ক্রিকেটারদের কথা তাই বাদই দিতে হয়। এর ভয়াবহতা তাঁরা বোঝেন না বলেই তো ফেসবুকের দেয়ালে ভেসে ওঠে অমন মন্তব্য!