ডি ভিলিয়ার্সের মতো মুশফিকও '৩৬০ ডিগ্রি'

আজ মাঠের চারপাশে শট খেলেছেন মুশফিক। ছবি: প্রথম আলো
আজ মাঠের চারপাশে শট খেলেছেন মুশফিক। ছবি: প্রথম আলো
>মুশফিকুর রহিমকে ৩৬০ ডিগ্রি খেলোয়াড় বললেন খুলনা টাইগার্সের কোচ জেমস ফস্টার।

জয়ের জন্য ৪ রান দরকার শেষ ওভারে। সেঞ্চুরি হতে মুশফিকুর রহিমের লাগবে ৫ রান। স্ট্রাইকেও মুশফিক। এমন মধুমাখা মুহূর্তে কল্পনায় আসতেই পারে, ছক্কা মেরে মুশফিক ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে জেতাবেন খুলনা টাইগার্সকেও। না, এবার আর আবেগকে পাত্তা দেননি মুশফিক। প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে বদল করলেন প্রান্ত। পরের বলেও ১ রান আসায় আবার স্ট্রাইকে মুশফিক। এবার সমীকরণ ৪ বলে ২। ধাক্কাটা লাগল ঠিক তখনই।

বিপিএলে রবি বোপারার ঝুলিয়ে দেওয়া ফুলটস নিজের অন্যতম শক্তির জায়গা মিড উইকেট দিয়ে পার করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন মুশফিক। শেষ ওভারের আগে খুলনার ইনিংসটা না দেখে থাকলে ভেবে নেওয়াই যায়, চাপের মুহূর্তে আরও একবার উইকেট দিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এ ব্যাটসম্যান। কিন্তু মুশফিকের গোটা ইনিংসটা দেখা থাকলে আর কিছু না, স্রেফ টুপি খোলা অভিনন্দনের সঙ্গে করতালিই প্রাপ্য। রবি ফ্রাইলিংক চতুর্থ বলে চার মেরে শুধু জয়ের আনুষ্ঠানিকতাই সেরেছেন। ওদিকে খুলনার গ্যালারিতে ক্রিকেটারেরা জড়িয়ে ধরেছেন ম্যাচের নায়ককে। মুশফিক ছাড়া আর কে!

জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সন্ধ্যা লাগোয়া সময়ে বেড়েছে দর্শকসংখ্যা। মুশফিক তাদের পয়সা উশুল করেছেন একাই। রাজশাহী রয়্যালসের হয়ে শোয়েব মালিকের ৮৭ রানের ইনিংস ছিল। তা প্রথাগত সব ক্রিকেটীয় শট খেলেই। কিন্তু মুশফিকের ইনিংসটা যেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘সাইনবোর্ড’। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে লেগ স্পিনারকে স্কুপ করেছেন, ছিল কয়েকটি রিভার্স সুইপ। আর মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা মারার চিরায়ত দৃশ্য তো ছিলই। সব মিলিয়ে শট খেলেছেন উইকেটের চারপাশেই। তাতে ৪ ছক্কা ও ৯ চারে ৫১ বলে ৯৬। টি-টোয়েন্টিতে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ মুশফিকের থাকতেই পারে। তবে দুই দলের কোচের কথা শুনলে মুশফিকের এ আক্ষেপ কিছুটা হলেও ঘুচে যাওয়ার কথা।

সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে এলেন রাজশাহী কোচ ওয়াইজ শাহ। ১৮৯ রান তুলেও জিততে না পারার রেশ ছিল পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এ ইংরেজের চোখেমুখে। আর কয়েকটি রান কম করার আক্ষেপ করে তিনি নিজেই তুললেন মুশফিকের প্রসঙ্গ। ঠিক তখনই রাজশাহী কোচের মুখের রেখাচিত্রও পাল্টে গেল। মুখটা উজ্জ্বল করে বললেন, ‌‘মুশফিক অবিশ্বাস্য ব্যাট করেছে। অসাধারণ ইনিংস। গতি ছিল। চাপে এতটুকু ভড়কে যায়নি। ইনিংস কীভাবে গড়তে হয় সে দেখিয়েছে। জুটি গড়েছে। রাইলিকে (রুশো) হারানোর পরও থামেনি। প্রতিপক্ষকে চড়ে বসতে দেয়নি। আসলে প্রতিপক্ষ ভালো খেললে কখনো কখনো টুপি খোলা অভিনন্দন জানাতে হয়।’

