এমন কিছু ক্রিকেট দেখেনি এর আগে

প্রথম ধাপে এ ট্রফিটার জন্য লড়বে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। ছবি: বিসিবি
প্রথম ধাপে এ ট্রফিটার জন্য লড়বে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। ছবি: বিসিবি

শেষ পর্যন্ত তো ক্রিকেটই খেলা হবে, যেটির নিষ্পত্তি ব্যাট-বলের লড়াইয়ে, তাই না? গত মাস দুয়েক, নাকি আরও বেশি সময় ধরে যা হলো, তাতে এই মৌলিক সত্যটাই যে ভুলে যাওয়ার জোগাড়! একটা রেকর্ডও বোধ হয় হয়ে গেছে সিরিজ শুরুর আগেই। ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো সফর হওয়া না-হওয়া নিয়ে এত কথা হয়েছে বলে যে মনে পড়ছে না। অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলতে থাকা সেই সিরিজ অবশেষে শুরু হচ্ছে আজ।

না, এমন কিছু ক্রিকেট এর আগে কখনো দেখেনি। টি-টোয়েন্টি আর টেস্ট সিরিজ মিলিয়ে একটা সফর। সেটি কিনা সম্পূর্ণ হবে তিনটি টুকরো মিলিয়ে! চার দিনে তিন ম্যাচ খেলে আজ শুরু টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষ হওয়ার পর দ্বিখণ্ডিত দুই টেস্টের সিরিজ দুই বারে। দুটির মাঝখানে দেড় মাসেরও বেশি বিরতি। তালেগোলে একটা ওয়ানডেরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জানুয়ারির শেষে শুরু সফরের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি আগামী এপ্রিলের শুরুতে। তার মানে বাংলাদেশের এই পাকিস্তান সফরের আয়ুষ্কাল আড়াই মাসেরও বেশি!

খেলা শুরু হয়ে গেলে নিশ্চয়ই আলোচনাটা ক্রিকেটে ফিরবে। কথা হবে রান-উইকেট এসব নিয়ে। কিন্তু এর আগে-পরে, মাঝের বিরতির সময়গুলোতে বাকি সব ছাপিয়ে একটা শব্দই উচ্চারিত হবে বারবার—নিরাপত্তা! টি-টোয়েন্টি সিরিজ কাভার করতে পাকিস্তানে যাওয়া বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রথম রিপোর্টটাও এ নিয়েই লেখা হয়েছে বলে অনুমান করি।

বাংলাদেশ দলের পাকিস্তান সফরে যাওয়া নিয়ে এই দেশের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ছিল। যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও তা-ই। শেষ পর্যন্ত যে পথে অচলাবস্থার সমাধান এসেছে, সেটি নিয়েও নানা জনের নানা মত। ক্রিকেট কূটনীতিতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের কল্পিত পরাজয় নিয়েও সরব ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনাই হচ্ছে বেশি এ সিরিজে। ছবি: এএফপি
নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনাই হচ্ছে বেশি এ সিরিজে। ছবি: এএফপি

বিসিবি গোঁ ধরে ছিল, পাকিস্তান গেলে শুধুই টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য। পাকিস্তানের কাছে স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য পেয়েছিল টেস্ট সিরিজ। অভিশপ্ত সেই ২০০৯ সালের ৩ মার্চের পর দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির হাত ধরে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে অনেক দিনই। আরেকটি টি-টোয়েন্টি সিরিজের নির্বিঘ্ন আয়োজন তাই পাকিস্তানের প্রায়োরিটি লিস্টে না থাকারই কথা। সেটি যে ক্রিকেট–বিশ্বে তাদের কাঙ্ক্ষিত বার্তাটা ছড়িয়ে দিতে পারত না। বাংলাদেশের সঙ্গে টেস্ট সিরিজটা নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলতে হলে পাকিস্তানের জন্য সেটি হতো এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসা।

সেই ‘এক পা এগোনো’র সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা—গত মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ। যেটি খেলতে শ্রীলঙ্কাকে রাজি করানোটাকে বলতে হবে পিসিবির এক মাস্টারস্ট্রোক। ২০০৯ সালের ৩ মার্চ রাতের চেয়েও অন্ধকার এক সকালে লাহোরের লিবার্টি চত্বরে এই শ্রীলঙ্কাই শিকার হয়েছিল অভূতপূর্ব সেই সন্ত্রাসী হামলার। অভূতপূর্বই, কারণ এর আগে সন্ত্রাস একাধিকবার পাকিস্তানের ক্রিকেটে তার কালো ছায়া বিস্তার করলেও কখনোই সেটি কোনো ক্রীড়াবিদ বা ক্রীড়া দলকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য করেনি। সেই দুঃস্বপ্ন ভুলে শ্রীলঙ্কা যদি হাসিমুখে পাকিস্তানে টেস্ট সিরিজ খেলে আসতে পারে, অন্য দলগুলো কীভাবে তা খেলতে আপত্তি তোলে?

