মরিনহো আবারও 'স্পেশাল ওয়ান' হতে পারবেন তো?

টটেনহামে এসেছেন মরিনহো। ছবি : টটেনহাম হটস্পারের টুইটার পেজ
টটেনহামে এসেছেন মরিনহো। ছবি : টটেনহাম হটস্পারের টুইটার পেজ
প্রায় এক বছর বেকার থাকার পর আবারও কোচের চাকরিতে ফিরেছেন হোসে মরিনহো। চেলসিতে দুবার আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে একবার থাকার পর এবার নিয়েছেন আরেক ইংলিশ ক্লাব টটেনহাম হটস্পারের দায়িত্ব। কয়েক বছর আগেও তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বের সেরা ম্যানেজার থাকা মরিনহোর সে দিন আর নেই।
পর্তুগিজ এ কোচ টটেনহামে নিজের হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন তো?


চেলসি। ইন্টার মিলান। রিয়াল মাদ্রিদ। চেলসি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। টটেনহাম হটস্পার।

ক্লাবের নামগুলো এক নিশ্বাসে বাম থেকে ডানে পড়তে থাকুন। শক্তির একটা তারতম্য বুঝতে পারবেন। একটা ধারাও লক্ষ্য করতে পারবেন।

আভিজাত্যের দিক দিয়ে চেলসি বা ইন্টার মিলানের অবস্থান একদম সেরা নয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লাব বলা যায় এদের। আর ক্লাব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম চূড়ায় যে দুই-তিনটি ক্লাব সব সময় ছিল, রিয়াল মাদ্রিদ তাদের মধ্যে একটি। কৌলীন্যের দিক দিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবস্থান আবার রিয়ালের মতো অতটা রাজকীয় নয়। ক্লাব-কৌলীন্যের হিসেবে টটেনহামও আজকাল সেই দ্বিতীয় পর্যায়েই উঠে এসেছে।

ক্লাবগুলোর শক্তিমত্তার পার্থক্যের ধারাটা যেন মরিনহোর পুরো ক্যারিয়ারেরই প্রতিফলন।

প্রথমে পোর্তো, বেনফিকা, চেলসি, ইন্টারের মতো ক্লাবগুলোতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন। এরপর উঠলেন আরও উঁচুতে, রিয়াল মাদ্রিদের ডাগ আউট আলো করতে। চূড়ায় উঠলে তো আর ওপরে ওঠা যায় না। তখন শুধু একটা পথই থাকে—পতন। সে সূত্র মেনে মরিনহোও নামলেন আস্তে আস্তে। চেলসিতে গেলেন, এরপর এল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

রিয়াল-পূর্ব সময়ে মরিনহো নিজের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছিলেন, রিয়াল-পরবর্তী সময়ে ঘটেছে তার ঠিক উল্টো। সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। সমালোচনা বেশি। বিতর্কও বেশি। এসব বিতর্কের কারণে মরিনহোর ভাবমূর্তি এখন যতটা না কোচ বা ম্যানেজারের, তার চেয়ে বেশি সার্কাসের ‘রিংমাস্টার’-এর মতো। রিয়াল মাদ্রিদে তাঁর চাকরি হারানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছিল রোনালদো-রামোস-ক্যাসিয়াসদের সঙ্গে খামোখা বচসায় জড়ানো। চেলসিতেও ঝামেলায় জড়িয়েছেন হুয়ান মাতাদের সঙ্গে। ক্লাবের চিকিৎসক ইভা কারনেইরোও মরিনহোর চক্ষুশূল হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পল পগবা থেকে শুরু করে অ্যান্থনি মার্শিয়াল, অ্যালেক্সিস সানচেজ থেকে শুরু করে মার্কাস রাশফোর্ড, সবার সঙ্গেই সম্পর্ক খারাপ করেছেন। এর সঙ্গে ফি সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলনে এসে একেকটা ‘বাণী চিরন্তনী’ প্রদান করা তো ছিলই।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেও খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে এসেছেন মরিনহো। ছবি : এএফপি
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেও খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে এসেছেন মরিনহো। ছবি : এএফপি

প্রত্যেক ক্লাবেই মরিনহোর শেষ সময় কেটেছে সার্কাসের মতো। কে যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে সেদিন লিখেছেন, মরিনহোর দায়িত্ব নেওয়া সর্বশেষ ছয় ক্লাবের (চেলসি, ইন্টার মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসি, ইউনাইটেড, স্পার্স) নামের আদ্যক্ষর মেলালে ‘সার্কাস (CIRCUS)’-ই পাওয়া যায়! একে কাকতালীয় না বললে কোনটাকে বলবেন!

