গার্দিওলার যে সমস্যাগুলোর সুবিধা নিয়েছে লিভারপুল-ইউনাইটেড

দুঃসময় কাটছেই না সিটির। ছবি : এএফপি
দুঃসময় কাটছেই না সিটির। ছবি : এএফপি
>টানা তৃতীয়বার লিগ জেতার আশা নিয়ে মৌসুম শুরু করেছিল ম্যানচেস্টার সিটি। কিন্তু মৌসুমের অর্ধেক না যেতেই লিগ টেবিলের শীর্ষে থাকা লিভারপুলের চেয়ে ১৪ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে তারা। লিগ জিততে হলে এক রকম অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে পেপ গার্দিওলার দলকে। গত মৌসুমে শতাধিক পয়েন্ট পেয়ে লিগ জেতা সিটির সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে আসলে?

গত রাতে ম্যাচ শেষে করমর্দনের সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিক্ষণ কথা বললেন যেন দুই কোচ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিজয়ী কোচ ওলে গুনার সুলশারের কানে কানে অমন মুখ ভার করে কী বলছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গার্দিওলা? সিটির বর্তমান সমস্যার কথা? বোঝা যায়নি সেটা। তবে সে কথাগুলোই যদি বলে থাকার পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে শুধু করমর্দনের কয়েক সেকেন্ডে তা বলে শেষ করা যাবে না।

সিটির সমস্যা দিন দিন এতই বাড়ছে। কোথা থেকে শুরু করা যায়? সবচেয়ে চর্চিত সমস্যার কথা বলেই শুরু করা যাক। যে সমস্যাটাই মূলত বাকি সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু। যে সমস্যাটা থেকেই ‘চেইন রিঅ্যাকশন’ এর মতো সৃষ্টি হচ্ছে সিটির অধিকাংশ সমস্যা।

সে সমস্যাটার নাম রক্ষণভাগ। ম্যানচেস্টার সিটির রক্ষণভাগে প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় নেই, এ কথা পুরোনো। ঝামেলা পুরোনো হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সিটি যে পয়েন্ট হারাচ্ছে, তার সবচেয়ে বড় কারণ কিন্তু সেটাই। গার্দিওলার আস্থার দুই সেন্টারব্যাক আয়মেরিক লাপোর্তে আর জন স্টোনসের মধ্যে স্টোনস সদ্যই চোট থেকে ফিরেছেন, ওদিকে গার্দিওলার সবচেয়ে প্রিয় সেন্টারব্যাক আয়মেরিক লাপোর্তে লিগামেন্টের চোটে পড়ে অর্ধ মৌসুমের জন্যই মাঠের বাইরে চলে গিয়েছেন। নিয়মিত সেন্টারব্যাকের মধ্যে বাকি থাকেন নিকোলাস ওটামেন্ডি, যার সামর্থ্য নিয়ে গার্দিওলা নিজেই সন্দিহান। ওটামেন্ডিকে খুব বেশি ‘ঠেকায়’ না পড়লে গার্দিওলা খেলান না। বাকি ছিলেন এক ভিনসেন্ট কম্পানি। সিটির সাবেক এই অধিনায়ক মৌসুমের শুরুতেই ক্লাব ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন নিজ দেশের আন্ডারলেখটে। কম্পানি যাওয়ার পর তাঁর বিকল্প হিসেবে সিটি নতুন কোনো তারকা ডিফেন্ডারকে কেনেনি। আর এটাই হয়েছে বড় ভুল।

লাপোর্তের চোট সমস্যা বাড়িয়েছে সিটির। ছবি : এএফপি
লাপোর্তের চোট সমস্যা বাড়িয়েছে সিটির। ছবি : এএফপি

গত দলবদলে হ্যারি ম্যাগুয়ার, জনি এভান্সদের মতো বেশ কিছু ডিফেন্ডারকে কিনতে চেয়েছিলেন গার্দিওলা। যে কারণেই হোক, পারেননি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেও ম্যাগুয়ারকে পাওয়ার দৌড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে পেরে ওঠেনি সিটি। সে নিয়ে গার্দিওলার খেদও কম ছিল না।

ডিফেন্ডার না থাকার সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য মূল একাদশে কৌশলগত কিছু পরিবর্তন এনেছেন গার্দিওলা। ব্রাজিলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফার্নান্দিনহোকে খেলাচ্ছেন সেন্টারব্যাক হিসেবে। আগে লাপোর্তে থাকলে ফার্নান্দিনহো তাঁর মূল পজিশনে খেলতে পারতেন। রক্ষণভাগ থেকে আক্রমণভাগে নিখুঁত বল পাঠানো আর আক্রমণ গড়ে দেওয়ার কাজটা সুনিপুণভাবে করতেন লাপোর্তে। আর একজন আদর্শ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের মতো ফার্নান্দিনহোর কাজটা হতো প্রতিপক্ষ প্রতি আক্রমণ কখন কীভাবে করবে, সেটা আগে থেকে বুঝে নিয়ে আক্রমণ নস্যাৎ করে দেওয়া, লাপোর্তের সঙ্গে পুনরায় নিজেদের আক্রমণ পেছন থেকে গড়ে দেওয়া। লাপোর্তে (অথবা অন্য কোনো বাঁ পায়ের সেন্টারব্যাক যিনি কি না বল পায়ে স্বচ্ছন্দ) না থাকার কারণে সে কাজ দুটি ভালো ভাবে হচ্ছে না।

লাপোর্তে না থাকায় লাপোর্তের জায়গায় ফার্নান্দিনহো খেলছেন, আর ফার্নান্দিনহোর জায়গায় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলানো হচ্ছে এই মৌসুমেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে দলে আসা রদ্রিকে। রদ্রি দুর্দান্ত একজন ফুটবলার, পাসিং ফুটবলে অনেক স্বচ্ছন্দ, কিন্তু প্রতিপক্ষ প্রতি আক্রমণ করলে বা করার পরিকল্পনা করলে আগে থেকে বুঝে কীভাবে সেটা সামলাতে হয়, সে কৌশল এখনো ফার্নান্দিনহোর মতো ভালো ভাবে রপ্ত করতে পারেননি। ফলে এই দুর্বলতাটা প্রায়ই চোখে পড়ছে। প্রতি আক্রমণে যেসব দল দুর্দান্ত, যেমন—লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা নিদেনপক্ষে নরউইচ সিটি, বিদ্যুৎগতির প্রতি আক্রমণ সামলাতে প্রায়ই খাবি খেতে হচ্ছে রদ্রিকে। এই তিন দলের কাছেই লিগে হেরেছে সিটি। গোল খেয়েছে প্রতি আক্রমণে। যেটা কি না ফার্নান্দিনহো থাকলে অত সহজ হতো না। এ ছাড়া কিছুদিন আগে রদ্রি চোটে পড়েছিলেন। সে চোটের কারণেও নিজের স্বাভাবিক খেলাটা সেভাবে খেলতে পারছেন না।

এই সমস্যা কী গার্দিওলার মতো কোচের চোখে পড়ছে না? অবশ্যই পড়ছে। তবে সে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরও তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন এই স্প্যানিশ কোচ।

রদ্রি যেহেতু একা রক্ষণভাগকে সাহায্য করতে পারছেন না, প্রতি আক্রমণে খেই হারাচ্ছেন, সেহেতু রদ্রিকে সাহায্য করার জন্য একজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে সব সময় একটু নিচে খেলার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন গার্দিওলা। অধিকাংশ সময়ে এই কাজটা করতে হচ্ছে কেভিন ডি ব্রুইনাকে। একটু নিচে নেমে খেলার কারণে আক্রমণভাগের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগটা হচ্ছে না ডি ব্রুইনার।

