এই দশক লেখা থাকবে কোহলির নামে

এই দশকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোহলির চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি কেউ। ছবি: এএফপি
এই দশকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোহলির চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি কেউ। ছবি: এএফপি
>শেষ হতে চলেছে আরেকটি দশক। বিদায়বেলায় তাই চলছে চলতি দশকের সালতামামি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দিকে তাকালে সবার আগে চোখে পড়বে একটিই নাম, ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি। গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি আর কোনো ব্যাটসম্যান। কোহলিই ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি নির্দিষ্ট একটি দশকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০ হাজারের বেশি রান করেছেন।

চলতি দশক যখন শুরু হয়, বিরাট কোহলিকে তখন মনে করা হতো বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রতিভাবান উদীয়মান তারকা। খেলেছেন মোটে ১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, নামের পাশে একটিমাত্র সেঞ্চুরি। আরেকটি দশক শেষ হতে বাকি আর কয়েকটি দিন। দীর্ঘ ১০ বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক ক্রিকেটারের উত্থানের সাক্ষী হয়েছে। তবে এই দশককে যদি এক কথায় প্রকাশ করতে বলা হয়, নিশ্চিতভাবেই সেটি হবে ‘বিরাট কোহলির দশক’। নির্দিষ্ট একটি দশকে তাঁর মতো এত কর্তৃত্ব কেই–বা কবে দেখিয়েছেন!

দশক শেষে সালতামামি করতে বসলে সবার আগে যে নামটি চোখে পড়বে, সেটি বিরাট কোহলি। ব্যাটিংয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, মনের অজান্তে হলেও ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটি মুখ ফুটে বের হয়ে যেতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক দশকে ২০ হাজার রান করার রেকর্ড ছিল না ইতিহাসের কোনো ব্যাটসম্যানের। কোহলি সেই ইতিহাস লিখেছেন নতুন করে। ২০১০ থেকে ২০১৯—১০ বছরে ৩৮৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে কোহলি রান করেছেন ২০৯৬০! সেঞ্চুরি করেছেন ৬৯টি। দশকজুড়ে কতটা অবিশ্বাস্য রকমের ধারাবাহিক ছিল কোহলির ব্যাট, সেটি বোঝা যাবে কেবল একটি তথ্যেই। দশকের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন যিনি, সেই হাশিম আমলার রান ১৫১৮৫, কোহলির চেয়ে ৫৭৭৫ রান কম!

কোহলি-আমলার পর চলতি দশকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করা তিন ব্যাটসম্যান হলেন জো রুট, কেন উইলিয়ামসন ও ডেভিড ওয়ার্নার। রুটের সংগ্রহ ১৪০৩১ রান, উইলিয়ামসনের ১৪০০৭ রান ও ওয়ার্নারের ১৩৬৯৯ রান। তিনজনের সামনেই অবশ্য সুযোগ আছে রানটা আরেকটু বাড়িয়ে নেওয়ার। আগামীকাল শুরু বক্সিং ডে টেস্টে মাঠে নামবেন তিনজনই।

সংস্করণ যেটিই হোক, কোহলির ব্যাট হেসেছে সমানভাবে। চলতি দশকে কোহলি টেস্ট খেলেছেন ৮৪টি। ৫৪.৯৭ গড়ে রান করেছেন ৭২০২। এই দশকে টেস্ট ক্রিকেটে কোহলির চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল দুজন ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ডের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক ও বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক জো রুট। কোহলির চেয়ে ২৭ টেস্ট বেশি খেলে কুকের রান মাত্র ১৬১৬ বেশি। আর রুট ৪ টেস্ট বেশি খেলে মাত্র ৮০ রান বেশি করেছেন।

