অ্যাথলেটিকস ফিরেছে 'প্রস্তরযুগে'

সিনথেটিক ট্র্যাকের বদলে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটিকস হচ্ছে ঘাসের মাঠে দাগ টেনে। সে মাঠও এবড়োখেবড়ো। ছবি: সৌরভ দাশ
সিনথেটিক ট্র্যাকের বদলে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটিকস হচ্ছে ঘাসের মাঠে দাগ টেনে। সে মাঠও এবড়োখেবড়ো। ছবি: সৌরভ দাশ
>

প্রায় ১৪ বছর পর ঢাকার বাইরে হচ্ছে জাতীয় অ্যাথলেটিকস। কিন্তু এবার কোনো রেকর্ড হলেও তা লিপিবদ্ধ করবে না ফেডারেশন। সিনথেটিক ট্র্যাকের বদলে চট্টগ্রামে অ্যাথলেটরা লড়ছেন ঘাসের মাঠে।

স্টেডিয়ামের এক পাশে চুপচাপ বসে ছিলেন পুলিনা চৌধুরী। চট্টগ্রামের প্রবীণ অ্যাথলেট ১৯৮৫ সালে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে শটপুটে রেকর্ড গড়ে সোনা জেতেন। পদকমঞ্চে উঠে সেদিন ভরা গ্যালারির দিকে চেয়ে উচ্ছ্বাসে মেতেছিলেন পুলিনা। পঁয়ত্রিশ বছর পর সেই স্টেডিয়ামে যখন আরেকটি জাতীয় অ্যাথলেটিকসের গ্যালারি ফাঁকা, পুলিনার মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।

চট্টগ্রামে কাল শুরু হয়েছে ৪৩ তম জাতীয় অ্যাথলেটিকস। অথচ শহরে পা রেখে বোঝার উপায় নেই দেশের সবচেয়ে বড় অ্যাথলেটিকসের আসর হচ্ছে এখানে। কোথাও প্রচারণার কোনো চিহ্ন নেই। শুধু স্টেডিয়াম লাগোয়া চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার দেয়ালে টাঙানো একটা ব্যানার। অথচ অ্যাথলেটিকসের জাতীয় আসর ঢাকার বাইরে নেওয়ার একটা বড় উদ্দেশ্যই ছিল খেলার প্রতি খেলোয়াড় ও সাধারণ মানুষের উৎসাহ বাড়ানো।

এবারের জাতীয় অ্যাথলেটিকস সব দিক দিয়েই যেন দায়সারা। এবড়োখেবড়ো মাঠে অ্যাথলেটরা ভুগছেন চোট-আতঙ্কে। শঙ্কা সত্যি করে কাল দিন শেষে দুই অ্যাথলেটের ঠিকানা হয়েছে হাসপাতাল। বিজেএমসির অ্যাথলেট আরিফুজ্জামান ঘাসের মাঠের লুকানো গর্ত বুঝতে না পেরে হাইজাম্প দেওয়ার সময় বাঁ পা ভেঙেছেন। উঁচু-নিচু মাঠে দৌড়াতে গিয়ে ৪ x ১০০ মিটার রিলের সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যান মমতাজ নাসরিন। হাঁটুতে গুরুতর চোট পেয়েছেন বিজেএমসির এই অ্যাথলেট। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ট্র্যাকের কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। কোথাও ঘাস নেই। কোনোরকমে মাটি ফেলে মাঠ সমান করার চেষ্টা হয়েছে। তবু ঢিবির মতো হয়ে গেছে জায়গাটা। সব দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস যেন ফিরে গেছে প্রস্তরযুগে!