কিন্তু চূড়া স্পর্শ করেই যদি ক্ষান্ত হলে তিনি মরিনহো কেন? মরিনহোর মতো বিজেতারা যে বারবার চূড়ায় ওঠার চেষ্টাই করেন। নিজের ভাবমূর্তিকে আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে এই পর্তুগিজ কোচ যোগ দিয়েছেন টটেনহামে।

যত সমালোচনাই হোক না কেন, বিখ্যাত সেই 'মিডাস-টাচ' যতই হারিয়ে যাক না কেন, মরিনহো এখনো বিশ্বের সর্বসেরা কোচদের মধ্যে একজন। ইয়ুর্গেন ক্লপ, পেপ গার্দিওলা, জিনেদিন জিদানদের সঙ্গে তাঁর নাম এখনো একই কাতারে থাকার যোগ্যতা রাখে। এটা তাঁর সমর্থকেরা যেমন জানেন, জানেন সমালোচকরাও। আর এখানেই কোচ মরিনহোর মাহাত্ম্য।

মরিনহো নিজেও জানেন সেটা। বরং সবার চেয়ে বেশিই জানেন। এ কারণেই গত বছরের ডিসেম্বরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চাকরি হারানোর পরেও মানের সঙ্গে আপস করেননি। এ এক বছরে চাইলেই যেতে পারতেন এএস রোমা, শালকে ০৪, লিল, বেনফিকা, ভলফসবুর্গ, মোনাকো, স্পোর্টিং লিসবন, লিওঁর মতো ক্লাবগুলোতে। ক্লাব-কৌলীন্যের হিসেবে প্রথম বা দ্বিতীয়, কোনো কাতারেই যাদের রাখা যায় না। কিন্তু রিয়াল ছাড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাফল্যের তুলনায় মরিনহোর ব্যর্থতার পাল্লাটা এমন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে, প্রথম সারির ক্লাবগুলো যে তাঁর ওপর আর আস্থা রাখবে সেটা বিশ্বাস করার লোক দিন দিন কমেছে (বলে রাখা ভালো, এখানে সাফল্য বলতে শুধু ট্রফির সংখ্যাকে বোঝানো হচ্ছে না। ট্রফির সংখ্যা, খেলার মান, খেলোয়াড় ও ক্লাব-কর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক, সর্বোপরি নিজের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে বোঝানো হচ্ছে)।

আর এসব লোকদের মধ্যেই মরিনহো নিজেই একজন।

মানের সঙ্গে আপস না করার বিষয় তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পরিবারকে সঙ্গে রাখার ইচ্ছেটা। বয়স হচ্ছে, এখন আর যাযাবরের মতো একা একা ভিনদেশে পরিবার থেকে দূরে কোচিং করানোর ইচ্ছে হয় না। মরিনহো যখন যেখানেই কোচিং করাতে গেছেন, একাই গেছেন। পরিবার থাকে লন্ডনে, তাই এখন মরিনহো নিজেও চেয়েছিলেন লন্ডনের এক ক্লাবের কোচিং করাতে। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে প্রতিদিন প্রিয় মুখগুলো দেখে ঘুমোতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রথমবার চেলসির চাকরি পাওয়ার সময় সেই যে মরিনহোর পরিবার পর্তুগাল থেকে লন্ডনে এল, এরপর আর লন্ডন ছাড়েনি তারা। এমনকি মরিনহো যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চাকরি করতে এলেন, পরিবার লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টারেও আসেনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে থাকার সময় মরিনহোকে রাত কাটাতে হতো হোটেলে, অনলাইন প্রতিষ্ঠান ‘ডেলিভারু’-এর সাহায্যে আনাতে হতো রাতের খাবার। ৫৬ বছর বয়সে এসে আর এই যাযাবরের জীবন পছন্দ হয়নি মরিনহোর।

টটেনহামকে আজকের অবস্থানে আনার পেছনে পচেত্তিনোর অবদান অনেক। ছবি : এএফপি
টটেনহামকে আজকের অবস্থানে আনার পেছনে পচেত্তিনোর অবদান অনেক। ছবি : এএফপি

লন্ডনের ক্লাব বলতে কোনগুলো? চেলসি, আর্সেনাল, টটেনহাম, ক্রিস্টাল প্যালেস, ওয়েস্ট হাম - এগুলোই তো। নিজের মানের সঙ্গে আপস করবেন না যেহেতু, তাই ওয়েস্ট হাম আর ক্রিস্টাল প্যালেসের মতো ক্লাবগুলো আগেই বাদ পড়ে যায়। বাকি ক্লাব তিনটির মধ্যে একটা ক্লাব থেকে দুবার ছাঁটাই হয়েছেন, আরেক ক্লাবের সাবেক কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের সঙ্গে তাঁর বৈরিতা ফুটবলীয় রূপকথার অংশ হয়ে গেছে। ফলে সেখানেও যাওয়ার মুখ নেই। বাকি থাকে ওই একটা ক্লাবই।

টটেনহাম হটস্পার। রিয়াল, পিএসজি, বার্সেলোনার মতো শীর্ষে নয় যারা, আবার লিল-লিওঁ-স্পোর্টিংয়ের মতো তৃতীয় সারিরও নয়।

মরিনহো জানতেন, গত কয়েক বছর যেভাবে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তা থেকে নিজের ভাবমূর্তিকে উদ্ধার করতে হবে। আর সে কাজ করতে টটেনহামই একমাত্র ক্লাব। ক্লাবটা লন্ডনেও আছে, আবার গত বারের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠা ক্লাবকে ঠিক তৃতীয় সারিরও বলা যায় না।

আবার টটেনহামের বর্তমান অনেক খেলোয়াড়কে তাঁর পছন্দ। এরিক ডায়ারের কথাই ধরুন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে থাকতে এই ইংলিশ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে অনেকে চেয়েছিলেন। ইউনাইটেড কেনার টাকা দেয়নি। একই কথা প্রযোজ্য টোবি অল্ডারভেইরেল্ডের জন্যও। বেলজিয়ামের এ সেন্টারব্যাককে ঘিরে মরিনহো নিজের পরিকল্পনা সাজাতে চেয়েছিলেন। সে কাজটাও করতে পারেননি ইউনাইটেডের সহসভাপতি এড উডওয়ার্ডের সঙ্গে রেষারেষির কারণে। 

এরিক ডায়ারকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে চেয়েছিলেন মরিনহো। ছবি : এএফপি
এরিক ডায়ারকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে চেয়েছিলেন মরিনহো। ছবি : এএফপি

এবার লেভির প্রসঙ্গে দুটি কথা বলা যাক। ইউরোপের ক্লাবগুলোর বর্তমান সভাপতিদের মধ্যে ড্যানিয়েল লেভি বেশ পুরোনো। বহুদিন ধরে টটেনহামকে চালাচ্ছেন, লেভির অধীনে মোটামুটি মাঝারি মান থেকে ইউরোপের অন্যতম সমীহ জাগানিয়া ক্লাবে পরিণত হয়েছে টটেনহাম। ব্যবসায়ী হিসেবে লেভি বেশ ধুরন্ধর। লেভির কারণে টটেনহামে কোনো বাড়তি খরচ হয় না। বাড়তি বেতন দিয়ে কোনো খেলোয়াড়কে রাখেন না, খামোখা খেলোয়াড় কেনেন না, বেচেনও না।

ড্যানিয়েল লেভি - যার টেকো মাথায় এত বুদ্ধি! ছবি : এএফপি
ড্যানিয়েল লেভি - যার টেকো মাথায় এত বুদ্ধি! ছবি : এএফপি

টটেনহামে এখনো কোনো খেলোয়াড় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেতন পান না। কয়েক দিন আগেও বিশ্বের অন্যতম সেরা আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন সপ্তাহে মাত্র ৪০ হাজার পাউন্ড বেতন পেতেন। এত দিনে তাঁর সাপ্তাহিক বেতন বেড়ে হয়েছে ৭৫ হাজার পাউন্ড। ম্যানচেস্টার সিটির বের্নার্দো সিলভা তার ঠিক দ্বিগুণ বেতন পান, কেভিন ডি ব্রুইনা পান প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পল পগবা পান চার গুণ বেশি।

লেভি মানুষ হিসেবে এমনই। লৌহমানব।

মরিনহো জানতেন, নিজের পরবর্তী ক্লাব হিসেবে এমন একটা ক্লাবকে লাগবে, যেখানে খেলোয়াড়দের বাড়তি ‘ইগো’ সামলানোর হ্যাপা নেই। যেখানে সভাপতিই সর্বেসর্বা। যেখানে কোনো ভাবে সভাপতিকে পটাতে পারলেই ব্যস, কেল্লাফতে!