ওয়াইজ শাহ কথা শেষ করার আগেই সংবাদ সম্মেলন কক্ষে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন খুলনার কোচ জেমস ফস্টার। প্রতিপক্ষ দলের কোচ চলে যাওয়ার পর ফস্টার আসন নিয়েই স্তুতি বাক্যে ভাসিয়ে দিলেন মুশফিককে, ‘আজ আমাদের হয়ে মুশি খেলেছে। এটি ছিল আমার দেখা অন্যতম সেরা টি-টোয়েন্টি ইনিংস। বিশেষ করে রান তাড়ায় পাওয়ার প্লের মধ্যেই ২ উইকেট হারানো, সেখান থেকে সত্যিই অসাধারণ এক ইনিংস।’

১৮৯ রান তাড়া করতে নেমে তৃতীয় ওভারের মধ্যে দুই ওপেনারকে হারিয়ে বসে খুলনা। এই চাপ থেকে দলকে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন মুশফিক। ম্যাচটা তাঁর শেষ করে আসা উচিত ছিল কি না, এ প্রশ্ন উঠতেই খুলনা কোচ অনেকটাই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার সুরে বললেন, ‘এটা অসাধারণ এক ইনিংস। এমন ইনিংস সব সময় খেলা যায় না। সত্যিকারের ম্যাচ জেতানো ইনিংস।’

মুশফিকের শট সিলেকশন, উইকেটের চারপাশেই খেলা, এসব নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁকে অবিশ্বাস্য এক তকমাই দিয়ে বসলেন ফস্টার, ‘মুশি খুবই উঁচুমানের খেলোয়াড়। পরিস্থিতি এবং কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। তার হাতে অনেক শট আছে। খেলতে পারে উইকেটের চারপাশেই। সে ৩৬০ ডিগ্রি খেলোয়াড়। গত কয়েক বছর খুলনা টাইটানসে যখন ছিলাম তখন তাকে বল করার পরিকল্পনা করা ছিল ভীষণ অসুবিধার। শক্তি রাখার পাশাপাশি টাচেও খেলতে পারে। সে একটা পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ।’

গোটা ক্রিকেট দুনিয়া জানে ৩৬০ ডিগ্রির ব্যাটসম্যান একজনই। এবি ডি ভিলিয়ার্স। তার কথা মনে করিয়ে দিতেই নিজের মন্তব্যের পক্ষে থেকে ব্যাখ্যা দিলেন খুলনা কোচ, ‘আমি বলেছি সে ৩৬০ ডিগ্রির খেলোয়াড়। মাঠের চারপাশেই খেলতে পারে। মিড উইকেট থেকে মিড অফ। সোজা খেলা কঠিন হলে স্কুপ করে। আবার একই বলে স্ট্রেটেও খেলতে পারে। এটা শুধু ভাগ্যের জোরে হয় না। অনেক পরিশ্রম ও দক্ষতা লাগে।’

ফস্টার এখানেই থামেননি। মনে করিয়ে দিলেন আর দশটা ক্রিকেটারের সঙ্গে মুশফিকের পার্থক্যও, ‘সবারই বল মারার নিজস্ব ভঙ্গি আছে। কিন্তু সে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা। যখন বাকিরা পারে না তখন মুশফিক পারে।’

মুশফিক যে ৯টি চার মেরেছেন সবগুলোই পয়েন্ট থেকে ব্যাটসম্যানের পেছন দিক দিয়ে ঘুরে মিড উইকেট অঞ্চলের মধ্যে। ছক্কাগুলো সবই লেগ সাইডে। আর সিঙ্গেলস, ডাবলস ছিল উইকেটের চারপাশেই। দল জেতায় সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপটা মুশফিকের হয়তো এমনিতেই থাকবে না। তাহলে দুই কোচের এসব বিশেষণ তাঁর জন্য ‘বোনাস’। ওদিকে দর্শকেরাও বোনাস পেলেন মুশফিকের কাছ থেকে। বাংলাদেশের ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটসম্যান!