৮০ বছর আগেই 'টি-টোয়েন্টি' খেলতেন এই ভারত-কিংবদন্তি

সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার সৈয়দ মুশতাক আলী। ছবি: সংগৃহীত
সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার সৈয়দ মুশতাক আলী। ছবি: সংগৃহীত
>ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি। টি-টোয়েন্টি সংস্করণের এই টুর্নামেন্টটি যার নামে, সেই সৈয়দ মুশতাক আলী ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক কিংবদন্তি ক্রিকেটার। ৭০-৮০ বছর আগেই তিনি টি-টোয়েন্টি স্টাইলে ব্যাটিং করতেন।

ভারতে এখন চলছে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট ‘সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি’। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে টুর্নামেন্টটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, যে আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা না থাকলে ভারতের প্রায় সব তারকা ক্রিকেটারই এটি খেলেন। লেখাটা আসলে ভারতের এই ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট নিয়ে নয়;  টুর্নামেন্টটি যার নামে, সেই সৈয়দ মুশতাক আলীকে নিয়ে।

একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের নাম সৈয়দ মুশতাক আলীর নামে কেন—এই প্রশ্নটা মনে আসতেই পারে। মুশতাক আলী টেস্ট খেলেছেন ৭০-৮০ বছর আগে, তাও ‘টাইমলেস’ যুগে। এটা তো সবাই জানেন, একটা সময় ছিল যখন টেস্ট ম্যাচের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত দুই দল খেলতেই থাকত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে যুগেই মুশতাক আলী টেস্টে ব্যাটিং করতেন আজকের টি-টোয়েন্টি স্টাইলে।

আজ টি-টোয়েন্টিতে যে সব উদ্ভাবনী শট খেলেন ব্যাটসম্যানরা, স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটান, সৈয়দ মুশতাক সেটি খেলেছেন ৭০-৮০ বছর আগেই। তাঁর বিস্ফোরক ব্যাটিং এখানকার মতো আচ্ছাদনে ঢাকা, ব্যাটিং উপযোগী উইকেটে হয়নি। তিনি ব্যাটিংয়ের সময় হেলমেট পাননি। প্যাড, গ্লাভসও আজকের মতো ব্যাটসম্যানদের হাত-পায়ের সুরক্ষা দিত না। ওই সময় তিনি ডাউন দ্য উইকেটে এসে বোলারদের তুলোধুনো করতেন। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী করে বিদেশের মাটিতে এই মুশতাক আলীই প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে তিনি করেছিলেন ১১২। দ্বিতীয় ইনিংসে বিজয় মার্চেন্টের সঙ্গে ওপেনিং জুটিতে ২৩১ রানের জুটি গড়েছিলেন ২০৩ মিনিটে। ভারতীয় এ কিংবদন্তির জন্ম ইন্দোরে। তাঁর শেকড় সন্ধানেই কাল সন্ধ্যাটা কাটল শহরের শালিমার পামস আবাসিক এলাকায়।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন মুশতাক আলীর দারুণ বন্ধু। তিনি মুশতাককে পাকিস্তানে চলে আসতে বলেছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন মুশতাক আলীর দারুণ বন্ধু। তিনি মুশতাককে পাকিস্তানে চলে আসতে বলেছিলেন। ছবি: সংগৃহীত

মুশতাকের শিকড়
১৯১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইন্দোরে জন্ম নেওয়া সৈয়দ মুশতাক মারা গেছেন ২০০৫ সালের ১৮ জুন। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে পাওয়া গেল একমাত্র পুত্র ৭১ বছর বয়সী গুলরেজ আলীকে, যিনি নিজেও মধ্যপ্রদেশের হয়ে খেলেছেন ৭৪টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। গুলরেজের ছেলে সৈয়দ আব্বাস আলী খেলেছেন ১১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। শালিমার পামস আবাসিক এলাকার গুলরেজের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই চোখে পড়ল বড় একটা ট্রফি—১৯৯৫ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) আজীবন সম্মাননা দিয়েছিল মুশতাক আলীকে। গুলরেজ জানালেন, তাঁদের পুরোনো বাড়ি পুরোনো ইন্দোর স্টেডিয়ামে কাছে। সাত বছর হলো নতুন ঠিকানায় উঠেছেন।

ভীষণ আলাপী, হাস্যোজ্জ্বল গুলরেজ প্রথম শোনালেন তাঁর কিংবদন্তি বাবার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প, ‘১৯২৬ সালে ইন্দোরের রাজা ছিলেন হোলকার, তিনি ক্রিকেট খুব পছন্দ করতেন। তিনি কর্নেল সি কে নাইডু (ভারতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক) অন্ধ্র প্রদেশ থেকে নিয়ে আসেন ইন্দোরে। ইন্দোরে আমাদের বাসার কাছেই থাকতেন নাইডু। আমার বাবার (মুশতাক আলী) বয়স ১৪ হবে তখন। বাসার পাশের মাঠে খেলতেন। নাইডু সাহেবের একটি মোটরসাইকেল ছিল। বাইকে যাওয়ার সময় যেখানেই বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলতে দেখতেন সেখানে থামতেন। তাঁর চোখে আমার বাবার খেলা ভীষণ ভালো লেগে যায়। তিনি একদিন আমার দাদাকে অনুরোধ করেন যে বাবাকে হায়দরাবাদে নিয়ে যাবেন। আমার দাদা রাজি হয়ে যান। দাদা রাজি হয়েছিলেন বলেই মুশতাক আলীকে পেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট।’