আক্রমণভাগে লিরয় সানে, সার্জিও আগুয়েরো চোট সমস্যার সঙ্গে লড়ছেন। স্ট্রাইকার হিসেবে আগুয়েরোর বিকল্প হিসেবে যার আলো ছড়ানোর কথা ছিল, ব্রাজিলের সেই স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল জেসুসের ওপর গার্দিওলা আস্থা হারিয়েছেন গত বছরই। গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে বিক্রি করে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লুকা ইয়োভিচকে নিয়ে আসার বড় আশা ছিল গার্দিওলার, ইয়োভিচ খেলেনও অনেকটা আগুয়েরোর মতোই। কিন্তু ইয়োভিচকে পাওয়ার দৌড়ে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি সিটি। ফলে জেসুসও রয়ে গেছেন।

প্রতি আক্রমণ আটকানোয় এখনো স্বচ্ছন্দ নন রদ্রি। ছবি : এএফপি
প্রতি আক্রমণ আটকানোয় এখনো স্বচ্ছন্দ নন রদ্রি। ছবি : এএফপি

কোচের আস্থা ধীরে ধীরে হারাচ্ছেন আরেকজন তারকা। তিনি বেঞ্জামিন মেন্ডি। ফর্মে থাকলে ও সুস্থ থাকলে, সিটির এই লেফটব্যাক বিশ্বের অন্যতম সেরা। মাঠের বাঁ প্রান্ত দিয়ে দুর্দান্ত গতিতে দৌড়ে নিখুঁত ক্রস করতে পারেন, নিয়মিত ওঠানামা করে কার্যকরী পাস দিতে পারেন। সিটিতে আসার পর গত দুই মৌসুমে যখনই সুস্থ থেকেছেন, লেফটব্যাক পজিশন থেকে দলের আক্রমণ ও রক্ষণে ভূমিকা রেখেছেন সমান তালে।

কিন্তু ওই যে, সুস্থ থাকলে! ফরাসি এই লেফটব্যাকের চোটপ্রবণতা এতই বেশি, এক ম্যাচ খেলেন তো দশ ম্যাচ বেঞ্চে কাটাতে হয়। গত বছর হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করার পরেও উন্নতি হয়নি। ফলে মেন্ডির ওপর আস্তে আস্তে ভরসা হারিয়ে ফেলছেন গার্দিওলা। এ ছাড়া মেন্ডির জীবনযাপন নিয়েও গার্দিওলা সন্তুষ্ট নন। এ নিয়ে ফরাসি এই লেফটব্যাককে বেশ কয়েকবার বকাও দিয়েছেন। মেন্ডির জায়গায় আরেকটা লেফটব্যাক দরকার ছিল, উপযুক্ত কাউকে না পেয়ে তাই মেন্ডি ও অনভিজ্ঞ অ্যাঞ্জেলিনোকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে সিটিকে।

মূল কয়েক জন খেলোয়াড়ের ফর্মহীনতাও ভোগাচ্ছে সিটিকে। বার্নার্দো সিলভা গত মৌসুমে ক্লাব ও জাতীয় দল, দুই ক্ষেত্রেই ছিলেন চূড়ান্ত সফল। পর্তুগিজ এই মিডফিল্ডার ক্লাবের হয়ে লিগ জিতেছেন, এফএ কাপ জিতেছেন, ওদিকে জাতীয় দলের হয়ে জিতেছেন নেশনস লিগ। অসম্ভব ব্যস্ত মৌসুম কাটানোর পর বার্নার্দোকে এই মৌসুমের শুরুতে একটু বেশিই ছুটি দিয়েছিলেন গার্দিওলা। আর সেটাই কাল হয়েছে। ছুটি কাটিয়ে বার্নার্দো যখন ফিরলেন, ওজন তত দিনে বেড়ে গেছে কয়েক কেজি, ফিটনেসের মাত্রা নেমেছে কয়েক ধাপ। ফর্মের অবস্থাও যাচ্ছেতাই।

