ভারত সফরে যে কারণে ছন্নছাড়া বাংলাদেশ

ভারত সফরে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের প্রতীকী চিত্র এটিই। ছবি: এএফপি
ভারত সফরে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের প্রতীকী চিত্র এটিই। ছবি: এএফপি
>টি-টোয়েন্টিতে জয় দিয়ে ভারত সফর শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর থেকে সবকিছুই এলোমেলো। টেস্ট সিরিজে তো রীতিমতো ছন্নছাড়া, এলোমেলো দল। কেন এমন হলো, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন রানা আব্বাস।

ইডেন গার্ডেনে কলকাতা টেস্টের তিন দিনে বাংলাদেশ খেলোয়াড়দের দেখে শুধু একটা গানই মনে পড়েছে, ‘চারিদিকে উৎসব, পরিপূর্ণ নিয়ন আলোয়, আমার এ পৃথিবী ঘিরে আসছে আঁধার কালোয়…।’ নিয়ন আলোর জায়গায় হবে ‘গোলাপি আলো’!

গোলাপি বলে দিবারাত্রির টেস্ট ঘিরে কলকাতাজুড়ে উৎসব-উৎসব আবহ। এ উৎসব কিছুতেই বাংলাদেশের জন্য নয়, তা শুধুই ভারতের। অথচ বাংলাদেশ দিবারাত্রির টেস্ট খেলতে রাজি হয়েছিল বলেই তো এত আয়োজন! মাঠের পারফরম্যান্স এত বাজে—এ সব আয়োজন বিশেষ কোনো তাৎপর্য বয়ে আনছে না মুশফিকদের কাছে। কলকাতা টেস্টে তিক্ত, বাজে যাত্রার সমাপ্তি মাত্র। এটির শুরু সেই ইন্দোরে। টি-টোয়েন্টি সিরিজটা ভালো খেলার পর টেস্টে রীতিমতো কঙ্কালসার বাংলাদেশ।

গুরুত্বপূর্ণ এ সফরের আগেই বাংলাদেশ দলকে খেতে হয়েছে বড় ধাক্কা। খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের পর সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে এল সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পাশে থাকবেন বলে সফর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তামিম ইকবাল। গুরুত্বপূর্ণ দুজন খেলোয়াড়কে ছাড়াই প্রথমবারের মতো ভারতে পূর্ণাঙ্গ সফরে এসে বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। জয় এসেছিল সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই। ২০ ওভারের ম্যাচে লড়াই করতে পারলেও টেস্টে এসে বাংলাদেশ হয়ে গেল ছন্নছাড়া।

বিদেশে একটা টেস্ট সিরিজ খেলতে এসেছে বাংলাদেশ, অথচ কোনো প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ রাখা হয়নি। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) যে সূচি দিয়েছে, সেটিতেই রাজি হয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৯ বছর পর ভারতে পূর্ণাঙ্গ সফরের সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ, মনে হয়েছে এটিকেই অনেক বড় প্রাপ্তি মেনেছে বিসিবি। ম্যাচের বাইরে আলাদা কোনো প্রস্তুতি ম্যাচের প্রসঙ্গটা তাই হারিয়ে গেছে আড়ালে। টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দলের সঙ্গে অনভিজ্ঞ, তারুণ্যনির্ভর এক বাংলাদেশকে খেলতে হয়েছে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই।

ইন্দোর টেস্টে বাংলাদেশ খেলেছে রক্ষণাত্মক কৌশলে। তাদের লক্ষ্যই ছিল টেস্টটা কোনোভাবে পাঁচ দিনে নিয়ে যাওয়া। সাত ব্যাটসম্যান আর চার বোলার (পেসার দুজন) নিয়ে দল সাজিয়েছিল বাংলাদেশ। এই কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তো উঠলই, প্রতিপক্ষের দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণ আর সকালের কঠিন কন্ডিশন জেনেও টস জিতে কেন আগে ব্যাটিং, সেটি নিয়েও কথা বলতে হলো কোচ ও অধিনায়ককে।

ভারত সফরে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বেশির ভাগই ডমিঙ্গোর মস্তিষ্ক-প্রসূত। টি-টোয়েন্টির ‌গেম প্ল্যানে' মাহমুদউল্লাহ যা কিছুটা ভূমিকা রেখেছেন, টেস্টে মুমিনুল হক সেটি কমই রাখতে পেরেছেন। বলা যায়, কোচ যেভাবে চালিয়েছেন, তাঁকে সেভাবেই চলতে হয়েছে। ইন্দোরে কেন চার বোলার নিয়ে খেলেছেন, সেটির ব্যাখ্যায় কোচ সরাসরিই বলেছেন, ‘যখন আপনার দলের শীর্ষ ছয় ব্যাটসম্যানের গড় ৪৫-৫০ হবে অনায়াসে ৬ ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলতে পারেন। ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ দেখেন। দুর্ভাগ্য, আমাদের তেমন ব্যাটসম্যান নেই। এ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে একজন অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলছি। যদি আপনি উইকেট না পান তখন শুনতে হবে কেন অতিরিক্ত বোলার নিইনি।’

