'বাংলাদেশের অনেক কিছুই আছে, বিক্রি করতে পারছে না'

মুশফিকুর রহিমের মধ্যে লড়াইয়ের খিদেটা দেখেন দীপ দাশগুপ্ত। ছবি: এএফপি
মুশফিকুর রহিমের মধ্যে লড়াইয়ের খিদেটা দেখেন দীপ দাশগুপ্ত। ছবি: এএফপি
ইন্দোর টেস্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে দীপ দাশ গুপ্ত ভীষণ হতাশ। একজন বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি সাবেক এ ভারতীয় ওপেনার একটু আলাদা টান অনুভব করেন। আজ দুপুরে যখন দীপ দাশ গুপ্তের সঙ্গে কথা হলো, ক্ষুরধার ক্রিকেট বিশ্লেষণীতে মুশফিকদের পারফরম্যান্স তুলে তো ধরলেনই, বাংলাদেশ দলের ঘাটতি-সম্ভাবনাও উঠে এল তাঁর কথায়


ইন্দোর টেস্ট বাংলাদেশ হেরে গেছে তিন দিনেই। ভারতের মাটিতে ভীষণ শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে টেস্ট জিতে যাবে বা ড্র করে ফেলবে—এটা ভাবা কঠিন হলেও টি-টোয়েন্টি সিরিজের মতো লাল বলেও বাংলাদেশ ভালো লড়াই করবে, এমনই প্রত্যাশিত ছিল। দুই ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কেন ভারতীয় বোলিংয়ের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন, দলের রক্ষণাত্মক কৌশল কতটা উপযুক্ত ছিল এই টেস্টে, কলকাতায় দিবারাত্রির টেস্টে বাংলাদেশের সম্ভাবনা সবই উঠে এল ধারাভাষ্যকার দীপ দাশ গুপ্তের বিশ্লেষণে—

 ঘাটতি যেখানে

‘বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে যদি বলতে হয়, আমি খুব হতাশ। গত দুই-তিন বছর ধরে বাংলাদেশ দলকে খুব ভালোভাবে অনুসরণ করছি। আমরা যেটা মনে হয় প্রতিভার কোথাও ঘাটতি নেই। এই দলে অনেক প্রতিভার ছড়াছড়ি। খারাপ লাগে যে আমরা লড়তে পারি, জিততে পারি—বিশ্বাসে ঘাটতি রয়ে গেছে। লিটন (দাস), সৌম্য (সরকার), টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত খেলল যে ছেলেটা নাঈম (শেখ)—প্রতিভা আছে। ওই বিশ্বাসটা কখনো কখনো মেহেদীর (মিরাজ) মধ্যে দেখি। মুশফিকের মধ্যে তো দেখিই। ওর মনোভাব খেলে যাব, লড়ে যাব। বাকিদের মধ্যে লড়াই করার ব্যাপারটা কখনো মনে হয় অনেক ঘাটতি আছে। এ কারণে মুশফিককে আমার খুব ভালো লাগে। ওর মধ্যে লড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আছে।’


মুশফিকের ব্যাটিং পজিশন
‘আমার মনে হয় মুশফিক চার, লিটন পাঁচ, মিঠুন আরেকটু পেছনে খেলতে পারে। মিঠুন মেরেও খেলতে পারে। দ্বিতীয় নতুন বল না হয় মিঠুন খেলুক। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা স্পিন খুব ভালো খেলে। পুরো সিরিজে মনে হয়েছে মুশফিক আর লিটন সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেছে ভারতীয় বোলারদের বিপক্ষে। যদি তাই হয়, চার-পাঁচে এ দুজন খেলতে পারে। মাহমুদউল্লাহ আরেকটু পেছনে আসতে পারে।’

চার বোলার নিয়ে খেলা
‘প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের চার বোলার নিয়ে খেলার অর্থটা বুঝতে পারিনি। বাংলাদেশের কৌশল আমার একটু এলোমেলো লেগেছে। প্রথম ইনিংসে মেহেদীকে নিয়ে এল ৩৬ ওভার পরে—এটার সঙ্গে একমত নই। কাল লিটন-মুশফিক যখন ভালো খেলছিল, তখন ভারতীয় বোলাররা কী করল? তারা ঠিক করল, উইকেট নেব না, ডট বল করব। লিটন যখন আউট হয়েছে তার আগে ৫-৬ ওভারে ৫-৬ রানের মতো হয়েছে। যখন রান হচ্ছিল না তখন লিটন ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে খেলতে গিয়ে আউট হয়েছে। এখানে দুটো উপায় আছে: প্রথমত, উইকেট নেব। আর উইকেট না পেলে রান দেব না। তাইজুল-মেহেদী ওভারে প্রায় চার বা চারের ওপরে রান দিয়েছে। এখানে বুঝতে হবে, হ্যাঁ, সব সময় উইকেট পাব না। উইকেট পাওয়া কঠিন হলে রান দেব না। ব্যাটসম্যান যদি ঝুঁকি নিয়ে মারে, মারুক। ঝুঁকি নিলে আউট হতেও পারে। আপনার হাতে যদি অপশন না থাকে কী করা যাবে? যা আছে তাই দিয়ে ব্যাটসম্যানদের আউট তো করতে হবে। এখানে বাংলাদেশ কেন এসেছে? জিততে? জিততে হলে তো ২০টা উইকেট নিতে হবে। সেই ২০ উইকেট নিতে হলে আপনাকে সেভাবে বোলার নিতে হবে। আর যদি কোচের (রাসেল ডমিঙ্গো) বক্তব্য হয় যে আমার হাতে ৪৫-৫০ গড়ের ব্যাটসম্যান নেই, এ কারণে অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান নিয়েছি, সেটি দলে কী বার্তা দিচ্ছে? বার্তাটা তো নেতিবাচক। খেলোয়াড়েরা ভাবছে, আমাদের ওপর কোচের কোনো ভরসা নেই!’

