শুভ জন্মদিন, বাতিগোল

নব্বইয়ের দশকে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন এই বাতিস্তুতা। ছবি: এএফপি
নব্বইয়ের দশকে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন এই বাতিস্তুতা। ছবি: এএফপি
>

ডিয়েগো ম্যারাডোনা তখন অস্তগামী। লিওনেল মেসি নামের সূর্যের উদয় তখনো হয়নি। আর্জেন্টিনার ভার কাঁধে নেওয়ার জন্য ঠিক সেই সময়টায় উদয় হলো ঝাঁকড়া চুলো এক তরুণের। যাকে অনায়াসে হলিউডের কোনো নায়ক বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। সেই গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা পৃথিবীতে এসেছিলেন আজকের এই দিনে

“আমার কাছে ফিওরেন্টিনার মতো দলে খেলে একটা ট্রফি জেতা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলে দশটা ট্রফি জেতার সমান…”

এ যুগে কয় জন ফুটবলারের মুখ থেকে এ রকম অনুগত আর বিশ্বস্ততার বাণী শুনেছেন? প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ই এখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার বিনিময়ে বড় বড় ক্লাবে খেলতে আগ্রহী। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বায়ার্ন মিউনিখের মতো ক্লাবগুলো বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল ফুটবলারেরই স্বপ্নের গন্তব্য। কয় জন কম শক্তিশালী ক্লাবের হয়ে খেলে সেই ক্লাবকে উন্নত করতে চান?

টট্টি, জেরার্ড, দেল পিয়েরো, স্কোলস কিংবা পাওলো মালদিনির যুগ এখন আর নেই। আনুগত্যের সুমধুর ব্যঞ্জনা আধুনিক যুগে টাকার ঝনঝনানিতে শোনাই যায় না এখন আর। এখন পাওলো ডিবালারা এক-দুই মৌসুম পালেরমো মাতিয়ে জুভেন্টাসে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। দুই-তিন মৌসুম ভালো খেলে লিভারপুল থেকে বার্সেলোনা যাওয়ার জন্য ইনজুরির নাটক বা শৃঙ্খলাভঙ্গ করতেও পিছপা হন না ফিলিপ কুতিনহো-লুইস সুয়ারেজরা। এক মৌসুম ভালো খেলে বার্সেলোনায় যাওয়ার জন্য ট্রেনিং করা বন্ধ করে দেন ওসমানে ডেমবেলেরা। এ রকম উদাহরণ খুঁজলেই আজকাল ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে।

কিন্তু যাকে নিয়ে এই বিরাট বড় উপক্রমণিকা টানছি লেখার, তিনি এই গোত্রে পড়েন না। তিনি হয়তো টট্টি-গিগস-স্কোলসদের মতো “ওয়ান-ক্লাব-ম্যান” না, তবুও, তাঁর আনুগত্য আর গোল করার কাহিনি ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্টিনার ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে রচিত হয়ে আছে।

তিনি গ্যাব্রিয়েল ওমর বাতিস্তুতা। সমর্থকদের প্রিয় বাতিগোল।

আর্জেন্টিনার হয়ে ৫৬ গোলের একটি করার পর উল্লাস। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট
আর্জেন্টিনার হয়ে ৫৬ গোলের একটি করার পর উল্লাস। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট

২৬৯ ম্যাচে ১৬৮ গোল করে ফিওরেন্টিনার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। সব মিলিয়ে সিরি ‘আ’তে ৩১৯ ম্যাচে ১৮৪ গোল করে এই লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের মধ্যে ১২তে আছেন।

ফিওরেন্টিনায় মোটামুটি বছর দশেক ছিলেন বাতিস্তুতা। ওই দশটা বছরই যথেষ্ট ছিল ফিওরেন্টিনার সমর্থকদের কাছে নিজেকে দেবতা বানানোর জন্য। এর মাঝে হাজারো চড়াই-উতরাই পার করে এসেছে “লা ভিওলা” রা। ইতালিতে আসার বছর দু-একের মধ্যেই বাতিস্তুতা নিজের প্রিয় ফিওরেন্টিনাকে দেখেছেন অবনমিত হতে। সে মৌসুমে বাতিস্তুতা এর ১৬ গোল যথেষ্ট ছিল না ফিওরেন্টিনাকে রেলিগেশনের খড়্গ থেকে বাঁচানোর জন্য। অবনমনের দুঃখ, সঙ্গে যুক্ত হলো বাতিস্তুতাকে হারানোর ভয়। ফিওরেন্টিনার সমর্থকদের জন্য তখন যে খুব ভালো সময় ছিল, বলা যাবে না।

