কেমন হবেন বার্সেলোনার নতুন কোচ?

ভালভার্দের জায়গায় সেতিয়েনকে এনেছে বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি
ভালভার্দের জায়গায় সেতিয়েনকে এনেছে বার্সেলোনা। ছবি : এএফপি
>আড়াই বছরের জন্য বার্সেলোনায় দায়িত্ব পেয়েছেন স্প্যানিশ কোচ কিকে সেতিয়েন। বরখাস্ত হয়েছেন আর্নেস্তো ভালভার্দে। নতুন কোচের কাছে কী প্রত্যাশা করতে পারেন বার্সেলোনার সমর্থকেরা?

ফুটবল আর দাবা খেলার মধ্যে মিল কোথায়?

অনেকে মিল খুঁজে পাবেন না। বলবেন, একটা শরীরনির্ভর খেলা। একটা খেলা খেলতে হয় টেবিলের দুই প্রান্তে বসে। চুপচাপ। শরীরের জোর লাগে না বললেই চলে। আরেকটা খেলা পুরোপুরি শারীরিক শক্তিনির্ভর। আবার অনেকের চোখে মিলও আছে। সেটি হচ্ছে ‘মগজাস্ত্রের ব্যবহার’। এসি মিলান ও জুভেন্টাসের কিংবদন্তি ইতালিয়ান মিডফিল্ডার আন্দ্রেয়া পিরলোর আত্মজীবনীর কথাই ধরুন। ভদ্রলোক নিজের আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন, ‘আই থিংক দেয়ারফোর আই প্লে।’ অর্থ, ‘আমি ভাবি, তাই আমি খেলি।’

অর্থাৎ ফুটবল যে শুধু শরীরের জোর দিয়েই খেলা হয়, তা নয়, মগজের ভূমিকাও এখানে কম নয়। আত্মজীবনীতে পিরলো সে কথাটাই বলেছেন আরও স্পষ্টভাবে, ‘আমি মনে করি, ফুটবল আসলে খেলা হয় মাথার মধ্যে। পা শুধু খেলার উপকরণ মাত্র।’

পিরলোর এই কথা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি বোধ হয় হয়েছিলেন প্রয়াত ডাচ্‌ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ। তিনিও ফুটবলকে পায়ের নয়, বরং মাথার খেলা হিসেবেই মানতেন, ‘সব কোচ দৌড়ানোর কথা বলে, মাঠের মধ্যে কে কখন কীভাবে দৌড়াবে, নড়াচড়া করবে, সে কথা বলে। আমি বলি কী, অত দৌড়াদৌড়ি করার কী দরকার? ফুটবল এমন একটা খেলা, যা মগজ দিয়ে খেলা হয়, বুদ্ধি দিয়ে। খেলার মাঠে তোমাকে সব সময় সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকতে হবে। তাড়াতাড়িও না, আবার খুব দেরিতেও না। একদম সঠিক সময়ে।’

সাবেক বার্সেলোনা কোচ ও ক্রুইফের শিষ্য পেপ গার্দিওলার মতামতও অনেকটা এক। এক নৈশভোজে দাবার সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে প্রশ্ন করতে করতে অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলেন গার্দিওলা। জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে ম্যাচের কৌশলগুলো ঠিক করেন তিনি? কৌশলগুলোর মধ্যে কি কোনো বিশেষ ধারা থাকে? কোনো নিয়ম থাকে? কেননা গার্দিওলাও মানতেন, দাবা আর ফুটবলের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। দুটি খেলাই খেলতে হয় মাথা দিয়ে। যে যত বেশি বুদ্ধিমান, দাবার বোর্ড হোক বা ফুটবলের মাঠ, দুই ক্ষেত্রেই তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

এই দলে আরেকজনও আছেন, যিনি মনে করেন, ফুটবল খেলায় মাথার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আর দাবা খেলার প্রতি তাঁর নেশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেক সময় ফুটবল খেলা দেখা বাদ দিয়ে দাবা খেলতে বসে যান তিনি। শোনা যায়, দাবার দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ ও আনাতোলি কারপভ, দুজনের সঙ্গেই দাবার টেবিলে বসেছেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদ ও স্পেনের সাবেক কোচ, সেভিয়ার বর্তমান কোচ হুলেন লোপেতেগি এক সময়ে তাঁর নিয়মিত দাবা খেলার সঙ্গী ছিলেন।

এই মানুষটির নাম কিকে সেতিয়েন। বার্সেলোনার নতুন কোচ। আর্নেস্তো ভালভার্দের জায়গায় তাঁকেই গত রাতে নিয়ে এসেছে বার্সেলোনা।