পটানোর কাজটা যে মরিনহো বেশ ভালোভাবেই করেছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পচেত্তিনোকে ছাঁটাইয়ের পর মরিনহোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় পর্তুগিজ ম্যানেজারের টটেনহাম নিয়ে পরিকল্পনা শুনে স্রেফ পটে গেছেন লেভি, এমনটাই শোনা গেছে। পটে যদি না-ই যান, তাহলে লেভির মতো কিপটে মানুষ মরিনহোকে বাৎসরিক ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে রাজি হবেন কেন? যেখানে পচেত্তিনো নিজেই পেতেন তার অর্ধেক। শুধু পচেত্তিনোই নন, ইয়ুর্গেন ক্লপ, জিনেদিন জিদান, ডিয়েগো সিমিওনে - সবার চেয়ে মরিনহোর বেতন বেশি। মরিনহোর ওপরে আছেন শুধুই পেপ গার্দিওলা। বাৎসরিক ২৩ মিলিয়ন পাউন্ড বেতন পান তিনি। 

গত এক বছর ধরে হ্যারি কেইনদের গুরুই হতে চেয়েছিলেন মরিনহো। ছবি : টটেনহাম হটস্পারের টুইটার পেজ
গত এক বছর ধরে হ্যারি কেইনদের গুরুই হতে চেয়েছিলেন মরিনহো। ছবি : টটেনহাম হটস্পারের টুইটার পেজ

তবে লেভি নিজেও মরিনহোকে আগে থেকেই পছন্দ করতেন। সেই ২০০৪ সালে পোর্তোর মতো ‘আন্ডারডগ’কে যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতালেন মরিনহো, তখনই তাঁকে টটেনহামে চেয়েছিলেন লেভি। মরিনহোর সামনে তখন চেলসির হাতছানি, টটেনহামে কেন যাবেন?

২০০৭ সালে যখন চেলসি থেকে প্রথমবারের মতো ছাঁটাই হলেন, সঙ্গে সঙ্গে মরিনহোকে ফোন দিয়েছিলেন লেভি, টটেনহামের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। কিন্তু চেলসির সঙ্গে একটা চুক্তি ছিল মরিনহোর। চাকরি ছাড়ার দুই বছরের মধ্যে কোনো ইংলিশ ক্লাবের দায়িত্ব নিতে পারবেন না, চেলসির সঙ্গে চুক্তির এ শর্তের কারণে তখন লেভির দলে আসতে পারেননি মরিনহো।মরিনহোর মতো তাই ধৈর্য ধরার পুরস্কার পেয়েছেন লেভিও। দেড় দশক ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে পেয়েছেন মরিনহোকে।

চার বছর ধরে টটেনহামকে গতিশীল দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলিয়েছিলেন পচেত্তিনো। বারবার একটুর জন্য ট্রফি জিততে পারেননি। দীর্ঘ সময় ধরে গতিশীল ফুটবল খেললে খেলোয়াড়দের শরীরের ওপর বেশ চাপও পড়ে। একটা পর্যায়ে খেলোয়াড়দের কিছু দেওয়ার থাকে না। তার ওপর দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলার পরেও শিরোপা না জেতা গেলে শারীরিক ক্লান্তির সঙ্গে মানসিক একটা বাধাও এসে পড়ে। যেটা এসেছে টটেনহামের খেলোয়াড়দের মাঝে। আর এত ভালো ভালো খেলোয়াড়দের চুক্তি নবায়ন না করার অর্থ হলো, চুক্তি শেষ হলে তাঁরা যেকোনো ক্লাবে যোগ দিতে পারবেন, ট্রান্সফার ফি বাবদ একটা পয়সাও পাবে না টটেনহাম। লেভি নিজের দলের এত বড় ক্ষতি কেন মানবেন?