তবে সেঞ্চুরির দিক থেকে কোহলিই শীর্ষে। দশকে সর্বোচ্চ ২৭টি টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন কোহলি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্টিভ স্মিথের অবশ্য সুযোগ থাকছে কোহলিকে টপকে যাওয়ার। ২৬ সেঞ্চুরি নিয়ে আপাতত দুইয়ে থাকা স্মিথ আগামীকাল শুরু বক্সিং ডে টেস্টে একটি সেঞ্চুরি করতে পারলে ছুঁয়ে ফেলবেন কোহলিকে, আর দুটি সেঞ্চুরি করলে টপকে যাবেন।

কোহলির নেতৃত্বেই টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে আছে ভারত। একের পর এক সেঞ্চুরি করে দলের এই অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং তিনিই। ছবি: রয়টার্স
কোহলির নেতৃত্বেই টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে আছে ভারত। একের পর এক সেঞ্চুরি করে দলের এই অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং তিনিই। ছবি: রয়টার্স

টেস্টে স্মিথ-কুকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে কোহলি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটকে যেন একপ্রকার নিজের রাজত্বই বানিয়ে ফেলেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক। সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি, সবচেয়ে বেশি ফিফটি- সবখানেই কোহলির জয়জয়কার। ১০ বছরে কোহলি ওয়ানডে খেলেছেন ২২৭টি। ৪২টি সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ১১১২৫। গড়টাও চোখধাঁধানো, ৬০.৭৯। এই দশকে সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি, সবচেয়ে বেশি ফিফটি (৫২), সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (২২৭), ম্যান অব দ্য ম্যাচ (৩৫), ম্যান অব দ্য সিরিজ (৭), সবচেয়ে বেশি চার (১০৩৮) এমনকি উইকেটকিপারদের বাইরে ফিল্ডার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্যাচও (১১৭) তাঁর!

রানের হিসেবে ওয়ানডেতে কোহলির পর দ্বিতীয় স্থানে আছেন তাঁরই সতীর্থ রোহিত শর্মা। ১৮০ ম্যাচে ৫৩.৫৬ গড়ে রোহিতের সংগ্রহ ৮২৪৯ রান। পরের তিনটি স্থানে আছেন যথাক্রমে হাশিম আমলা (৭২৬৫), এবি ডি ভিলিয়ার্স (৬৪৮৫) ও রস টেলর (৬৪২৮)। রানে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও গড়ের দিক থেকে অবশ্য ডি ভিলিয়ার্সের পেছনে পড়ে গেছেন কোহলি। কোহলির ৬০.৭৯ গড়ের বিপরীতে ডি ভিলিয়ার্সের গড় ৬৪.২০।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও শীর্ষ দুইয়ে কোহলি-রোহিত। ৭৫ ম্যাচে ২৬৩৩ রান কোহলির, গড় ৫২.৬৬। আর ৯০ ম্যাচে রোহিতের রান ২৩৯২। ২০ ওভারের ক্রিকেটেও কোহলির এমন গড় রীতিমতো অবিশ্বাস্যই বলা চলে। তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই গড় ৫০ এর বেশি- কোহলির আগে এমন দৃশ্যের জন্ম দিতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান।

ওয়ানডে হোক বা টেস্ট, বিদায়ী দশকে যে সংস্করণেই খেলেছেন, রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন বিরাট কোহলি। ছবি: রয়টার্স
ওয়ানডে হোক বা টেস্ট, বিদায়ী দশকে যে সংস্করণেই খেলেছেন, রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন বিরাট কোহলি। ছবি: রয়টার্স

বছর ধরে হিসেব করতে গেলে চলতি দশকে ব্যাটসম্যান কোহলির সবচেয়ে সফল বছর ছিল সর্বশেষ তিন বছর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান তুলেছেন ২০১৭ সালে। ৪৬ ম্যাচ খেলে ২৮১৮ রান করেছেন সেই বছর। আর গড়ের দিক থেকে সেরা বছর ছিল ২০১৬। ৩৭ ম্যাচে ২৫৯৫ রান করেছিলেন ৮৬.৫০ গড়ে! সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করেছেন ২০১৭ ও ২০১৮ সালে, ১১টি করে। এ ছাড়া ৮টি করে সেঞ্চুরি করেছেন ২০১২ ও ২০১৪ সালে। চলতি বছর সেঞ্চুরি করেছেন ৭টি।

