রক্ত-মাংসের রাসেল যেন মাঠের 'মিস্টার টি'

‘দ্য এ টিমে’র মিস্টার ‘টি’কে মনে পড়ে আন্দ্রে রাসেলকে দেখলে। ফাইল ছবি
‘দ্য এ টিমে’র মিস্টার ‘টি’কে মনে পড়ে আন্দ্রে রাসেলকে দেখলে। ফাইল ছবি

বিশেষ বিপিএল হচ্ছে এবার। কাল দুপুরে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ঢোকার পথে তা বোঝা গেল সামান্যই। শুধু প্রধান প্রবেশদ্বারের পাশে বেশ বড়সড় নিঃসঙ্গ এক ব্যানার। তা পাশ কাটিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতেই ভেসে এল ‌‘ঠাস ঠাস’ আওয়াজ!

না, শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। শব্দটা বল পেটানোর। প্যাভিলিয়ন প্রান্তের পাশেই নেট সেশন চলছিল রাজশাহী রয়্যালসের। ওটাই আওয়াজের উৎপত্তিস্থল। এমনিতে নেট সেশনে ‌‘আই সাইট’ ঠিক করে থাকেন ব্যাটসম্যানেরা। পায়ের মুভমেন্টের সঙ্গে বল ব্যাটের ঠিক জায়গায় লাগছে কি না, সেসব ‘ফাইন টিউন’ করা হয়। টি-টোয়েন্টিতে অবশ্য এসব সেকেলে ব্যাপার মানা হয় খুব কমই।

আউট বাদ দিলে অন্তত ব্যাটসম্যানদের জন্য টি-টোয়েন্টির নেট সেশন অনেকটা ম্যাচের মতোই। বলটা শুধুই পেটানোর। আওয়াজও তাই খানিকটা কর্কশ। মাঠে ঢোকার পর তা যেন একটু বেশিই কানে লাগছিল। ভালো করে তাকাতেই ‘হেতু’ বোঝা গেল, নেটে আন্দ্রে রাসেল! পাশাপাশি দুটি নেট। একটায় রাসেল, অন্যটায় স্থানীয় এক ব্যাটসম্যান। দুটি নেটে বল ব্যাটে লাগার দু-রকম শব্দ। একটা যেন হার্ড রক, আরেকটা ঢিমেতালের পপ।

কোনটা হার্ডরক ধাঁচের তা খোলাসা করে না বললেও চলে। তবে স্থানীয় ব্যাটসম্যানটি মোটেও খারাপ খেলছিলেন না। ভালো বলকে ভালো আদব আর খারাপ বলকে কেতাদুরস্ত চালে খেলছিলেন। দেখতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু চোখটা ওখান থেকে সরিয়ে পাশের নেটে রাখতেই পরিষ্কার হলো বর্তমান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। ভালো বলকে অবলীলায় মাঠের ঠিক উল্টো দিকে প্রেসবক্স প্রান্তে পাঠাচ্ছিলেন রাসেল। হাফ ভলি কিংবা কবজির আওতার মধ্যে পেলে তো কথাই নেই। এর মাঝে দু-একটা ডিফেন্স যেন খানিকটা দম নেওয়ার ফুরসত।

>

চট্টগ্রামে গতকাল রাজশাহী রয়্যালসের নেট অনুশীলনে ঝড় তুলেছিলেন আন্দ্রে রাসেল। ক্যারিবিয়ান তারকার গড়ন ও ‌‘টাফ গাই’সুলভ ব্যাটিং মনে করিয়ে দেয় ‌বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘দ্য এ টিম’-এর চরিত্র মিস্টার টি-কে

দৃষ্টিকটু চেষ্টায় জোর করে মারার প্রবণতাও ছিল। ব্যাটের কানায় লেগে মাথার ওপরেও উঠেছে দু-একটা বল। আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এসব বাছ-বিচারের মূল্য খুব সামান্যই। কীভাবে খেললেন তা দিন শেষে কেউ দেখে না। কত স্ট্রাইকরেটে কত রান উঠল সেটাই মুখ্য। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এ মুখ্য ব্যাপারটিই নেটে ফাইন টিউন করে নিচ্ছিলেন রাসেল।

