জাতীয় দলে খেলেন তারা দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য

জাতীয় দলের স্বপ্ন ছুড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়েছেন বয়স ভিত্তিক এই দলের চার ফুটবলার। ছবি: উগান্ডা ফুটবল ফেডারেশন টুইটার
জাতীয় দলের স্বপ্ন ছুড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়েছেন বয়স ভিত্তিক এই দলের চার ফুটবলার। ছবি: উগান্ডা ফুটবল ফেডারেশন টুইটার
জাতীয় দলে খেলা সব ফুটবলারের স্বপ্ন। ইরিত্রিয়ার ফুটবলারদেরও তাই। কিন্তু অন্য দেশের ফুটবলাররা স্বপ্ন দেখেন খ্যাতির। আর আফ্রিকার দেশটির ফুটবলারদের স্বপ্ন বিদেশ সফরে গিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচানোর


‘একটি আশাই বাঁচিয়ে রাখে, আর সেটা হলো একদিন আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টে খেলার ডাক পাবেন। আর আপনি পালানোর সুযোগ পাবেন।’

কথাটি একজন পেশাদার ফুটবলারের। ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল মেবায়েল ইউসিফ। কেকেফা অনূর্ধ্ব-২০ চ্যালেঞ্জ কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে এই মিডফিল্ডারের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স বড় জয় এনে দিয়েছিল ইরিত্রিয়াকে। জাঞ্জিবারের বিপক্ষে দলের ৫ গোলের দুটি গোলই ছিল তাঁর। এতটাই দুর্দান্ত খেলেছিলেন যে দেশটির তথ্যমন্ত্রীও টুইটারে ভূয়সী প্রশংসায় মেতেছিলেন। এমন পারফরম্যান্সের স্বপ্নই তো দেখেন ফুটবলাররা।

ইউসিফের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে অবশ্য অন্য ভাবে। তাঁর অমন পারফরম্যান্সের ফলে সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার শক্তিশালী দল কেনিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল ইরিত্রিয়া। বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রায় এক শ ধাপ পিছিয়ে থাকলেও ইরিত্রিয়া (২০৫) কেনিয়াকে হারানোর স্বপ্ন দেখছিল। ফলে পুরো দলের সবার মাঝে অনেক ফুর্তি দেখা দিয়েছিল। দলের সঙ্গে যাওয়া কর্মকর্তারাও ছিলেন উৎসবের মেজাজে। তখনই নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন ১৯ বছরের ইউসিফ। তিন সতীর্থ সাইমন আসমেলাশ, হারমন জোহানেস ও হানিবল টেকলেকে নিয়ে দলের ক্যাম্প ছেড়ে বেড়য়ে গেলেন, ‘সবাই আমাদের জয় উদ্‌যাপন করছিল। আমরা সেমিফাইনালে ওঠায় তারা ভেবেছিল পালাব না আমরা। আমরা নিরাপত্তা রক্ষীদের বললাম হাঁটতে বেরোনো যাবে কিনা, তারা রাজি হতেই সবাই পালালাম।’

দুই মাস পর ইরিত্রিয়ার মূল জাতীয় দল আরও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো কেকাফে কাপের ফাইনালে উঠেছে তারা। সেটাও কেনিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে দিয়ে। এমন পারফরম্যান্স করে জাতীয় বীর বনে যাওয়া দলের সাতজনও পালিয়েছেন দেশ ছেড়ে। এখনো আত্মগোপনে আছেন তারা। শুধু এরাই নন। ইরিত্রিয়ার ফুটবলাররা জাতীয় দলকেই বেছে নিয়েছেন দেশকে পালানোর পথ হিসেবে। উত্তর পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। প্রায় দাসের মতো জীবন ধারণের চেয়ে সুযোগ পেলেই শরণার্থীর জীবন বেছে নিচ্ছেন।

২০০৯ সালে কেনিয়ার সঙ্গে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে ১৩জন ফুটবলার পালিয়েছিলেন। ২০১২ কেকাফা কাপের পুরো দলই পালিয়ে গিয়ে নেদারল্যান্ডসে আশ্রয় নিয়েছে। ইউসিফেরাও উগান্ডাতে এখন শরণার্থী হিসেবে জীবন কাটাচ্ছেন। ইউসুফ জানালেন ডিসেম্বরে পালিয়ে যাওয়া সাত ফুটবলার ও তাঁদের পালানোর কারণ, ‘ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আপাতত ভালো আছে। কিন্তু লুকিয়ে আছে কারণ, এখনো কর্মকর্তারা খুঁজছে তাদের। সমস্যা হলো সবাই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। একজন ফুটবলার মানে ওখানে কিছুই না। আমাদের দেশে নিজের শহরে হাঁটার জন্যও অনুমতিপত্র জোগাড় করা লাগে। পুলিশ যদি আপনাকে ফুটবলার হিসেবে চিনতেও পারে তাও লাভ নেই। ওরা আপনাকে পেটাবে প্রথমে, তারপর গ্রেপ্তার করবে, আমার সঙ্গেও এটা হয়েছে। একটি আশাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, আর সেটা হলো একদিন আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টে খেলার ডাক পাব। আর তখন পালানোর একটা সুযোগ হবে।’