পচেত্তিনো নিজেও জানতেন, বর্তমান খেলোয়াড়দের আর কিছু দেওয়ার নেই। এ জন্য আস্তে আস্তে দলে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিলেন, একাধিক নতুন খেলোয়াড় আনতে চেয়েছিলেন। 

পচেত্তিনোর অধীনে আর খেলতে চাননি এরিকসেনরা। ছবি : এএফপি
পচেত্তিনোর অধীনে আর খেলতে চাননি এরিকসেনরা। ছবি : এএফপি

লেভি দেখলেন, পচেত্তিনোকে রাখলে তাঁর আর্থিক দিক দিয়ে বেশ ক্ষতি হচ্ছে। একাধিক খেলোয়াড়কে আগামী বছরের মধ্যে বিনা মূল্যে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি পচেত্তিনোর পছন্দের একাধিক খেলোয়াড়কে কিনতে হবে। সীমানা ছাড়া খরচাপাতির ব্যাপার-স্যাপার।এর চেয়ে পচেত্তিনোকে ছাঁটাই করলে লেভির একাধিক লাভ হচ্ছে।

প্রথমত, নিজের দীর্ঘদিনের পছন্দের কোচ হোসে মরিনহো বেকার বসে আছেন। এমন এক কোচ যিনি দলে আসার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়েরা নতুন ‘চ্যালেঞ্জ’ পাবেন। নেতিবাচক ফুটবল খেলান আর যাই করেন, মরিনহো একজন প্রমাণিত বিজয়ী। যেখানে গেছেন, কিছু না কিছু জিতেছেন। খেলোয়াড়দের চাঙা করে তুলতে এখন একটি-দুটি ট্রফি দরকার, বুঝেছিলেন লেভি। আর সে ট্রফি জয়ের জন্য মরিনহোর চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি কেউ হন না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সবার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করেও দিন শেষে তিনটি ট্রফি জিতেছেন। পচেত্তিনোকে তাই ছাঁটাই করতে সময় লাগেনি লেভির।

দ্বিতীয়ত, পচেত্তিনোকে রাখতে তাঁর সব মিলিয়ে যে খরচ হবে, মরিনহোকে আনলে তার চেয়ে খরচ হবে কম। পচেত্তিনোকে রাখতে হলে একাধিক খেলোয়াড়কে বিনা মূল্যে ছাড়তে হবে, আবার একাধিক নতুন খেলোয়াড়কে আনতে হবে। এর চেয়ে এখনকার খেলোয়াড়দের ‘মরিনহো’ নামের নতুন চ্যালেঞ্জ দিলে কোনো খেলোয়াড়কে বিনা মূল্যে ছাড়তেও হচ্ছে না, আপাতত নতুন কাউকে কিনতেও হচ্ছে না। মরিনহোকে বাৎসরিক বেতন দেওয়া লাগবে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড, তাঁর সহকারীদের আনতে খরচ হবে আরও পাঁচ মিলিয়নের মতো, আরও এক বছর এই স্কোয়াড দিয়েই চালান যাবে।

দিন শেষে সেটাই হয়েছে। মরিনহো আসার সঙ্গে সঙ্গে ভার্তোনে, এরিকসেন, অল্ডারভেইরেল্ড, রোজরা নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য আগ্রহী হয়েছেন বলে শোনা গেছে। 

লুইস কাম্পোস। ছবি : এএফপি
লুইস কাম্পোস। ছবি : এএফপি

টটেনহামে স্কোয়াডে এমন অনেক খেলোয়াড় আছেন, যাদের সঙ্গে মরিনহো মানিয়ে নিতে পারবেন। মরিনহোর প্রত্যেক সফল দলই শক্ত রক্ষণভাগের ওপর নির্মিত, যারা মেশিনের মতো ওঠানামা করতে পারেন। চেলসিতে ছিলেন মাইকেল এসিয়েন, ক্লদ ম্যাকেলেলে, নেমানিয়া মাতিচ। রিয়ালে সামি খেদিরা ও এসিয়েন। ইন্টারে ক্যাম্বিয়াসো, হাভিয়ের জানেত্তি ও থিয়াগো মোত্তা। ইউনাইটেডে মাতিচ ও ম্যাকটমিনে। পোর্তোতে কস্টিনহা ও ম্যানিশ। টটেনহামেও মরিনহো পাচ্ছেন এরিক ডায়ার ও ট্যাঙ্গয় এনদোম্বেলের মতো দুজন অসাধারণ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে। সঙ্গে মুসা সিসোকো।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যেসব কারণে মরিনহো ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেসব ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে ব্যাপারেও তিনি বেশ সতর্ক। চুক্তি সই করার পূর্বশর্ত হিসেবে লেভিকে বলে দিয়েছেন, একটা স্পোর্টিং ডিরেক্টর চাই তাঁর। দলবদল সংক্রান্ত বিষয়ে লেভি ও মরিনহোর মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবেন তিনি। লেভির পছন্দ মতো কম দামে সেরা খেলোয়াড়ও কিনতে হবে তাঁকে। আর এ জায়গায় মরিনহো চেয়েছেন নিজের প্রিয় বন্ধু, ফরাসি ক্লাব লিলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর, আরেক পর্তুগিজ লুইস কাম্পোসকে।