পরে সেতিয়েনের অধীনে বার্সেলোনা কতগুলো ট্রফি জিতবে সেটা বলা যায় না, তবে এটা নিশ্চিত, গার্দিওলা-ভিয়ানোভার পর সেতিয়েনের চেয়ে বড় ‘ক্রুইফ-ভক্ত’ ম্যানেজার আর পা রাখেনি ন্যু ক্যাম্পে।

সেতিয়েন যে ক্রুইফের কত বড় ভক্ত, সেটা বোঝা যায় তাঁর একটা কথাতেই, ‘ক্রুইফ যখন বার্সেলোনার কোচ হিসেবে আসলেন, আমি লক্ষ্য করলাম, তাদের বিপক্ষে যারাই খেলছে, কেউ বল পাচ্ছে না। বলের পিছে পিছে ছুটছে তারা। বলের প্রতি বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের দখল এতটাই বেশি ছিল। আমি সেটা দেখে ভাবলাম, আমি এটাই তো চাই! আমার দল এভাবে খেলুক, আমি এটাই চাই। খেলোয়াড় হিসেবেও আমি সব সময় বল নিয়ে খেলতে চেয়েছি। কোচ হিসেবেও সেটাই চাই।’

ভালভার্দের অধীনে বার্সেলোনার খেলার স্টাইল নিয়ে বিরক্ত সমর্থকদের কানে মধু হয়ে ঝরবে কথাগুলো, এটা বলাই যায়। যখন রিয়াল বেতিসের কোচ ছিলেন, সেই ২০১৮-১৯ মৌসুমে দলটার বল দখল রাখার হার ছিল ৬২.৫%। ২০০৫ সালের পর এক বার্সেলোনা বাদে এক মৌসুমে এর চেয়ে বেশি বল দখলের হার আর অন্য কোনো ক্লাবের ছিল না। এমনকি রিয়াল মাদ্রিদেরও না। গত বছর ক্যাম্প ন্যু তে এসে যেভাবে বার্সেলোনাকে খাবি খাইয়েছিলেন, কোচ হিসেবে নিজের জাতটা সেদিনই চিনিয়ে দিয়েছিলেন সেতিয়েন। ভালভার্দের অধীনে ঘরের মাঠে লিগে ওই এক ম্যাচই হেরেছিল বার্সেলোনা। গত ১০ মৌসুমে বার্সেলোনার ক্যাম্প ন্যু ও রিয়াল মাদ্রিদের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে গিয়ে ম্যাচ জিতে আসা একমাত্র কোচ এই সেতিয়েন। সেতিয়েনের অধীনেই টিকিটাকা আবারও ফিরে আসবে ক্যাম্প ন্যুতে, সমর্থকেরা আশাবাদী হতেই পারেন।

ভালভার্দের বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ ছিল, তরুণ খেলোয়াড়দের যথেষ্ট সুযোগ তিনি দেন না। তাদের গড়ে তুলতে পারেন না। যে কারণে কার্লেস আলেনিয়া, রিকি পুইগ, সার্জি স্যাম্পার, জ্যাঁ-ক্লাইর তোদিবো, ইয়ারি মিনা, ম্যালকম, মার্ক কুকুরেল্লার মতো তরুণেরা সুযোগ পাননি। সেতিয়েন আবার তেমন নন, জুনিয়র ফিরপো, জোনাথান ভিয়েরা, ফাবিয়ান রুইজ, জিওভানি লো সেলসোর মতো তারকাদের গড়ে তোলার পেছনে তাঁর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। সেতিয়েনের সময় লা মাসিয়া থেকে তরুণেরা আবারও মেসি-জাভির যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠে আসবেন, এমনটাই আশা সমর্থকদের।

তবে সেতিয়েনের কোচিংয়েও যে খুঁত নেই, তা কিন্তু নয়। অতি-আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে অনেক সময়ে রক্ষণভাগকে ভুলে যাওয়ার জন্য ‘বিখ্যাত’ এই কোচ। যে কারণে বেতিস গত মৌসুমে গোল খেয়েছিল ৫২টা। বার্সেলোনার ভঙ্গুর রক্ষণভাগকে কীভাবে এই কোচ ঠিক করেন, এটাই ভাবার বিষয়।

আপাতত নিজেদের খেলার ধরনের সঙ্গে মেলে, এমন এক কোচ পেয়ে বেশ খুশি বার্সেলোনা। খুশিটা মাঠের সাফল্যে অনূদিত হয় কি না, দেখা যাক!