টানা ২১ ওভার মেডেন নেওয়া বাপু 'হাল ছাড়লেন'

বাপু নাদকার্নি (১৯৩৩-২০২০)। ছবি: বিসিসিআই টুইটার পেজ
বাপু নাদকার্নি (১৯৩৩-২০২০)। ছবি: বিসিসিআই টুইটার পেজ
>

টেস্টে টানা সর্বোচ্চ মেডেন ওভার নেওয়ার রেকর্ডধারী ভারতের স্পিনার বাপু নাদকার্নি

টেস্ট ক্রিকেটে কিপটে বোলিংয়ের ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ কী? অন্তত ৫০ টেস্ট উইকেট আছে, এমন বোলারদের মধ্যে সবার আগে উঠে আসে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রেভর গডার্ডের (৪১ ম্যাচে ১.৬৪ ইকোনমি) নাম (১৯৫৫-১৯৭০)। তবে টানা কিপটে বোলিংয়ের ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’ হিসেবে লোকে উপমহাদেশের এক স্পিনারকে স্মরণ করে থাকে। আজ তাঁকে আবারও স্মরণ করতে সংগত কারণেই। 

ফিরে যাওয়া যাক টেস্ট ক্রিকেটের সেই সময়ে যখন খেলাটির জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী, আক্রমণের চেয়ে রক্ষণকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছিল সব দল। সালটা ১৯৬৪, মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) টেস্টের তৃতীয় দিন। ৭ উইকেটে ৪৫৭ রান তুলে আগের দিন প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছে ভারত। ২ উইকেটে ৬৩ রান নিয়ে তৃতীয় দিন ব্যাটিংয়ে নেমেছে ইংল্যান্ড। উইকেটের আচরণ ছিল অস্বাভাবিক। ইংল্যান্ড দলের অবস্থাও ভালো ছিল না। মিকি স্টুয়ার্ট (অ্যালেক স্টুয়ার্টের বাবা) ও জিম পার্কস অসুস্থ থাকায় মাঠে নামতে পারেননি। ফ্রেড টিটমাস এবং ব্যারি নাইট মাঠে থাকলেও সুস্থ ছিলেন না।

সে ম্যাচে তৃতীয় দিনের পরিস্থিতি নিয়ে ক্রিকইনফোয় এক প্রতিবেদনে মার্টিন উইলিয়ামস লিখেছিলেন, ‘ইংল্যান্ড সিদ্ধান্ত নেয় মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই তাদের একমাত্র আশা।’ মধ্যাহ্নভোজের পর বল করতে এলেন ভারতের বাঁহাতি স্পিনার বাপু নাদকার্নি। চা-বিরতির খানিকক্ষণ আগে তাঁর বলে প্রথম রান (স্থানীয় সময় বিকাল ৩.০৫ মিনিট) নিতে পারেন কেন ব্যারিংটন। বাপুর নিখুঁত লাইন ও লেংথের সঙ্গে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কচ্ছপ–কামড় দিয়ে উইকেটে পড়ে থাকার মিশেলে সে সেশন নিয়ে ‘টাইমস’ লিখেছিল, ‘তাঁকে (নাদকার্নি) সঙ্গে সঙ্গে বোলিং থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় যেন খুব খরুচে বল করেছে।’ তা বটে! বিরতিতে যাওয়ার আগে নাদকার্নির বোলিং ফিগার ছিল ১৯-১৮-১-০!

শেষ সেশনে আরও ১০ ওভার বল করেন নাদকার্নি। দিন শেষে তাঁর বোলিং ফিগার ছিল ২৯-২৬-৩-০। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে নাদকার্নির বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ৩২-২৭-৫-০। এর মধ্যে টানা মেডেন নিয়েছিলেন ২১ ওভার। সব মিলিয়ে তাঁর ২১.৫ ওভারে কোনো রান নিতে পারেননি ইংলিশ ব্যাটসম্যানেরা। বলের হিসাবে ১৩১ ডেলিভারি! টেস্ট তো বটেই, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও টানা এতগুলো ওভার মেডেন নিতে পারেননি আর কোনো বোলার। টেস্টে ন্যূনতম ১০ ওভার বোলিং বিবেচনায় নাদকার্নির ৩২ ওভারের সেই ফিগারই সবচেয়ে কিপটে বোলিং (০.১৫ ইকোনমি রেট)।

ট্রেভর গডার্ডের মতোই ১৯৫৫ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক নাদকার্নির। দুজনেই বাঁহাতি বোলার, তবে গডার্ডের দুই বছর আগে টেস্ট থেকে অবসর নেন নাদকার্নি (১৯৬৮)। আর কাল সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ে নিজের মেয়ের বাসায় চিরকালীন অবসর নিলেন জীবন থেকেই! হ্যাঁ, ৮৬ বছর বয়সে মারা গেছেন রমেশচন্দ্র গঙ্গারাম ‘বাপু’ নাদকার্নি। তাঁর পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ৪১ টেস্টে ৮৮ উইকেট নেওয়া নাদকার্নি ছিলেন বেশ উঁচু মানের অলরাউন্ডার। ১ সেঞ্চুরি ও ৭ ফিফটি মিলিয়ে ১৪১৪ রান করেছেন টেস্টে (২৫.৭০)। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে উইকেটসংখ্যা কাটায় কাটায় ৫০০।

অ্যাকশনে নাদকার্নি। যখন খেলতেন। ছবি: ওয়াসিম জাফরের টুইটার পেজ
অ্যাকশনে নাদকার্নি। যখন খেলতেন। ছবি: ওয়াসিম জাফরের টুইটার পেজ

নাদকার্নির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে শচীন টেন্ডুলকারের টুইট, ‘বাপু নাদকার্নির মৃত্যুর খবর শুনে খুব খারাপ লাগছে। টেস্টে তাঁর টানা ২১ ওভার মেডেন নেওয়ার গল্প শুনে বড় হয়েছি। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা। শান্তিতে ঘুমোন স্যার।’ ভারতের প্রধান কোচ ও সাবেক ক্রিকেটার রবি শাস্ত্রীর টুইট, ‘বাপু নাদকার্নির পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি আমার হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। আমাদের অন্যতম সেরা এবং আমার প্রথম টিম ম্যানেজার।’

কাল ভারত-অস্ট্রেলিয়া ওয়ানডে চলাকালীন নাদকার্নির চলে যাওয়ার খবর শোনেন সুনীল গাভাস্কার। ভারতের কিংবদন্তি এ ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারেও দলীয় ম্যানেজার ছিলেন নাদকার্নি। একটি ঘটনা স্মরণ করেন তিনি। ১৯৮১ সালে সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ান পেসার লেন প্যাসকোয়ের বলে ভারতের প্রথম ইনিংসে মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন সন্দ্বীপ পাতিল। অ্যাডিলেডে পরের টেস্টে পাতিল ১৭৪ রানের ইনিংস খেলতে পেরেছিলেন শুধু নাদকার্নির ধারাবাহিক প্রেরণার জন্য। গাভাস্কারের ভাষায়, ‘সে সফরে বাপুজি ছিলেন সহকারী ম্যানেজার। শুধু তাঁর ধারাবাহিক প্রেরণার জন্য পাতিল পরের টেস্টে ১৭৪ করতে পেরেছিল। বাপুজি সব সময় বলতেন “ছোড়ো মাত” (হাল ছেড়ো না)।’

কিন্তু কাল বাপু নিজেই জীবনের বাইশ গজে বেঁচে থাকার আস্বাদ নেওয়া থেকে হাল ছেড়ে দেবেন, তা জানত কে!