তাতে কিছুক্ষণ পর পরই ভেসে আসছিল ক্রিকেটারদের সতর্কবার্তা, ওয়াচ ইট! আসলে বলে চোখ রাখার এ বাণীটা ব্যাটসম্যান কিংবা ফিল্ডারদের জন্য ছিল না। মাঠের এক প্রান্তে খুলনা টাইগার্সের ক্রিকেটাররাও অনুশীলন করছিলেন। এ ছাড়াও মাঠকর্মী থেকে সংবাদকর্মীদের আনাগোনায় বেশ ভালোই ভিড় ছিল।। বলের বেমক্কা আঘাতে কেউ যেন আহত না হয় সে জন্যই ওই সতর্কবার্তা, ওয়াচ ইট। বলা বাহুল্য, রাসেল নেটে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ এ শব্দযুগল উচ্চারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। রাসেল নেট থেকে বেরিয়ে আসার পর কমেছে ব্যাটে বল লাগার শব্দ ও সাবধানবাণীর দমক।

কিন্তু রাসেল ক্ষান্ত হননি। ব্যাট-প্যাড রেখে বেশ ওজনদার বড় একটা বল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করলেন। বোঝা গেল, দুই হাত আরেকটু ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। মাত্রাটা ধীরে ধীরে বাড়ানোর পর শরীরটা কুল ডাউন করলেন নিজে নিজেই। এরপর মাঠের এক কোণে গিয়ে বাম পা নিয়ে পড়লেন নিজের ব্যক্তিগত ফিজিও এভেরাল্ড এডি এডওয়ার্ডসের সঙ্গে। রাসেলের পায়ের চোট নিয়ে সমস্যাটা আজকের না। তাঁর সতীর্থ লিটন দাস কালই জানিয়েছেন, ‘রাসেল এ পায়ের চোট নিয়েই খেলে আসছেন। এটা কোনো সমস্যা না।’
সে ক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিষ্কার, ভালো করার খিদেটা অপরিমিত হলেই কেবল দীর্ঘস্থায়ী চোট নিয়েও অমন নেট সেশন কিংবা ম্যাচে অমন অবিশ্বাস্য সব শট খেলা যায়। তাঁর অবিশ্বাস্য ক্যাচগুলোর কথা না হয় তোলাই থাক।

রাজশাহীর নেট সেশন শেষের দিকে তাইজুল ইসলামের সঙ্গে যেন কী নিয়ে কথা বলছিলেন মোহাম্মদ নওয়াজ। দুজনেই বাঁ হাতি স্পিনার। দূর থেকে দেখা গেল, তাইজুল আঙুলের গ্রিপ দেখিয়ে কী যেন বোঝাচ্ছিলেন নওয়াজকে। পাকিস্তানি স্পিনার মাঠ ছাড়ার সময় জানা গেল ভেতরের রহস্য। তাইজুল ও নওয়াজ মিলে নেটে বল করেছেন রাসেলকে। তাঁকে কে আউট করতে পারে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল দুই স্পিনারের। নওয়াজ জানালেন, তাইজুল সে লড়াইয়ে জয়ী।

সতীর্থকে নেটে আউট করার এ প্রতিযোগিতা, এবং তা করতে পেরে নেট সেশন শেষে আত্মতৃপ্তির হাসি কিংবা যে পারেনি তাঁর শেখার চেষ্টা, এসবই আসলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রাসেলের প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রমাণ। ঠিক যেমনটা ছিল পর্দার এক চরিত্রের। ‘মিস্টার টি’—আশির দশকের টিভি সিরিজ ‌‘দ্য এ টিম’ দেখে থাকলে নামটা মনে পড়ার কথা।

মিস্টার টি গড়নে প্রায় রাসেলের মতোই। তবে উচ্চতায় কিছুটা খাটো। সাবেক রেসলার বি.এ বারাকাস অভিনয় করেছিলেন সে চরিত্রে। ক্যারিবিয়ান তারকার মতোই চুলের ছাঁট ছিল মিস্টার টি-র। আপাতদৃষ্টিতে তা ‌‘মোহাক’ ছাঁট মনে হলেও সেটি আসলে পশ্চিম আফ্রিকার যোদ্ধা আদিবাসী মান্দিনকাদের কাছ থেকে নেওয়া। গলায় ভারী চেইন পরতে পছন্দ করেন দুজনেই। আর পর্দার মিস্টার টি যেমন ‌'টাফ গাই' রাসেলও ক্রিকেট মাঠে ঠিক তাই, অন্তত বোলারদের কাছে। দুজনেই মারতে ভালোবাসেন। দুজনেই কিন্তু তাঁদের ঘরানার দর্শকদের বিনোদনের খোরাক।

বিপিএলে কি আজ পর্দা উঠবে তেমন বিনোদনের? ক্যারিবিয়ান তারকা যে এখনো ব্যাট করার সুযোগ-ই পাননি! আজ পেলে ক্রিকেট মাঠের ‘মিস্টার টি’-কে স্বরূপে দেখা যাবে তো?