'তামিম আমাকে মারতে পারেন না'

কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের অনুশীলনে আফগান স্পিনার মুজিব উর রেহমান। ছবি: প্রথম আলো
কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের অনুশীলনে আফগান স্পিনার মুজিব উর রেহমান। ছবি: প্রথম আলো
>এবারের বিপিএলের দুই ম্যাচে কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের আফগান স্পিনার মুজিব উর রেহমানের ১৩ বলে ৮ রান নিতে পেরেছেন তামিম ইকবাল। ৮ রানই এসেছে সিঙ্গেল থেকে।

ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ। জবাব এল, থ্যাংকস। এরপরই বললেন, ইংরেজি কিন্তু ভালো পারি না।

খেলাধুলায় নির্দিষ্ট কোনো ভাষা পারতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। নিজের আঙিনার ভাষা ঠিকঠাকমতো পারলেই চলে। সেটি নিজের খেলার ভাষা। মাঠের কাজটা ঠিকমতো করতে পারাই যার যার খেলার ভাষা। এ কাজে যে যত দক্ষ, তাঁর ‘ভাষা’ তত ভালো। সে ক্ষেত্রে ‘ভাষাবিদ’ হিসেবে মুজিব উর রেহমানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আপাতত এটুকু বলাই যায়।

প্রতিপক্ষের ক্ষেত্রে আবার উল্টোটা ঘটে। বাইশ গজের লড়াইয়ে আফগান ‘রহস্য’ স্পিনারের জুতসই ‘ভাষা’ পড়তে অনেকের ঘাম ছুটে যায়। কুমিল্লার নেট সেশনে পরশুর ঘটনা। প্রেসবক্স প্রান্তের নেটে ব্যাট করছিলেন সৌম্য সরকার। আল আমিন হোসেনের সঙ্গে বল করছিলেন মুজিব। পায়ের সামনে ফুল লেংথ বরাবর ফেলা মুজিবের প্রায় সবগুলো ডেলিভারিই ভালোমতো পড়েছেন সৌম্য। মাঝ ব্যাটে তুলে খেলা সৌম্যকে বেশ সন্তুষ্টই মনে হচ্ছিল।

কিন্তু তাঁর লেংথ ডেলিভারি পড়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। দু-একটা তো দুর্বোধ্য! কুইক আর্ম অ্যাকশনের জন্য বলটা কী হবে তা আঙুল থেকে পড়াও কঠিন। অফ স্পিন, গুগলি, ক্যারম আর লেগ ব্রেকও দেখা গেল। আর নতুন বলে যে ইনসুইং করে ভেতরে ঢোকাতে পারেন তা মোটামুটি সবারই জানা।

সৌম্যর চেষ্টার কমতি ছিল না। কখনো সামনের পায়ে, কখনো পেছনের পায়ে খেলেছেন রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে। দু-একবার ব্যাটে পেলেন না। মুজিবের মুখ উজ্জ্বল। তাঁর আঙুল থেকে বেরোনো ডেলিভারিগুলো অনেকটা ‘হিস হিস’ শব্দ তুলে পড়ছিল নেটের উইকেটের। নতুন বল একটু জোরের ওপর করায় দু-একটা সুইং-ও হচ্ছিল। এর মাঝে এক ফাঁকে সৌম্যর নেটের পাশ ঘুরে গেলেন তামিম ইকবাল।

তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল না, পরদিন কুমিল্লার বিপক্ষে ঢাকা প্লাটুনের হয়ে তামিম মাঠে নামবেন কি না। তাঁর দলই নিশ্চিত হয়েছে কাল সকালে। কিন্তু সেদিন দুই দলের অনুশীলন দেখে পরদিনের কল্পিত ‘খণ্ডযুদ্ধ’টা আঁচ করা যাচ্ছিল, তামিম বনাম মুজিব। ভাইরাল জ্বর থেকে ওঠা তামিম যদি খেলেন অবশ্যই সে শর্ত মেনে।

তামিম শেষ পর্যন্ত কাল খেলেছেন। তবে মুজিব তামিমকে নিয়ে কথা বলেছেন তার আগের দিন মানে গত পরশু। নেট সেশন শেষে কুল ডাউন করে ড্রেসিং রুমে ফেরার পথে কথা হলো ১৮ বছর বয়সী এ স্পিনারের সঙ্গে। ইনিংসের শুরুতে বল করায় তামিম তাঁর বিপক্ষে বেশ কয়েকবার স্ট্রাইক নেননি। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ এই বিপিএলেই ঢাকা পর্বে কুমিল্লা-ঢাকা ম্যাচ। কাল চট্টগ্রামে কুমিল্লার বোলিংয়ের শুরু করেছেন অফ স্পিনার রবিউল ইসলাম, স্ট্রাইক নিয়েছিলেন তামিম।