কে এই লুইস কাম্পোস? ভদ্রলোক আগে কোচ ছিলেন। কোচিংয়ে বিশেষ সুবিধা না করতে পারলেও ফুটবলের খুঁটিনাটি কৌশল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অভ্যাস তাঁর চিরদিনের। প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের কুঁড়ি থেকে তুলে আনারও অভ্যাস আছে তাঁর। মরিনহো যখন রিয়াল মাদ্রিদে ছিলেন, এই কাম্পোস ছিলেন প্রধান স্কাউট। রিয়ালে থাকতেই আবিষ্কার করেছিলেন ব্রাজিলের মিডফিল্ডার ফাবিনহোকে। সে ফাবিনহো আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার। পরে রিয়ালের চাকরি ছেড়ে মোনাকোতে যোগ দেন। বের্নার্দো সিলভা, কিলিয়ান এমবাপ্পে, থমাস লেমার, তিমুইয়ে বাকায়োকো, বেঞ্জামিন মেন্ডির মতো প্রতিভাদের একদম কম দামে মোনাকোতে নিয়ে আসার কৃতিত্ব শুধুই কাম্পোসের। 

মোনাকো ছেড়ে লিলে যাওয়ার পরেও নিজের কাজ বজায় রাখেন কাম্পোস। অবনমনের শঙ্কায় থাকা দলটায় নিয়ে আসেন জোনাথান বাম্বা, জোনাথান ইকোনে, নিকোলাস পেপে, রাফায়েল লিয়াওয়ের মতো একাধিক তরুণকে। পরের মৌসুমে এদের খেলিয়েই লিল সুযোগ পেয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার। এর মধ্যেই লিয়াও, থিয়াগো মেন্ডেস, পেপে, ইউসুফ কোনের মতো একাধিক তারকাকে বিক্রি করে লিলের অনেক লাভ করে দিয়েছেন কাম্পোস।

ইউরোপের অন্যতম সেরা স্পোর্টিং ডিরেক্টর মানা হচ্ছে এখন কাম্পোসকে। মরিনহোর সঙ্গে কাম্পোস, স্পার্স সমর্থকেরা স্বপ্ন দেখতেই পারেন!

পরে কী হয় বলা যায় না, তবে আপাতত টটেনহাম-মরিনহো সম্পর্কের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ যথেষ্ট ইতিবাচক। ভবিষ্যতে কম খরচ করে, আর ড্যানিয়েল লেভির মতো মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত এড়িয়ে মরিনহো যদি টটেনহামকে চালাতে পারেন, মূলত সেটার ওপরেই স্পারদের সাফল্য নির্ভর করছে। কিন্তু মরিনহো নিজে ঝগড়াঝাঁটি না করে থাকতে পারবেন তো? যদি না পারেন, স্বাভাবিকভাবেই এরপর প্রথম বা দ্বিতীয় সারির কোনো ক্লাবই নিতে চাইবে না তাঁকে। মরিনহো নিজেও তা ভালো জানেন।

আজ বিকেল সাড়ে ছয়টায় মরিনহো-যুগ শুরু হতে যাচ্ছে টটেনহামে। লন্ডন ডার্বিতে ওয়েস্ট হামের মুখোমুখি হচ্ছে টটেনহাম। কথায় বলে, প্রভাতই দিনে পূর্বাভাস দেয়। মরিনহোর অধীনে স্পার্স কেমন করবে, সেটির একটি পূর্বাভাস আজ পাওয়া যাবে হয়তো!