তার ওপর উটকো ঝামেলা হিসেবে জুটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক বিড়ম্বনা। মোনাকো থেকে সিটিতে একসঙ্গে আসা বন্ধু বেঞ্জামিন মেন্ডির গায়ের রং নিয়ে মজা করে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন টুইটারে করেছিলেন বার্নার্দো সিলভা। সেটা নিয়ে মানুষ যে এমন ক্ষেপে যাবে, সেটা ভাবেননি। স্বাভাবিকভাবেই বর্ণবাদী বলে গালি দেওয়া হয়েছে তাঁকে, শাস্তিও জুটেছে কপালে। ফর্মে ফেরার লড়াইটা হয়ে গেছে আরও কঠিন।

অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এই মৌসুমে সিটির বিপক্ষে দলগুলো বেশি ‘সাহসী’ খেলার চেষ্টা করছে। পরিসংখ্যান বলছে, দুই মৌসুম আগেও সিটির প্রতিপক্ষ দলগুলো গড়ে ম্যাচে ২৬১টা সফল পাস দিত। গত মৌসুমে সেটা বেড়ে হয়েছে ৩০৫। এই মৌসুমে সেটা দাঁড়িয়েছে ৩৪০-এ। অর্থাৎ সিটির বিপক্ষে প্রতিপক্ষরা আর গুটিয়ে থাকে না। আক্রমণ করার চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষরা বুঝেছে, রক্ষণের সমস্যায় ভুগছে সিটি, তাই আক্রমণ করতে বাড়তি সুবিধা মিলছে।

গার্দিওলার পরিবার ফিরে গেছে বার্সেলোনায়। ছবি : এএফপি
গার্দিওলার পরিবার ফিরে গেছে বার্সেলোনায়। ছবি : এএফপি

প্রতি আক্রমণ আটকাতে সমস্যা হওয়া ছাড়াও সিটির কৌশলগত আরেকটা সমস্যা হলো, প্রতিপক্ষ নাকমুখ বন্ধ করে রক্ষণ করলে সেটা ভেদ করে গোল করতে পারে না। নিউক্যাসল ইউনাইটেডের কথাই ধরুন, তারা খেলেই ৫-৪-১ ছকে। অর্থাৎ রক্ষণে বলেকয়েই থাকেন ছয় থেকে সাতজন। তাদের রক্ষণের এই বজ্র-আঁটুনি ভাঙতে গত সপ্তাহে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে সিটিকে। তাও লাভ হয়নি। ২-২ গোলে ড্র করেছে তারা।

এই মৌসুম থেকে প্রিমিয়ার লিগে আনা হয়েছে ‘ভিএআর’ প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির ‘সুবিধা’ নিয়ে লিভারপুল ও টটেনহামের মতো দলগুলো সিটির চেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে, গার্দিওলা মানেন সেটা। সিটির খেলোয়াড়দের মধ্যে এটা নিয়েও বিরক্তি কাজ করছে বলে খবর। যদিও পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ভিএআর না থাকলেও লিভারপুল লিগ টেবিলের শীর্ষেই থাকত, সিটি নয়।

এই বছরের শুরুতে গার্দিওলা স্ত্রী ও ছোট মেয়ে ম্যানচেস্টার ছেড়ে আবারও বার্সেলোনায় চলে গিয়েছেন। পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য। ব্যাপারটা গার্দিওলার বিশেষ পছন্দ হয়নি। প্রিয়জন কাছে না থাকার একটা প্রভাব সিটির পারফরম্যান্সে পড়ে থাকলেও থাকতে পারে, কে জানে! যদিও গার্দিওলা বারবার বলেছেন, আগামী কয়েক বছর সিটিতেই থাকতে চান। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, গার্দিওলার সিটি ছাড়ার গুঞ্জন আস্তে আস্তে বাড়ছে। নিজেদের পরবর্তী কোচ হিসেবে জুভেন্টাস বহু আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে গার্দিওলাকে, ওদিকে বায়ার্ন মিউনিখও চায় নিজেদের সাবেক সফল এই কোচকে যেকোনো মূল্যে ফেরাতে। সব মিলিয়ে একটু হলেও সিটিতে দোটানায় আছেন গার্দিওলা।

দোনোমনা কাটিয়ে সিটির সমস্যাগুলোর কার্যকরী সমাধান বের করতে পারবেন তো গার্দিওলা? দেখা যাক!