কোচের এই মন্তব্যে ইতিবাচক কোনো বার্তা পৌঁছেনি দলে। কলকাতা টেস্টে যে ঘুরে দাঁড়াবে সে উপায়ও খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, বিসিবি কেন হুট করে রাজি হয়ে গেল দিবারাত্রির টেস্ট খেলতে? গোলাপি বলের টেস্ট খেলতে প্রথম যখন প্রস্তাব দেয় বিসিসিআই, বিসিবি তখন কিছুটা দ্বিধায় ছিল। তারা খেলোয়াড়দের মতামত জানতে চায়। গোলাপি বলে দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই ‘না’ ভোট দেন। যে বলে কখনো খেলেননি, কোনো ধারণা নেই—সেটিতে রাজি হবেন কেন? কিন্তু সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সৌরভ গাঙ্গুলীর এ ‘চাওয়া’টা প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি বিসিবি। ইডেনে দিবারাত্রির টেস্ট আয়োজন হলে বিরাট এক উপলক্ষ হবে। ভারতের মাটিতে এত বড় উপলক্ষ বাংলাদেশ আর কবে পাবে, এ ভাবনায় বিসিবি রাজি হয়ে যায় দিবারাত্রির টেস্ট খেলতে।

আজ বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক আবারও জানালেন, দিবারাত্রির টেস্ট হুট করে রাজি হয়ে যাওয়ার মধ্যে তিনি ভুল কিছু দেখেন না, ‘আমার মনে হয় সিদ্ধান্ত খারাপ ছিল না। আমরা ব্যর্থ হয়েছি বলে সিদ্ধান্ত খারাপ ছিল, এটা বলা যাবে না। আজ না হলেও কাল দিবা-রাত্রির টেস্ট খেলতেই হতো। এক সময়ে না এক সময়ে খেলতে হতো, সেদিক থেকে চিন্তা করলে সিদ্ধান্ত খারাপ ছিল না। গোলাপি বলে খেলায় আমরা কিছু শিখতে পেরেছি। ভারত দলও গোলাপি বলে খেলেনি, আমরাও খেলিনি। আসার আগে আমাদের হয়তো গোলাপি বলে আরেকটু প্রস্তুতি নিলে ভালো হতো।’

ভারতের কাছে অনেক বড় উপলক্ষ হলেও বাংলাদেশের কাছে কলকাতা টেস্ট হয়ে গেছে ভুলে যাওয়ার এক টেস্ট! ইন্দোর টেস্টে বাজে ব্যাটিংয়ের পর টিম ম্যানেজমেন্ট ব্যাটিং ও বোলিংয়ে কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। ওপেনিংয়ে ইমরুলকে বসিয়ে খেলাতে চেয়েছিল সাইফ হাসানকে। সাইফ ইন্দোরে আঙুলের চোটে পড়ায় সেটি হয়নি। টেস্ট স্কোয়াডে থাকা মোসাদ্দেক হোসেন দেশে যাওয়ার পর তাঁকে আর ফেরানো হয়নি। নির্বাচকেরা ডমিঙ্গোকে বলেছিলেন, দেশ থেকে উড়িয়ে এনে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে। কোচ রাজি হননি। এ ভাবনা যে ঠিক ছিল না, সেটি বোঝা গেল টেস্টে মাথায় আঘাতজনিত চোট পেয়ে দুজন খেলোয়াড় ছিটকে যাওয়ার পর। অবস্থা এমনই দাঁড়াল, নতুন করে কনকাশনে কেউ পড়লে হাতে বিকল্প ছিল না!

এই হযবরল পরিস্থিতিতে আরেক সিদ্ধান্ত, ম্যাচের মাঝে ঢাকা থেকে নাজমুল হোসেনকে উড়িয়ে আনা হবে। কাল সন্ধ্যায় দ্বিতীয় ইনিংসেও চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ায় শান্তকে ‘না করে দেওয়া হয়। মাঠে যখন ধুঁকছে বাংলাদেশ, তখন বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান আরেক বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসলেন কাল রাতে,‘ ব্যাটিং নেওয়ায় সত্যিই আশ্চর্য হয়েছি। আগের দিনও টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। কোচ-অধিনায়ক দুজনই বলেছে ফিল্ডিং নেবে। এটা নিশ্চিত ছিল। টস জিতে যখন দেখেছি ব্যাটিং নিয়েছি, তখনই ধাক্কা খেয়েছি।’

আজ মুমিনুলের কাছে এ নিয়ে জানতে চাইলে বললেন, ‘এ প্রসঙ্গে কথা বলার সঠিক মানুষ নই!’ অধিনায়কই যদি সঠিক মানুষ না হন, তাহলে দলের কোন খেলোয়াড় কথা বলবেন টস নিয়ে? একটা দলের পরিকল্পনায় ভুল, কৌশলে ভুল। অনভিজ্ঞ, দক্ষতায় পিছিয়ে, আত্মবিশ্বাস তলানিতে। তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো দুর্বল। দলটায় নেই আবার গুরুত্বপূর্ণ দুই খেলোয়াড়—ভীষণ এক শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এ ফলই তো অনিবার্য!