ভারতের সাবেক বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার দীপ দাপগুপ্ত। ছবি: এএফপি
ভারতের সাবেক বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার দীপ দাপগুপ্ত। ছবি: এএফপি

কলকাতায় বড় পরীক্ষা

‘অন্যভাবে দেখুন। সবাই সুইং নিয়ে ভাবছে। ভাবছে বাংলাদেশ আরও বিপাকে পড়বে। গ্লাসের অর্ধেক খালি না দেখে অর্ধেক পূর্ণ জলটাও দেখুন না! অসুবিধা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদেরও হবে। অন্যের দুর্বলতা কীভাবে কাজে লাগাবে, সেটাও দেখুন। আবু জায়েদ দারুণ বোলার। ওর বলেও সুইং হবে। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সমস্যা হবে। আমার ধারণা এটা লো স্কোরিং ম্যাচ হবে। দুই বছর আগে দেখুন ভারত দেশের বাইরে তখনই জিতেছে যখন সবুজ উইকেট পেয়েছে। মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের পেস আক্রমণের চেয়ে ভারতীয় পেস আক্রমণ অনেক এগিয়ে, এটা সত্যি। কিন্তু সবুজ উইকেটে দুই দলের পার্থক্য কমে যায়। এখানে শামি যেমন বল মুভ করিয়েছে, ওখানেও করাবে। এবাদতের এখানে যেটা হচ্ছিল না সেটা ওখানে হতে পারে। দুই দল একই বিন্দু থেকে শুরু করবে। পার্থক্য যেটা আছে সেটা অনেকটা কমে যাবে।’

বাংলাদেশ পারবে ১-১ করতে?
‘এটাই বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত,১-১ করে দেশে ফেরা। ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে আমরা দেখতে চাইব লড়াই হোক। যেই জিতুক, লড়াইটা যেন হয়। একপেশে টেস্ট যেন হয়। টেস্ট ক্রিকেটের জন্য এটা খুব দরকার। গোলাপি বল কিংবা দিবারাত্রির হোক, জমজমাট একটা টেস্ট চাই। আমরা কেন অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের টেস্ট দেখি, ম্যাচ খুব জমজমাট হয়, খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ভারতকে ভারতে হারানো খুব কঠিন। তার মানে তো এই নয় যে খেলার আগে মনে করব পারব না! খেলতে হবে জেতার জন্যই। জিতি না জিতি সেটা পরের বিষয়।’

যা করতে হবে
‘বাংলাদেশের কয়েকজনকে আমার খুব ভালো লাগে। সবার আগে বলতে হবে মুশফিকের নাম। ওর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। ওকে কিন্তু প্রতিপক্ষ খুব একটা পছন্দ করে না! কেন করে না, জানেন? মাঠের লড়াইয়ে সে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। এ রকম খেলোয়াড় দরকার। এ ধরনের খেলোয়াড়কে বেশি পছন্দ করি। এখানে খেলতে এসেছি, জিততে এসেছি। বন্ধুত্ব করতে আসিনি! যদি প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা হয়, হোক না! এই মানসিকতা দরকার, সামনে যতই বড় প্রতিপক্ষ হোক, যত শক্তিশালী দল হোক। বিরাটকে (কোহলি) বাংলাদেশের বোলার শূন্য রানে আউট করেছে। এত বড় ব্যাটসম্যানকে যদি শূন্য রানে আউট করা যায় বাকিদের কেন পারবে না? গত পাঁচ-ছয় বছরে বাংলাদেশ দলে প্রতিভার ঘাটতি দেখিনি। অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার এসেছে। কিন্তু এরা পরবর্তী ধাপে কেন যেতে পারছে না? যাবে বিশ্বাস থেকে। বিশ্বাস কোথা থেকে আসবে? আশপাশের লোকজন থেকেই আসবে। যদি আপনার সম্পাদক আপনাকে বলে তোমার ওপর ভরসা নেই। আপনার আত্মবিশ্বাসটা আসবে কোত্থেকে শুনি? যদি এমন হতো আমার কিছু নেই, বিক্রি করতে পারছি না। বাংলাদেশের গোডাউনে তো অনেক কিছুই আছে। শুধু বিক্রি করতে পারছে না! এখানেই বিশ্বাসটা দরকার। কোচিং স্টাফ বাইরে যে বার্তা দেয়, এটা তো সবাই শুনছে। খেলোয়াড়েরা মনে করছে তাদের ওপর আস্থা নেই! দুই ভাবে আপনি তাদের এগিয়ে নিতে পারেন—ডান্ডা মেরে আরেকটা হাত বুলিয়ে। ডান্ডা মেরে যখন এত বছরে হয়নি, একটু হাত বুলিয়ে দেখুন না!’