বাংলাদেশের তাই পাকিস্তানে টেস্ট সিরিজ না খেলে উপায় ছিল না। ক্রিকেট কূটনীতিতে জয়-পরাজয় যদি সত্যি হিসাব করতে হয়, জয়টা বাংলাদেশেরই। টেস্ট সিরিজ নিয়ে আপত্তির মূল কারণ তো ছিল লম্বা সময় পাকিস্তানে না থাকতে চাওয়া। বাংলাদেশের সেই চাওয়া পূরণ করতেই তিন পর্বে একটা সফর, দুই টেস্টের সিরিজের দুটি ওয়ান-অফ টেস্টের রূপ নিয়ে ফেলা। এর কাছাকাছি কিছু খুঁজে পেতে পাকিস্তানেরই দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলা ছিল পাকিস্তান ক্রিকেটের কফিনে শেষ পেরেক, এর প্রায় সাত বছর আগে থেকেই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য পাকিস্তানের ‘নিষিদ্ধ ভূমি’তে পরিণত হওয়ার সূচনা। ২০০২ সালে করাচিতে পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলের পাশে বোমা বিস্ফোরণে মারা গেলেন নয়জন। নিউজিল্যান্ড দল তখন সেই হোটেলেই। টেস্ট সিরিজ অসমাপ্ত রেখেই সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে কিউইদের দেশে ফিরে যাওয়া। এর কিছুদিন পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজ। অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানে খেলতে অস্বীকৃতি জানানোর পর প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ ভেন্যুর খোঁজে নামতে হলো পাকিস্তানকে। মাঝখানের বিরতিটা বাংলাদেশ সিরিজের মতো ছিল না, তবে এক দিক থেকে সেই টেস্ট সিরিজ আরও অভিনব। দুই দেশে সিরিজের দুই টেস্ট। কলম্বোতে প্রথম টেস্ট খেলার পর দ্বিতীয়টি শারজায়। সেই ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে ইতিহাসের একমাত্র ট্রায়াঙ্গুলার টেস্ট সিরিজের পর প্রথমবারের মতো তৃতীয় কোনো দেশে দুই দেশের টেস্ট ম্যাচ (১৯৯৯ সালে ঢাকায় পাকিস্তান–শ্রীলঙ্কা এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালকে ব্যতিক্রম ধরে)।

অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ জানিয়েছেন তাদের মনোযোগ খেলাতেই। ছবি: বিসিবি
অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ জানিয়েছেন তাদের মনোযোগ খেলাতেই। ছবি: বিসিবি

এবারের পাকিস্তান সফর নিয়ে আপত্তি তোলার পর সে দেশের সাবেক কিছু ক্রিকেটার বাংলাদেশের বিপক্ষে ‘অকৃতজ্ঞতা’র অভিযোগ তুলেছিলেন। এর আগে পাকিস্তানের উপকার নাকি বাংলাদেশ ভুলে গিয়েছে। স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ওই ক্রিকেটারদের খুব মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল, অতীতের জন্য কৃতজ্ঞতার প্রশ্ন উঠলে পাকিস্তানেরই বরং বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডের সফরের সময় ওই বোমা হামলার পর বাকি দেশগুলো যখন মুখ ফিরিয়ে, বাংলাদেশ দলই প্রথম পাকিস্তান সফরে যেতে রাজি হয়েছিল। ইতিহাসের অমনোযোগী ছাত্রের মনে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ দলের পাকিস্তান সফর যে কারণে একটু রহস্য হয়ে দেখা দেবে। তারা যে বুঝতেই পারবে না, পাকিস্তানের এত অতিথিপরায়ণ হওয়ার কারণ। কেন বাংলাদেশকে তিন টেস্ট ও পাঁচ ওয়ানডের সিরিজ খেলার জন্য আতিথ্য দেওয়া। এই সম্মান তো আর কোনো দেশ কখনো বাংলাদেশকে দেয়নি।

এসব অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ থাক। খেলার কথা হোক। আলোচনায় ফিরে আসুক রান-উইকেট। আমরা বরং প্রার্থনা করি, তিন দফার পাকিস্তান সফর শেষেও ক্রিকেটই যেন সবার মুখে মুখে থাকে, অন্য কিছু নয়।