প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ফেডারেশনের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ঢাকার বাইরে দলের সংখ্যা বাড়বে। বাস্তবে হয়েছে উল্টো। চট্টগ্রাম থেকে দূরের জেলাগুলো আগ্রহ দেখায়নি। গত আসরে যেখানে সব মিলিয়ে অংশ নেন ৪২২ জন অ্যাথলেট, এবার সেখানে ৩৭৫ জন! বিকেএসপির কোনো অ্যাথলেট অংশ নিচ্ছেন না জাতীয় প্রতিযোগিতায়। দু-একজন খেললেও সেটা অন্য সংস্থার হয়ে।

ঘাসের মাঠে লাফ দিতে গিয়ে পা ভেঙে হাসপাতালে গেছেন বিজেএমসির হাইজাম্পার আরিফুজ্জামান
ঘাসের মাঠে লাফ দিতে গিয়ে পা ভেঙে হাসপাতালে গেছেন বিজেএমসির হাইজাম্পার আরিফুজ্জামান

অ্যাথলেটরা ঘাসের ট্র্যাকে দৌড়াবেন বলে এবারের প্রতিযোগিতায় নেই কোনো ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড। কেউ কোনো রেকর্ড গড়লেও সেটা ফেডারেশন লিপিবদ্ধ করবে না। ৩০০০ মিটার স্টিপল চেজ ইভেন্ট নিয়ম মেনে হয়নি। সাধারণত স্টিপল চেজের জন্য স্টেডিয়ামের ট্র্যাকের মাঝে পানির গর্ত রাখা হয়। পানিভর্তি গর্তের মধ্যে দৌড়ে ট্রিপল চেজ শেষ করেন অ্যাথলেটরা। অবাক করা ব্যাপার-ট্রিপল চেজ হচ্ছে সেটি ছাড়াই।

মাঠের মাপ নিয়ে অভিযোগ বিভিন্ন সংস্থা ও জেলার কোচ-কর্মকর্তাদের। ৪০০ মিটার দৌড়ের দূরত্বটা আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হয়নি। সকালে পুরুষদের ১৫০০ মিটার দৌড়ের ফাইনাল হলেও সেটির ফলাফল দিন শেষে বাতিল করে দেন বিচারকেরা। কারণ পরে জানা গেছে ২০ মিটার দূরত্ব কম ছিল এই ইভেন্টে। স্টার্টার ও লাইনম্যান তা আমলেই নেননি!

বিশ্ব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের নিয়ম অনুসারে প্রতিযোগিতা হয় আট লেনে। কিন্তু এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটরা দৌড়াচ্ছেন ছয় লেনে। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব ব্যাখ্যা দিলেন কাল, ‘মাঠের দুই পাশে জায়গা বেশি না থাকায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’

প্রথমবারের মতো জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতে চট্টগ্রামে এসেছেন সুরাইয়া আক্তার। ঢাকার এই অ্যাথলেট ঘাসের মাঠে দৌড়ে বেশ অসন্তুষ্ট, ‘আমার স্বপ্ন ছিল জাতীয় অ্যাথলেটিকসে সিনথেটিক টার্ফে দৌড়াব। স্বপ্নটা পূরণ হলো না। এখানে দৌড়ানোর সময় মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে গেলাম হোঁচট খেয়ে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অ্যাথলেট এই জাতীয় আসরকে বললেন লোকদেখানো, ‘এটা ফেডারেশনের “শো” দেখানো ছাড়া আর কিছু না। উঁচু-নিচু মাঠে চুনের দাগের মধ্যে দৌড়ে উন্নতি করার কিছু দেখছি না।’

এ ব্যাপারেও ব্যাখ্যা আছে সাধারণ সম্পাদকের, ‘বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ। অন্য কোনো ভেন্যু পাচ্ছিলাম না। তা ছাড়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে এখানে এটার আয়োজন করেছি। সারা দেশে অ্যাথলেটিকস ছড়িয়ে দিতে চাওয়াও এর একটা কারণ। নতুন প্রজন্মকে আনতেই ঘাসের ট্র্যাকে একটা আয়োজন করেছি।’

প্রচারণার অভাবে চট্টগ্রামের সেই প্রজন্ম অবশ্য ঠিকভাবে জানেই না তাদের নগরে বসেছে জাতীয় অ্যাথলেটিকস!