দলের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ থাকবেন তো? নাকি রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান বা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অর্থের ঝনঝনানির কাছে বশ্যতা শিকার করে চলে যাবেন? কিন্তু না। বাতিস্তুতা ছিলেনই অন্য ধাতে গড়া। যে ধাতে সাধারণ ফুটবলাররা গড়া নন। আজীবন লড়াকু, গ্ল্যাডিয়েটরের প্রতিমূর্তি এই স্ট্রাইকার অন্যের পরিশ্রমে পাওয়া ফল ভোগ করতে আগ্রহী ছিলেন সামান্যই। রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা এসি মিলানে গেলে সহজেই দশটা বিশটা ট্রফি পেয়ে যেতেন। কিন্তু সেখানে গেলে হয়তো নিজেকে অন্যের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যেতে হতো, কিংবা অধিক সন্ন্যাসীর একজন সন্ন্যাসী হয়ে গাজন নষ্ট করার দায়ে অভিযুক্ত হতে হতো। সেটা হতে চাননি তিনি। জনপ্রিয় রোলস রয়েসের গায়ে শুধুমাত্র একটা রুপার প্রলেপ হতে চাননি তিনি, হতে চেয়েছেন গোটা একটা ইঞ্জিন, সেটা যদি একটা টয়োটারও হয়, তাই সই! 

বোকা জুনিয়র্সের হয়ে তখন সদ্য আলো ছড়াচ্ছেন। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট
বোকা জুনিয়র্সের হয়ে তখন সদ্য আলো ছড়াচ্ছেন। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট

নব্বইয়ের দশকে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অনেক চেয়েছিলেন তাঁকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আনতে। এমনকি তখন বাতিস্তুতা এর রিলিজ ক্লজ (যে দামটা ফিওরেন্টিনাকে দিলে ফিওরেন্টিনা অবশ্যই বাতিস্তুতাকে বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে), ১৩ মিলিয়ন পাউন্ড দেওয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাতিস্তুতা এর হৃদয়ে তো ফিওরেন্টিনা! যে বাতিস্তুতা ফিওরেন্টিনা ছাড়তেই চান না, রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করলেই-বা কি! চেয়ে বসলেন আকাশ-কুসুম বেতন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তখন সাধ্য ছিল না প্রতি সপ্তাহে ৭৫ হাজার পাউন্ড করে কাউকে দেওয়ার। ফলাফল, ফিওরেন্টিনাতেই থাকলেন বাতিস্তুতা।

নিজের ক্যারিয়ারের বছর দশেক ফিওরেন্টিনাকে দেওয়ার পর বাতিস্তুতা ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে এসে সিদ্ধান্ত নিলেন ক্লাব পরিবর্তন করার। কখনো লিগ না জেতা বাতিস্তুতা শেষবেলায় এসে একটা বারের স্কুডেট্টো ছুঁয়ে দেখতে চাইলেন। প্রিয় ফিওরেন্টিনা আর ফিওরেন্টিনার সমর্থকেরা বুঝল তাদের বরপুত্রের আকুতি। বাতিস্তুতা যোগ দিলেন এএস রোমায়। আজীবন ক্লাব জীবনে শিরোপা বিমুখ থাকা বাতিস্তুতাকে ফুটবল দেবতা আর বিমুখ করলেন না। ফ্র্যান্সেসকো টট্টির সঙ্গে দুর্ধর্ষ জুটি গড়ে তুলে প্রথম মৌসুমেই রোমার হয়ে জিতলেন লিগ শিরোপা।

ফিওরেন্টিনার সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন তিনি। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট
ফিওরেন্টিনার সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন তিনি। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট

শিরোপার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে বাতিস্তুতার ফলপ্রসূ ক্ষেত্রটা খুব সম্ভবত জাতীয় দলেই। এখন বিশ্বসেরা লিওনেল মেসিকে নিয়েও যেখানে আর্জেন্টিনা বড় কোনো শিরোপা জিততে পারে না, বাতিস্তুতা ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩—এই তিন বছরেই আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছেন দুটো কোপা আমেরিকা আর একটা কনফেডারেশনস কাপের শিরোপা। দেড় দশক একাই জাতীয় দলকে টেনেছেন, ৭৮ ম্যাচে ৫৬ গোল করেছেন। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো এই ৫৬ গোলের মধ্যে ২৩টাই ছিল বড় টুর্নামেন্টে করা, যার মধ্যে বিশ্বকাপের ১২ ম্যাচে ১০ গোলও আছে। পরপর দুই বিশ্বকাপে দুটো হ্যাটট্রিক করা একমাত্র খেলোয়াড় এখনো বাতিগোল। ১৯৯৪ সালে গ্রিসের বিপক্ষে আর ১৯৯৮ সালে জ্যামাইকার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক দুটোর সে কৃতিত্বের এখনো কেউ পুনরাবৃত্তি করে দেখাতে পারেননি।

এই পরিসংখ্যানগুলো প্রমাণ করে জাতীয় দলের হয়ে কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি, ম্যারাডোনা মেসিদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আক্ষেপের বিষয় এটাই, আর্জেন্টিনার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম স্ট্রাইকার হওয়া সত্ত্বেও, এত নিবেদনের পরও তিনটা বিশ্বকাপ খেলেও ট্রফিকে নিজের করে নিতে পারেননি তিনি। ২০০২ বিশ্বকাপে যাওয়ার সময় জানতেন যে এটা তাঁর শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে, ৩৩ বছর বয়সে শেষবারের মতো বিশ্বকাপ অর্জন করার সুযোগটা নিতে চেয়েছিলেন, পারেননি। বাছাইপর্বে দুর্ধর্ষ ফর্মে থাকা আর্জেন্টিনা মূলপর্বে যেন গোলই করতে ভুলে যায়। পরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় তাদের। অপূর্ণ থেকে যায় বাতিগোলের জীবনের সর্বশেষ স্বপ্নটা!

সারা জীবন পাগলের মতো ফুটবল খেলে গেছেন। সেটার দাম দিতে হয়েছে একের পর এক ইনজুরিতে পড়ে। ক্যারিয়ার শেষ করার পর পায়ের ব্যথায় এমনই কাতর হতে হয়েছে ডাক্তারের কাছে ভিক্ষা চেয়েছেন দুটো পা কেটে দেওয়ার জন্য। আজ বাতিস্তুতা মাদ্রিদ মিলান বা জুভেন্টাসের মতো বড় ক্লাবে খেললে হয়তো আরও অনেক ট্রফিই জিততেন, নব্য ফুটবল ভক্তদের প্রিয় স্ট্রাইকারদের তালিকায় হয়তো সবচেয়ে ওপরেই থাকত তাঁর নাম।

রোমায় থাকার সময়। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট
রোমায় থাকার সময়। ছবি: গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার টুইটার অ্যাকাউন্ট

প্রথাগত লাতিন আমেরিকানদের মতো অত কারিকুরি না পারলেও ডি-বক্সের মধ্যে বাতিস্তুতার চেয়ে ভীতিকর স্ট্রাইকার আর কেউ ছিলেন না। বুলেটগতির ট্রেডমার্ক শটে দূরপাল্লা থেকে গোল করে কত কিশোরের কত তরুণের মন হরণ করেছেন সে হিসাব মনে হয় তাঁর নিজের কাছেও নেই। যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করেছেন লুইস সুয়ারেজ, কার্লোস তেভেজ, সার্জিও আগুয়েরো, গঞ্জালো হিগুয়েইন, লওতারো মার্টিনেজদের মতো তারকাকে।

আজ এই মহাতারকার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, গ্যাব্রিয়েল ওমর বাতিস্তুতা!