উগান্ডায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ কেকাফা কাপ থেকে পালানো ইউসিফরা সেখানেই আশ্রয় খুঁজেছেন। একটি ভিডিওর মাধ্যমে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কাছে নতুন কোনো দেশে আশ্রয় দেওয়ার আবেদন করেছেন। সংস্থাটি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপাতত একটি সেফ হাউসে রেখেছেন এই চার ফুটবলারকে। কিন্তু উগান্ডায় নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না ইউসিফ, ‘এত বেশি ইরিত্রিয়ান সরকারের হয়ে কাজ করে! এখনো আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।’

উগান্ডাতেও যে নিরাপদ নন তারা সেটা জানালেন ইউসিফ, ‘আমি জানি না তারা কীভাবে জানল কিন্তু আমাদের পালাতে সাহায্য করা একজন গায়েব হয়ে গেলেন একদিন। তিন সপ্তাহ পর আমাদের ফোন করে জানাল যে সরকার তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করছে। সে তাই আত্মগোপনে আছে এবং তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছি না। আপনাকে বুঝতে হবে এটা কত গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো রসিকতা নয়। একটি জিনিসই আমাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে যে তারা আমাদের হদিস জানে না। আমাদের খুঁজে পেলে হয় মারবে নয় তুলে নিয়ে যাবে। ওরা সফল হলে আমাদের ইরিত্রিয়ায় ফিরিয়ে নেবে এবং সারা জীবন এর শাস্তি পেতে হবে। আমাদের ব্যাপারে আর কখনো কোনো কথা শুনবেন না। যদি আমাদের অপহরণ করা সহজ না হয়, তাহলে খুন করবে।’

দেশের ফুটবলের সেরা সাফল্য এনে দিয়ে এই দলের সাত ফুটবলার পালিয়েছেন। ছবি: ইরিত্রিয়া ফুটবল ফেডারেশন
দেশের ফুটবলের সেরা সাফল্য এনে দিয়ে এই দলের সাত ফুটবলার পালিয়েছেন। ছবি: ইরিত্রিয়া ফুটবল ফেডারেশন

ইউসিফদের ব্যাপার নিয়ে কাজ করছেন ভ্যানেসা সেহায়ে। ইউএনএইচসিআর ও উগান্ডা সরকারের কাছে শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। সেহায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী কিম্বারলি মটলে। কিন্তু নিজের অসহায়ত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন এই আইনজীবী, ‘সমস্যা হলো ইরিত্রিয়ার অনেকেই উগান্ডায় আশ্রয় নিচ্ছেন।’ এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটির শাসনক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ইসাইয়াস আফওয়ার্কির হাতে। ১৯৯৩ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা এই প্রেসিডেন্টের শাসনে দেশটির নাগরিকদের সব সময় সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত থাকতে হয়। দুজনের বেশি মানুষ এক সঙ্গে হাঁটতে পারেন না দেশটিতে। ধর্মীয় অনুশাসনেও বাধা দেওয়া হয় নিয়মিত। ফলে ৫৭ লাখ জনসংখ্যার ৯ শতাংশ মানুষই এখন শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।।

মটলি জানাচ্ছেন দেশটির ভয়ংকর রূপের কথা, ‘ইরিত্রিয়ান সরকারের সবচেয়ে হাস্যকর দিক হলো তারা ফুটবলারদের দিয়েই একটা প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করে যে ইরিত্রিয়া দেশ হিসেবে ঠিক আছে। অথচ তাদের আইনই নিশ্চিত করে যে ফুটবলাররা সফল হবেন না। অনুশীলনে জড়ো হলেও তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। অবিশ্বাস্য।’ সেহায়ে অবশ্য তবু ইউসিফদের ভাগ্যবান বলছেন, ‘ফুটবলাররা হলো সেই কয়েকজনদের একজন যারা ইরিত্রিয়া ছাড়ার সুযোগ পায়। না হলে সীমানা পাড়ি দেওয়ার জন্যই জীবনের ঝুঁকিতে পড়তে হয় অন্যদের।’

উগান্ডায় আত্মগোপনে থাকা চার ফুটবলার ভালো নেই। এর মাঝেই দুজন ম্যালেরিয়ায় ভুগছেন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দিন দিন দূরে চলে যাচ্ছে তবু দেশে ফেরা চিন্তা মাথায় আনেন না ইউসিফ, ‘আমার ধারণা আমরা থাকলে হয়তো এবার শিরোপা (অনূর্ধ্ব-২০) জিততাম। কিন্তু আমি জানি ফিরলে কী হতো—দুই দিনের মধ্যে আমাদের পুরোনো জীবনে ফিরতে হতো। বিশেষ কিছুই হতো না, কেউ অভিনন্দন জানাত না, ধন্যবাদ দিত না। সেই পুরোনো অবস্থা চলত। সফল হলে সরকার সব কৃতিত্ব নিত কিন্তু পালানোর জন্য আমরা কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কল্পনাও করতে পারবেন না। আমি জানি না এখন কী হবে কিন্তু আশা করি একদিন নতুন জীবন কথাও শুরু করতে পারব।’ দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে।