আজ খেলাটা দেখুন খেলোয়াড়ি চোখে

সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ফ্রেমবন্দী বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সমর্থক। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁঝেও ক্রিকেটীয় বন্ধুত্বের প্রতীকী ছবি। ছবি: বিসিবি
সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ফ্রেমবন্দী বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সমর্থক। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁঝেও ক্রিকেটীয় বন্ধুত্বের প্রতীকী ছবি। ছবি: বিসিবি

ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতা সবশেষ দল অস্ট্রেলিয়া। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা জিতেছিল দুই ম্যাচের সিরিজ। তার আগে ভারতের মাটিতে অন্য কোনো দল সিরিজ জিতেছে পাক্কা চার বছর আগে। ২০১৫ সালে তিন ম্যাচ সিরিজের একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে। নিউজিল্যান্ড জিতেছিল সেই ২০১২ সালে। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের মাটিতে সিরিজ জেতা কত কঠিন। এ যেন সিংহের গুহায় ঢুকে গ্রাস কেড়ে নেওয়া। বাংলাদেশ দল এ কঠিন কাজেই অনেকটা এগিয়ে গেছে প্রথম ম্যাচটা জিতে। সমর্থকদের প্রত্যাশা তাই আকাশচুম্বী হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সমর্থকেরাই খেলাধুলার প্রাণ। তাঁদের একেকটি করতালি, একেকটি সমর্থন, খেলোয়াড়দের প্রেরণার জ্বালানি। গোস্তাকি মাফ করবেন, দিন যত যাচ্ছে সমর্থকেরা কিন্তু ততই বেগড়বাই হয়ে উঠছেন। এক কথায় সমর্থনের পথ দুটি—জিতলে ভাসাও প্রশংসায়। হারলে ডোবাও নিন্দায়। এর মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। প্রতিপক্ষ দল নিয়েও পথটা চরমপন্থীদের মতো। শুধু বিপক্ষে অবস্থান করলেই চলবে না, যৌক্তিক, অযৌক্তিকের সঙ্গে অশ্লীল, অমার্জনীয় কিংবা ক্রিকেটের বাইরের নানা বিষয় টেনে এনেও করা সমালোচনা এখন সমাদৃত হচ্ছে। এই তো যুগের হাওয়া!

হাওয়ার কথা উঠলে দিল্লির কথাও উঠবে। বায়ুদূষণের জন্য ভারতের এ শহরের খ্যাতি (!) বিশ্ব জোড়া। সেখানেই প্রথম ম্যাচটা খেলে জিতেছে বাংলাদেশ। কিন্তু খেলা শুরুর আগে ‘টক অব দা কান্ট্রি’ কিন্তু ক্রিকেট ছিল না। ওই তো বায়ুদূষণ। ভারতের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে, শেষ মুহূর্তে ম্যাচের ভেন্যু পাল্টানো সম্ভব না। যথাসম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে সহমর্মিতাও প্রকাশ করেছে প্রতিবেশী দেশটি। কিন্তু এ দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেট সমর্থকদের সম্ভবত তা চোখে পড়েনি।

মাহমুদউল্লাহদের কেন ওখানে খেলানো হয়েছে—সমর্থকদের এ প্রশ্ন অবশ্যই যৌক্তিক। কিন্তু তার সম্পূরক প্রশ্ন হিসেবে যখন সরকার ও বিসিবির ওপর দায় টানা হয় কিংবা যাচ্ছেতাই ভাবে ভারতের মুণ্ডুপাত চলে তখন? একবার ভাবুন তো এ দেশের রাজধানী ঢাকা ঘুরে যাওয়া সে দেশের কারও চোখে নিজের রাজধানী নিয়ে যা নয় তাই চোখে পড়লে কেমন লাগতে পারে? তিনি ভাবতে পারেন, ঢাকার বাতাস বোধ হয় বুড়িগঙ্গার টলটলে (!) পানির মতোই পরিষ্কার। চলমান মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ, নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর কারখানার ধোঁয়া মিরপুরের ‘হোম অব ক্রিকেট’-এর আকাশ সীমানায় নিশ্চয়ই ঢুকতে পারে না!

দুঁদে সমর্থক মাত্রই বলতে পারেন, এ বিষয়টি আসলে ‘ভাইস ভার্সা’। ওদেরও এমন সমর্থক কম নেই। ওখান থেকে ধেয়ে আসা তির খেলে কার সহ্য হয়! সে তো ঠিকই। আগুনের জবাব আগুন দিয়েই দিতে হয়। কিন্তু তখন খেলাটা আর ‘জেন্টেলম্যান গেম’ থাকে না। যত যাই ঘটুক দিন শেষে খেলা তো নির্মল বিনোদন ছাড়া আর কিছুই না। দল হারলে খেলোয়াড়দের মুণ্ডুপাত করা,পারিশ্রমিক নিয়ে প্রশ্ন তোলা, জনগণের করের টাকায় চলে এমন মিথ্যা খোঁটা দেওয়া—এসব একদিক বিচারে কিন্তু নিজ জীবনের ব্যর্থতার ক্ষোভই উগরে দেওয়া। নিশ্চয়ই মানতে পারছেন না?

আচ্ছা এ কথা তো সত্য, সমর্থকেরা ক্রিকেট দলকে প্রাণ দিয়েই ভালোবাসেন। দল জিতলে ‘আজ শান্তিমতো ঘুমোতে পারব’ কিংবা ‘ওদের জন্যই বেঁচে আছি’ ধরনের স্ট্যাটাস তো দলের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে রাখারই প্রতিচ্ছবি। তখন যদি প্রশ্ন করা হয়, জীবনে শত ব্যর্থতা ও তিল পরিমাণ সাফল্য নিয়ে আপনি কী নিজের আয়-উপার্জনে সন্তুষ্ট? সিংহভাগ মানুষের জবাব হবে ‘না’। তাহলে ক্রিকেটারদের আয় বাড়ানোর দাবিটা হারের পর অযৌক্তিক মনে হয় কেন?

খেলা শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়াটা কিন্তু খেলোয়াড়দেরও চোখে পড়ে। রক্ত-মাংসের মানুষ হওয়ায় ক্রিকেটের বাইরে ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা তাদেরও আছে। আর তাই হারের পর খেলোয়াড়দের জাত-ধর্ম টেনে বিভাজন করে দেওয়ার কষ্টটা তাঁরা এড়াতে পারেন না। কে জানে হয়তো মাঠের খেলাতেও তার প্রভাব পড়ে! অথচ এই ক্রিকেটারেরাই জাতীয় সংগীতের সময় যখন পাশাপাশি দাঁড়ান আর আমরা টিভি সেটের সামনে কল্পনায় তাদের পাশে দাঁড়াই তখন কোথায় থাকে এই বিভাজন? সমর্থকেরা কি তা ভুলে যান?

>বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি সরাসরি দেখুন www.prothomalo.com-এ

আজকের কথাই ধরুন। অসামান্য এক অর্জনের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। ভারতের মাটিতে প্রথম দল হিসেবে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের সুযোগ। তার আগের পটভূমিটা একবার ভেবে দেখুন। খেলোয়াড়দের ধর্মঘটে ভারত সিরিজে দল যাবে কি না তা নিয়েই অনিশ্চয়তা ছিল। তা মিটে যাওয়ার পর নিষিদ্ধ হলেন সাকিব আল হাসান। পারিবারিক কারণে যেতে পারলেন না তামিম ইকবাল। এ নিয়ে সমর্থকদের কত কথা কত রোষ! দোষ দেওয়া যায় না। প্রত্যাশা থাকলে এটুকু হবেই।

এরপর প্রায় ভাঙাচোরা একটা দল নিয়ে ভারতের মাটিতে প্রথম ম্যাচ জিতল দল। আজ সিরিজ বাঁচাতে ভারত মরিয়া হয়ে খেলবে সেটাই স্বাভাবিক। বড় দলের ‘ল অব অ্যাভারেজ’ ধরলে আজকের ম্যাচে বাংলাদেশের হারের সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু এই সম্ভাবনা আজ বাস্তবে পরিণত হলেও দৃশ্যটা কিন্তু পাল্টাবে না—জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারে যেমন সমালোচনা ভারতের বিপক্ষে হারেও তাই। সমর্থকেরা ভুলে যান পটভূমি, ভুলে যান তিনিও এই দলের ‘টুয়েলভথ ম্যান’। থুতু ছুড়লে তা কিন্তু নিজের গায়েই লাগে।

ইতিহাস বিচারে এ জাতি জনমদুঃখী বলেই হয়তো হিতাহিত বোধ কম। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের যুপকাষ্ঠ থেকে প্রায় কিছুই না পেতে পেতে ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস’-এর কাছে প্রত্যাশাটা বেশি হয়ে গেছে। আর তাই টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৯ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রশ্ন ওঠে—ক্রিকেট দেখার চোখটা কেমন হওয়া উচিত? সমর্থন-ই বা কেন হবে?

একটা সহজ জবাব হতে পারে, প্রত্যাশার ভার না চাপানোই নিরাপদ। কেননা, প্রত্যাশা না মিটলেই কষ্ট। হ্যাঁ, প্রত্যাশা থাকবে না তা নয় কিন্তু পূরণ না হলে ‘ওরা আমাদেরই ছেলেপুলে’ কথাটা ভুলে না গেলেই চলবে। সত্যি বলতে সত্যিকারের সমর্থক প্রত্যাশা করেন খুব কমই। তাঁরা খেলাটা দেখতে ভালোবাসেন, প্রিয় দল জিতলে ভালো না জিতলেও ক্ষতি নেই। কষ্ট যে পান না তা নয়, কিন্তু সে কষ্টকে নিকৃষ্ট ক্ষোভ বানিয়ে খেলোয়াড়দের জাত-ধর্ম আর পারিশ্রমিক নিয়ে টানাটানির বদঅভ্যাস তাঁদের নেই। খেলাটাকে তাঁরা খেলার জায়গাতেই রাখেন।

এবার আপনিই ঠিক করুন, আজকের খেলাটা কোন চোখে দেখবেন? টিভি সেটের সামনে বসে দয়া করে ‘এক চোখে তেল আর এক চোখে নুন’ নয় বরং দুটি চোখেই নিঃশর্ত সমর্থনের ফুল ফোটান। সৌরভ আসবেই।
আরও পড়ুন: 
কেমন হবে আজ বাংলাদেশের একাদশ
দারুণ কীর্তির সামনে বাংলাদেশ আর মাহমুদউল্লাহ