পেলে বনাম অ্যাপোলো-১২, জয় হয়েছিল কার

>
তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার তাঁর ক্যারিয়ারে ১ হাজার ২৮১টি গোল করেছেন। হাজারতম গোলটি তিনি করেছিলেন ৫০ বছর আগে, ১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত স্টেডিয়াম মারাকানায়। ফাইল ছবি

ব্রাজিলের মানুষ তখন রেডিওতে দুটি খবরেই শুধু কান পাতছিল—পেশাদার ফুটবলে পেলের ১ হাজার তম গোলের অপেক্ষা ফুরাবে কবে আর মানুষের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান সফল হবে কি না! সময়টা ১৯৬৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর। প্রায় প্রতিদিনই পেলের গোল গুনে যাচ্ছিলেন ফুটবল পাগল ব্রাজিলের মানুষ। পেলে তখন ১ হাজার গোলের মাইলফলক ছোঁয়া থেকে ডজন খানিক গোল দূরে। আর নভোচারী চার্লস কনার্ড, অ্যালান বিন ও রিচার্ড গর্ডনকে বহনকারী মহাকাশযান অ্যাপেলো-১২ ক্ষণ গুনছিল চাঁদের উদ্দেশে উড্ডয়নের। 

১৫ অক্টোবর পর্তুগিজা ডি ডেস্পোর্তের বিপক্ষে সান্তোসের ৬-২ গোলের জয়ে একাই ৪ গোল করেছেন পেলে। তাঁর গোলসংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯৩টি। এরপর করিচিবার বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। ফ্লুমিনেন্সের বিপক্ষে গোল না পেলেও পরের ম্যাচে ফ্ল্যামেঙ্গোর বিপক্ষে বল জালে পাঠিয়েছেন একবার। এরপর আবার বিস্ময়করভাবে দুই ম্যাচে গোলহীন ছিলেন পেলে। ৯৯৬ গোল নিয়ে নভেম্বর মাস শুরু করেন তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার। ১২ নভেম্বর জোড়া গোল করেন পেলে। দুদিন পর ১৪ নভেম্বর পারাবিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করে নিজের গোলসংখ্যা নিয়ে যান ৯৯৯তে। সেদিনই অ্যাপোলো-১২ তিন নভোচারীকে নিয়ে চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।

১৪ নভেম্বরই পারাবিয়ার বিপক্ষে ১ হাজারতম গোলটি পেয়ে যেতে পারতেন পেলে। কিন্তু অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে যায়। চোটে পড়েন সান্তোসের গোলরক্ষক। অপেক্ষমাণ ভক্তদের হতাশ করে গোলপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পড়েন পেলে। পরে জানা গেছে পেলে যেন তাঁর মাইলফলকের গোলটি পারাবিয়ার মাঠে না করে ব্রাজিলের বিখ্যাত মাঠ মারাকানায় করতে পারেন তার জন্য চোটের নাটক সাজিয়ে ছিলেন সান্তোসের কোচ।

সুযোগ এসেছিল ১৮ নভেম্বরও বাহিয়ার বিপক্ষে ম্যাচেও। কিন্তু সেটি লিগ ম্যাচ ছিল না, ছিল প্রীতি ম্যাচ। তাই পেলে ইচ্ছে করেই সেই ম্যাচে গোল করেননি। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি চেয়েছিলেন ১০০০তম গোলটি কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে করতে। বাহিয়ার বিপক্ষে গোলে কোনো শট না নেওয়া নিয়ে পেলে পরে বলেছিলেন, ‘আমি আসলে মাইলফলকের গোলটি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে করতে চেয়েছিলাম। ওই ম্যাচে তাই আমি শট নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।’

১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর পেশাদার ফুটবলে ১০০০তম গোলটি করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে।
১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর পেশাদার ফুটবলে ১০০০তম গোলটি করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে।

বাহিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক মজা করেই পেলেকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কোনটি আগে হবে—পেলের ১ হাজারতম গোল, নাকি অ্যাপেলোর চাঁদে অবতরণ!’ পেলে সেদিন এর কোনো উত্তর দেননি, শুধু মৃদু হেসেছিলেন। হয়তো তিনি জানতেন, ১৯ নভেম্বর রিও ডি জেনিরোর মারাকানায় ব্রাজিলিয়ান লিগে ভাস্কো দা গামার বিপক্ষে গোল পেয়েই যাবেন। তেমন বড় কোনো ম্যাচ সেটি ছিল না। আবার খুব সাধারণ ম্যাচও কি ছিল সেটি? পেলের ১ হাজারতম গোলের মুহূর্তটি সরাসরি দেখতে সেদিন মারাকানায় গিয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার দর্শক। এমনকি ভাস্কো দা গামার সমর্থকেরাও চেয়েছিল গোলটি হোক!
কাঙ্ক্ষিত গোলটির জন্য অবশ্য ৭৭ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে পেলেকে। গোলটি তিনি পেয়েছেন পেনাল্টি থেকে। আর গোল হতেই সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো! পেলে তো বলটি এনে চুমো দিচ্ছিলেন। ততক্ষণে শয়ে শয়ে দর্শক ঢুকে পড়ে মাঠে। দেখতে না দেখতেই পেলেকে সবাই আবিষ্কার করল ভক্তদের কাঁধে। সংবাদমাধ্যমের লোকজন পিছু পিছু হাঁটছে। সবার শেষে তাঁকে কাঁধে নিয়ে পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করেছে। এরপর পেলেকে মাঠ থেকে নামিয়ে নিয়েছেন কোচ।
পেলে পরে সান্তোসের হয়েও ১ হাজার তম গোল পেয়েছেন। সেটি ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ইউনিভার্সিদাদ ডি মেক্সিকোর সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে। ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জেতা পেলে তাঁর ক্যারিয়ারে ১৩৬৩ ম্যাচ খেলে মোট গোল করেছেন ১ হাজার ২৮১টি। এ নিয়ে অবশ্য তর্ক আছে। রেকর্ড স্পোর্ট সকার স্ট্যাস্টিকস ফাউন্ডেশন (আরএসএসএসএফ) এক গবেষণায় দেখিয়েছে পেলে ৮৩১টি আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৭৬৭টি। এই গবেষণা অনুযায়ী সর্বোচ্চ গোলদাতা জোসেফ বাইকান। চেক প্রজাতন্ত্রের সাবেক খেলোয়াড় ৫৩০ ম্যাচে করেছেন ৮০৫ গোল। এখানে পেলের চেয়ে এগিয়ে ব্রাজিলের আরেক সাবেক স্ট্রাইকার রোমারিও। ৯৯৪ ম্যাচে ৭৭২ গোল তাঁর।