দশকে কোহলির সবচেয়ে প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ৬৯ ম্যাচে মোট ৩৮৭৫ রান করেছেন অস্ট্রেলীয়দের বিপক্ষে। নির্দিষ্ট কোনো দলের বিপক্ষে এটিই কোহলির সর্বোচ্চ রান। সবচেয়ে বেশি ১৫টি সেঞ্চুরিও তিনি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৪৭৯ রান করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২টি সেঞ্চুরি করেছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

এই বছর বিশ্বকাপের সময় আরেকটি অনন্য রেকর্ড করেছেন কোহলি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ৪১৭তম ইনিংসে ২০ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন কোহলি। এর আগে এত কম ইনিংস খেলে ২০ হাজার আন্তর্জাতিক রান করতে পারেননি ইতিহাসের কোনো ব্যাটসম্যান। শচীন টেন্ডুলকার ও ব্রায়ান লারা দুজনেরই লেগেছিল ৪৫৩টি করে ইনিংস, রিকি পন্টিংয়ের লেগেছিল ৪৬৮ ইনিংস।

ব্যাটসম্যানদের জন্য সবচেয়ে কঠিন ধরা হয় যে কন্ডিশনকে, সেই ইংলিশ কন্ডিশনেও নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন কোহলি। ছবি: রয়টার্স
ব্যাটসম্যানদের জন্য সবচেয়ে কঠিন ধরা হয় যে কন্ডিশনকে, সেই ইংলিশ কন্ডিশনেও নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন কোহলি। ছবি: রয়টার্স

কোহলি-নামা তো শোনা হলোই, ‘ফ্যাবুলাস ফোর’ এর বাকি তিনজনের পরিসংখ্যানটাও একবার দেখে নেওয়া যাক। রানের দিক থেকে চারজনের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছেন ইংলিশ অধিনায়ক জো রুট। ৪৮.৫৫ গড়ে রান করেছেন ১৪০৩১, সেঞ্চুরি ৩৩টি। এরপর আছেন কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। ৪৭ গড়ে রান করেছেন ১৪০০৭, সেঞ্চুরি ৩৪টি। চারজনের মধ্যে সবার পরে ক্যারিয়ার শুরু করা স্টিভ স্মিথ রানের দিক থেকে একটু পেছনেই আছেন। ৫০.৯২ গড়ে রান করেছেন ১১৪৫৯। সেঞ্চুরি অবশ্য করে ফেলেছেন ৩৪টি।

পরিসংখ্যানময় এই লেখার শেষটাও হোক ছোট্ট আরেকটি পরিসংখ্যান দিয়ে। পুরো দশকে সবচেয়ে বেশি ছয় এসেছে কার ব্যাট থেকে সেটি কি জানা আছে? সাম্প্রতিক কিছু বছরের পরিসংখ্যানের দিকে নজর রাখলে উত্তরটা খুব বেশি কঠিন মনে হওয়ার কথা না। গেইল-আফ্রিদিদের মতো হার্ড হিটার নন, দশকে সবচেয়ে বেশি ছয় মেরেছেন রোহিত শর্মা। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে পুরো দশকে ৩৯৭টি ছক্কা মেরেছেন রোহিত! অবাক করতে পারে আরেকটি তথ্য, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ক্রিস গেইলের সঙ্গে রোহিতের ব্যবধান ১০০ এরও বেশি! গেইল মেরেছেন ২৯৪টি ছয়। ২৮০টি ছয় নিয়ে তিনে আছেন এউইন মরগান, ২৭৫ ছক্কা নিয়ে চারে মার্টিন গাপটিল ও ২৪৯ ছক্কা নিয়ে পাঁচে ডি ভিলিয়ার্স।