মুশফিকের অনুশীলনে একদিন...

গতকাল চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খুলনা টাইগার্সের অনুশীলনে মুশফিকুর রহিম। ছবি: শামসুল হক
গতকাল চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খুলনা টাইগার্সের অনুশীলনে মুশফিকুর রহিম। ছবি: শামসুল হক
>

বিপিএলে আজ রংপুর রেঞ্জার্সের মুখোমুখি হবে খুলনা টাইগার্স। কাল জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খুলনার অনুশীলনে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। কেমন হয় মুশফিকের অনুশীলন?

‘কী, টায়ার্ড লাগছে? শক্তি পাচ্ছ না?’

কথাটা মুশফিকুর রহিমের। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর আসি আসি করছে। নেটের খুদে বোলারটি থ্রো-ডাউন (হাত দিয়ে বল ছোড়া) করে মুশফিকের প্রত্যাশিত লেংথে বল করতে পারছিলেন না। কত-ই বা করা যায়! মুশফিক সম্ভবত তা বুঝতে পেরেই আর কয়েকটি বল খেলার পর ছেলেটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হলেন নেট থেকে। শেষ হলো আরেকটি দিন।

কাল দিনের শুরুটা ছিল কুয়াশাময়। খুলনা টাইগার্সের অনুশীলন শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১১টায়। হুট করেই জাঁকিয়ে বসেছে শীত। মাথার ওপর সূর্য উঁকি দিচ্ছে তো দিচ্ছে না। এমন কন্ডিশন পেস বোলিংয়ের জন্য আদর্শ হলেও অনুশীলনের জন্য একটু কষ্টকর। বেমক্কা হাতে-পায়ে লেগে গেলে ভোগান্তি বাড়ে। গা গরম করে নিলে অবশ্য স্বাভাবিক থাকা যায়। খুলনার কোচ জেমস ফস্টার তাই সবার আগে স্ট্রেচিং করিয়ে হাত-পা ছাড়িয়ে নিলেন ক্রিকেটারদের। এরপর চলল ফুটবল খেলা।

আধুনিক ক্রিকেটের অনুশীলনে ফুটবল খেলার চল নতুন কিছু না। খুব অল্প সময়েই গা গরম হয়। পাসের আদান-প্রদানে সতীর্থদের সঙ্গে সম্প্রীতি বাড়ে অলক্ষ্যেই। মুশফিক তাতে সবার চেয়ে একটু বেশিই মনোযোগী। ভুল পাসে যেমন হতাশ, তেমনি গোলের উদ্‌যাপনে শিশুসুলভ সরলতা। সেটি ‘প্রতিপক্ষ’ গোল দিলেও।পায়ের কাজও দেখা গেল খানিকটা। প্রায় আধঘণ্টার মতো ফুটবলচর্চায় মুশফিক একবারের জন্যও ক্লান্তিতে বসে পড়েননি। খেলা শেষে দলের তাঁবুতে ফিরে সাজ নিলেন আজকের যুদ্ধের মহড়ার। প্যাড, থাই প্যাড, এলবো গার্ড, হেলমেট ও দুটো ব্যাট। সবার আগে চলে গেলেন প্যাভিলিয়ন প্রান্তে ডান দিকের নেটে।

আকাশে তখন সূর্যের হাসি। নেটের এক প্রান্তে ডকস্টিক হাতে প্রস্তুত স্থানীয় কোচ হুমায়ুন কবীর। মুশফিক নেটে ঢুকে স্টান্স নিয়ে কোচকে অনুরোধ করলেন, সামনে বল ফেলতে। মানে ব্যাটের সামনে। কোচের ডকস্টিকে আটকানো বলটি পুরোনো হয়নি। চকচকে না হলেও ঔজ্জ্বল্য হারায়নি আশপাশের জমানো বলগুলোও। বোঝা গেল, মুশফিক ম্যাচের পরিস্থিতি চাচ্ছেন।

সাধারণত চারে ব্যাটিং করলেও ইনিংসের শুরুতে নামা মুশফিকের জন্য নতুন কিছু না। বাংলাদেশ দল থেকে বিপিএলের দল কিংবা অন্যান্য জায়গাতেও আগেভাগে উইকেট পড়লে নতুন বল খেলতে হয় মুশফিককে। সচল রাখতে হয় রানের চাকাও। সেটি অবশ্যই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে নিচে খেলে। এ কারণেই হুমায়ুন কবীরের বলেছিলেন সামনে বল ফেলতে। কারণ নতুন বলে বোলাররা ফুল লেংথে বল করে সুইং পেতে চান। ব্যাটসম্যান ড্রাইভ খেলতে গিয়ে সুইংয়ে 'বিট' হয়ে যেন ক্যাচ দেন, এটাই লক্ষ্য। মুশফিক ঠিক এ জায়গাতেই টেকনিক ঘষামাজা করতে সামনে ফেলা বলগুলো ড্রাইভ ও কাট খেলতে থাকলেন সপাটে। মাঝ ব্যাটে লাগল বেশির ভাগই। বিট-ও হলেন দু-একটি। মাথা নাড়লেন হতাশায়। এভাবে চলল প্রায় আধঘণ্টা।