বাংলাদেশি ওপেনার তাঁর বিপক্ষে বেশ কয়েকবার স্ট্রাইক নেননি, কথাটা মনে করিয়ে দিতেই হাসি ফুটল মুজিবের মুখে। এরপর বললেন, ‘তামিম আমাকে মারতে পারেন না। অন্য বোলাররা আসলে ওদের মারার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার প্রতিটি বল তিনি ঠেকান। তিনি আমাকে মারেনই না।’

ব্যাটসম্যানদের সমীহ যেকোনো বোলারের জন্যই সন্তুষ্টির। সেখানে তামিমের মতো ব্যাটসম্যানের সমীহ মুজিব কতটা উপভোগ করেন? সেটি বোঝা গেল মুজিবের হাসিমুখের জবাবে, ‘হ্যাঁ, আমি খুশি। যখন তামিম আমাকে ডট দেন, আমি খুব খুশি।’ কাল মুজিবের ৩ ওভার পর্যন্ত উইকেটে ছিলেন তামিম। স্ট্রাইক পেয়েছেন তাঁর ৮ বলে, নিয়েছেন ৩ রান। যে বিষয়টি নজর কাড়ল, তামিমকে প্রায় সবগুলো ডেলিভারিই লেংথে করেছেন মুজিব। ছিল ভেতরে-বাইরে খেলানোর বৈচিত্র্যও।

মুজিবের প্রথম ওভারে ৩ বল খেলে ২ রান নেন তামিম। কিন্তু ওই ওভারে সব মিলিয়ে উঠেছে ৯ রান। তাঁর পরের ওভারে ৫ বল খেলে নিয়েছেন ১ রান।
সেটি ছিল ঢাকার ইনিংসে ষষ্ঠ ওভার। ওই ওভারে সব মিলিয়ে ২ রান উঠলেও তখন ঢাকার ওভারপ্রতি রান ছিল ১০.৩৩।

পাল্টা যুক্তি হতে পারে, মেহেদী হাসান তখন রানের গতি বাড়ানোয় এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন তামিম। আর সবে ভাইরাল জ্বর থেকে ওঠায় পুরো ফিট ছিলেন কি না, সে প্রশ্নও রাখবেন অনেকে। মুজিবের তৃতীয় ওভারে স্ট্রাইক পাননি তামিম। তবে পরশু ঢাকার অনুশীলনে তামিমের দু-একটি কথা বিপরীত প্রশ্নও তোলে। মুজিবকে সামলাতে ম্যাচের আগের তিন দিন ধরে টেপ টেনিস অনুশীলন করেছে ঢাকা। তামিম নিজেও পরশু টেপ টেনিসে ‘নক’ করেছেন। টেনিস বলে পুরো টেপ না পেঁচিয়ে কিছু অংশ খালি রাখা হয়। এতে বল ছুড়লে তা বাতাসেই ভেতরে-বাইরে সুইং করে।

তামিম টেপ টেনিসে নক করার একপর্যায়ে একটি বল তুলে মারলে এনামুল হক তাঁকে বলছিলেন, ‘ম্যাচে তো এমন খেলবেন না।’ হাত দিয়ে লেগে ও অফ সাইডে ডিফেন্স করার ভঙ্গি দেখিয়ে এনামুলের রসিকতা ‘খালি তো এমন করবেন।’ তামিমের পাল্টা জবাব, ‘১৬ ওভার তো আছে।’ অর্থাৎ মুজিবের ৪ ওভারের চড়াও হবেন না? জবাবটা কালকের ম্যাচে। তার আগের দিন মুজিবকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঢাকা কিন্তু আপনাকে খেলতে টেপ টেনিস অনুশীলন করছে। আফগান ডান হাতি স্পিনারের জবাব, ‘আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছি ওদের জন্য। প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করে যাচ্ছি আমি। ওরা যদি আমার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিয়ে থাকে, আমিও তাদের জন্য প্রস্তুতি নেই।’

মুজিব তাঁর প্রস্তুতিতে কতটা সফল, সেই প্রমাণ কালকের ম্যাচে তাঁর বোলিং ফিগার, ৪-১-২২-২। জাগিয়ে তুলেছিলেন হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাও। তবে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা তাঁকে ভয় পায় কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মুজিব বার কয়েক মাথা নেড়ে বললেন, ‘না না, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ভালো। উইকেট ভালো এখানে। বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণ আছে আমার, ভালো বোলিং করলে সাফল্য তো আসবেই।’

মাঠে একজন ক্রিকেটারের ‘ভাষা’টা অনূদিত হলো মুজিবের শেষ কথায়। ভালো করলে সাফল্য আসবেই!

(মুজিব উর রেহমানের সাক্ষাৎকার পড়ুন আজ খেলার পাতায়)