মুশতাকের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের রহস্য
বাবার কাছে শুনতে শুনতে গল্পগুলো যেন গুলরেজের মুখস্থ! ঘরের বাইরের মানুষ কেন, গুলরেজ অনেকবারই বিস্ময়ভরা চোখে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তোমার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের রহস্য কী?’ মুশতাক হেসে তাঁকে জবাব দিয়েছেন, ‘প্রথমত, আমার পায়ের কাজ। দ্বিতীয়ত আমার দৃষ্টি, তৃতীয়ত রিফ্লেক্স। বোলার বল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতাম মারতে।’

সে সময় অনেক সময় বোলাররা বিরক্ত হয়ে বল না করে থেমে যেতেন! তবুও মুশতাক তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরন বদলাতেন না। ফাস্ট বোলাররা রেগেমেগে অনেক সময় মাথা-পাঁজর বরাবর বল ছুঁড়তেন। পাল্টা জবাব হিসেবে তিনি হুক, পুল করতেন। সেঞ্চুরির কাছে এসেও তিনি তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরন বদলাতেন না। টানা তিন চার মেরে সেঞ্চুরি করার কত যে উদাহরণ আছে মুশতাকের!

সৈয়দ মুশতাক আলীর ছেলে গুলরেজ আলী। তিনিও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। ছবি: প্রথম আলো
সৈয়দ মুশতাক আলীর ছেলে গুলরেজ আলী। তিনিও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। ছবি: প্রথম আলো

‘নো মুশতাক, নো ক্রিকেট’
মুশতাকের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের পেছনে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। তিনি সব সময় বলতেন, ‘মাঠে আমাদের খেলা দেখতে দর্শকেরা আসে। তাদের যদি আনন্দই দিতে না পারি তাহলে কেন তারা মাঠে আসবে? দর্শক ছাড়া ক্রিকেটার কিংবা ক্রিকেট বোর্ডের কোনো মূল্য নেই! ’
মুশতাকের আলাদা একটা জনপ্রিয়তা ছিল কলকাতায়। তিনি কলকাতায় খেলতে আসা মানেই গ্যালারিতে দর্শকের ঢল। খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সন্ধ্যা পর্যন্ত সই-শিকারিদের আবদার মেটাতেন। দিলীপ সিং (যাঁর নামে ভারতের দিলীপ ট্রফি) তখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচক। দিলীপ একবার মুশতাককে দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন। ভারতীয় দল যখন মুশতাককে ছাড়া কলকাতায় খেলতে গেল, দিলীপকে পড়তে হলো মানুষের রোষানলে। কলকাতায় স্লোগান উঠল—‘নো মুশতাক, নো ক্রিকেট! ’ এখনো মুশতাকের প্রতি আলাদা ভালোবাসা কাজ করে কলকাতার মানুষের। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে মুশতাকের কাছে কোচিং করেছেন সৌরভ গাঙ্গুলীও।

ভুট্টোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন মুশতাকের ছোটবেলার বন্ধু। জুলফিকার ভুট্টো দুবার মুশতাককে প্রস্তাব দিয়েছিলেন পাকিস্তানে চলে আসতে। প্রথমবার ১৯৪৭ সালে, দেশভাগের সময়। দ্বিতীয়বার ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। গুলরেজ জানালেন, মুশতাক দুবারই বন্ধুর প্রস্তাবে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। জুলফিকারকে মুশতাক বলতেন, ‘ভারতে যে সম্মান পেয়েছি পাকিস্তানে গেলে তা কোনো দিন পাব না। তোমার ওখানে বেড়াতে যেতে পারি। কিন্তু ভারত ছাড়ার কথা কোনো দিন বলবে না।’

ভারতীয় ক্রিকেট আসলেই ভীষণ সম্মান দিয়েছে সৈয়দ মুশতাক আলীকে। গুরুত্বপূর্ণ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টটি তাঁর নামে। ইন্দোরের হোলকার স্টেডিয়ামের একটি গ্যালারি তাঁর নামে। বিসিসিআই আজীবন সম্মাননা দিয়েছে। গুলরেজ যখন পারিবারিক ছবির অ্যালবাম বের করে বাবার নানা স্মৃতি দেখাতে থাকেন, মনে হয় এ ক্রিকেট কিংবদন্তিকে ভালোভাবেই মনে রেখেছে ভারত।