ততক্ষণে মোহাম্মদ আমির ও রবি ফ্রাইলিঙ্ক তৈরি। এবার বিপিএলে খুলনার নতুন বলের দুই পেসার। আমিরের আছে সুইংয়ে সঙ্গে গতি, ফ্রাইলিঙ্কের সিম মুভমেন্ট ও লেংথ থেকে বাউন্স তোলার ক্ষমতা। প্রথম বলটা আমিরই করলেন, দৌড়ে এসে ছাড়লেন শুধু সিমের ওপর। এরপর গতি বাড়ালেন ধীরে ধীরে। ফ্রাইলিঙ্ক খুঁজতে থাকলেন মুশফিকের সামনে নিজের পছন্দের স্পট। সবই হলো, কিন্তু এ দুই বোলার যে কাজটি প্রায় করতেই পারলেন না তা হলো, অফ স্টাম্পের বাইরের বলে মুশফিককে পরাস্ত করা।

স্টাম্পের ভেতরে ফেলা বলগুলো ম্যাচের মতোই সোজা ব্যাটে, কখনো অনসাইডে আবার কখনো স্ট্রেটে তুলে খেলেছেন মুশফিক। স্ট্রেটে তোলার পর আনমনেই বলেছেন, ‘ওভার দ্য টপ।’ পাওয়ার প্লে-তে যেহেতু স্ট্রেটের ফিল্ডার সামনে থাকে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ব্যাট করার পর মুশফিক চলে গেলেন পাশের নেটে। সেখানে তৈরি অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ, বাঁ হাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম, লেগ স্পিনার আমিনুল ইসলাম এবং আরেক অফ স্পিনার আলিস আল ইসলাম। অজন্তা মেন্ডিসের মতো আঙুলের টোকায় বল এদিক-সেদিক করান এই আলিস।

নেটের এই চার রকম স্পিনার কম বেশি থাকে প্রায় প্রতি দলেই। রাইলি রুশোকে সঙ্গে নিয়ে মুশফিক তাঁদের খেললেন ম্যাচের পরিস্থিতি মেনে। স্পিনাররা ইনিংসের মাঝের ওভারে এলে যেভাবে খেলে থাকেন। পায়ের কাজে খেললেন উইকেটের চারপাশেই। ফুল স্ট্রেট ড্রাইভ, পুশ, ডাউন দ্য উইকেট, ব্যাকফুট ড্রাইভ কিংবা কবজির মোচড়ে অনসাইডে খেলা, কী ছিল না!

ভুল যে একেবারেই করেননি তা নয়। আলিসকে যেমন হাঁটু গেড়ে অনসাইডে মারতে গিয়ে মাথার ওপর তুললেন বল। আবারও সেই হতাশায় মাথা ঝাঁকানো, নিজের ওপর অসন্তুষ্টি এবং পুনরায় স্টান্স নেওয়া।

এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা চলল মুশফিকের নেট সেশন। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন মাঝমাঠে। সঙ্গে নিলেন সেই খুদে বোলারটিকে। অর্ধেক পিচ থেকে ছেলেটি ফুল টস ছুড়ে দিচ্ছিল মুশফিকের হাঁটু ও কোমরের মাঝ বরাবর। মিড উইকেট দিয়ে আড়াআড়ি চালিয়ে সীমানা পার করার চেষ্টা করছিলেন মুশফিক। কিছু মনে পড়ল কি?

রাজশাহী রয়্যালসের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে শেষ ৪ বলে ২ রান দরকার ছিল খুলনার। রবি বোপারার সে ওভারে তৃতীয় বলে লো ফুল টস ডেলিভারি মিড উইকেট দিয়ে সীমানাছাড়া করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন মুশফিক। সেটাই ঠিক করে নিতে এ অনুশীলন। তা শেষ করে খুদে বোলারটিকে নিয়ে মুশফিক চলে গেলেন প্রেসবক্সের ডান পাশের নেটে। সেখানে 'নক' করলেন বেশ কিছুক্ষণ। সব শটই খেললেন নিচে। থামার আগে ‘বেসিক’ ঠিকঠাক রাখতে ‘ফাইন টিউন’ করা আরকি।

মুশফিক ব্যাটিং থামিয়েছেন ঠিকই তবে অনুশীলন থামেনি। ব্যাটিং গ্লাভস রেখে পরলেন কিপিং গ্লাভস। কোচকে সঙ্গে নিয়ে চলল স্টাম্পিং এবং স্পিনে হাত-পায়ের মুভমেন্টের কসরত। তখন আমিনুল ইসলামের একটি কথা স্মরণযোগ্য। নেট সেশন শেষে মুশফিক বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘এমন মাস্টারক্লাস, যারা স্পিন ভালো খেলে আরকি তাদের বিপক্ষে বল করা চ্যালেঞ্জিং। সবাই জানে মুশফিক ভাই ৩৬০ ডিগ্রি, উনি সব দিকেই ভালো খেলেন।’

আমিনুলের কথাটা মুশফিকের ব্যাটিং নিয়ে। এ কথার ব্যাপ্তি আরেক ধাপ প্রসারিত করে কিপিংয়ে টেনে নেওয়ার সময় সম্ভবত আসেনি। কিন্তু চেষ্টার যে নির্জন-স্বাক্ষর তিনি প্রতিনিয়ত রেখে চলেছেন অনুশীলনে, তার দাম কোন মোহরে মেলে?

রান নয়, ক্যাচ নয়, স্টাম্পিং-ও নয়; চামড়ায় মোড়ানো বলটাই সম্ভবত মুশফিকের মোহর। কী ব্যাটিং, কী কিপিং, চোখটা তো সব সময় বলেই রাখতে হয়।