ইভা-অহনাদের অন্য লড়াই

জিমনেসিয়ামে চলছে মেয়েদের শরীর গঠনের অনুশীলন, সাহায্য করছেন অহনা ও তাসনিয়া। ছবি: দীপু মালাকার
জিমনেসিয়ামে চলছে মেয়েদের শরীর গঠনের অনুশীলন, সাহায্য করছেন অহনা ও তাসনিয়া। ছবি: দীপু মালাকার

লালবাগের রায়হান জিমনেসিয়াম। পেছনে শরীরচর্চায় মগ্ন কয়েকজন তরুণী। কেউ ফোম রোলিং করছেন। কেউ বারবেল নিয়ে ওজন তুলতে ব্যস্ত। ঢাকার বেশির ভাগ জিমনেসিয়ামেরই নিয়মিত দৃশ্য এটি। পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও বানাচ্ছেন ‘সিক্সপ্যাক অ্যাবস’। বাইসেপ, ট্রাইসেপ পেশি গঠন ফ্যাশন আর সৌন্দর্যসচেতনে আটকে নেই কেউ। শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পদকও জিতছেন মেয়েরা।

কদিন আগেই ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন অহনা। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী চ্যাম্পিয়ন হন মেয়েদের প্রথম জাতীয় শরীর গঠনে। এত দিন বাংলাদেশের মেয়েদের এই পরিচয় অজানাই ছিল। প্রথমবারের মতো মেয়েদের জাতীয় শরীর গঠন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে মঞ্চটা তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশন।    

তাতে জানা গেল, শুধু পুরুষেরাই নয়, মেয়েরাও পারে ‘বডিবিল্ডার’ হতে। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজেও বডিবিল্ডিংয়ে মেয়েদের উঠে আসার প্রবণতা বেশ প্রশংসাই পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বডিবিল্ডিংয়ের পোশাক থেকে কিছুটা সরে এসে বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য ভিন্ন ধরনের পোশাক নির্দিষ্ট করে দেয় ফেডারেশনের। মেয়েরা সে পোশাক পরে স্বাচ্ছন্দ্যেই অংশ নেন প্রতিযোগিতায়।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী অহনা চ্যাম্পিয়ন হন মেয়েদের প্রথম ‘জাতীয় শরীর গঠন’ প্রতিযোগিতায়। ছবি: প্রথম আলো
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী অহনা চ্যাম্পিয়ন হন মেয়েদের প্রথম ‘জাতীয় শরীর গঠন’ প্রতিযোগিতায়। ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে শরীর গঠনের চর্চা স্বাধীনতার আগে থেকে। পুরান ঢাকার নবযুগ শরীরচর্চা কেন্দ্র, ডিপিটিসি (ঢাকা ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার), নাজিরাবাজার শরীরচর্চা কেন্দ্র, বকশিবাজার ক্লাব ঘিরে চলত শরীর গঠন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশন। প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ঢাকাই সিনেমার একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম। নবযুগ শরীরচর্চা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দিন হলো। কিন্তু থেমে থাকেনি শরীরচর্চা। নব্বইয়ের দশকেই যেখানে শরীরচর্চার জন্য হাতে গোনা দশ-বারোটা জিম ছিল ঢাকায়, বর্তমানে সেটি দুই শর ওপরে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লায়ও শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এর মধ্যেই মেয়েদের বাংলাদেশের শরীর গঠনের সংস্কৃতিতে নতুন রং ছড়িয়ে দিয়েছে মেয়েদের জাতীয় প্রতিযোগিতা।

অহনা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন।  ছবি: প্রথম আলো
অহনা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ছবি: প্রথম আলো

পেশাজীবী নারীরাও আগ্রহী হচ্ছেন শরীর গঠনে। ইভা আলম পেশায় আইনজীবী। আদালত, সন্তান, ঘরকন্না সামলে ইভা অংশ নেন মেয়েদের প্রথম শরীর গঠন প্রতিযোগিতায়। ছিলেন সেরা পাঁচে। শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় ইভার আসার গল্পটা মজার, ‘অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমার ওজন অস্বাভাবিকভাবে  বেড়ে যায়। ছেলে হওয়ার পর ওজন কমানোর জন্য জিমনেসিয়ামে ভর্তি হই। ওজন কমিয়ে ৯০ কেজি থেকে ৫৮ কেজিতে আনি। হঠাৎ বন্ধুরা বলল, মেয়েদের শরীর গঠন প্রতিযোগিতা হবে। এত দিন ধরে যে পেশি বানিয়েছি, সেটা দেখানোর একটা ইচ্ছাও ছিল। সুযোগ তৈরি করে দিল এই প্রতিযোগিতা।’ স্বামী–সন্তানদের সমর্থন পেলেও সহকর্মীদের অনেকেই নাকি ব্যাপারটা বাঁকা চোখে দেখছেন। অবশ্য এসব নিয়ে খুব একটা ভাবেন না ইভা, ‘অন্যরা কী বলল তা নিয়ে ভাবি না। জীবনে আমি যা চাই, সেটা করে দেখাতে চাই।’

ভাই রায়হান রহমানের অনুপ্রেরণায়  শরীর গঠনে চ্যাম্পিয়ন হন অহনা।  ছবি: প্রথম আলো
ভাই রায়হান রহমানের অনুপ্রেরণায় শরীর গঠনে চ্যাম্পিয়ন হন অহনা। ছবি: প্রথম আলো

চ্যাম্পিয়ন অহনার শরীর গঠনে আসা ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। ভাই রায়হান রহমান পেশাদার বডিবিল্ডার। জাতীয় প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জিতেছেন। ছোটবেলা থেকে বড় ভাইকে জিমে শরীরচর্চা করতে দেখেছেন। লালবাগে রায়হান নিজের একটা জিমনেসিয়ামও গড়েছেন। অহনা সেখানেই ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে গত দুই বছর কাজ করেছেন নিয়মিত। মেয়েদের শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে রায়হানই অনুপ্রেরণা অহনার। তবে শুরুতে মা–বাবাকে জানাননি তিনি, ‘অনুমতি পাব কি না তা নিয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু ভাইয়া প্রতিযোগিতার তিন দিন আগে জানিয়ে দেন সবাইকে। শুনে সবাই সমর্থন করেন। আমার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবর টেলিভিশনে দেখে তো আব্বু কেঁদেই ফেলেছেন।’ 

ইডেনের ছাত্রী তাসনিয়া সিদ্দিক (ডান পাশে) মেয়েদের প্রথম জাতীয় শরীর গঠন আসরেই  জিতেছেন ব্রোঞ্জ। ছবি: প্রথম আলো
ইডেনের ছাত্রী তাসনিয়া সিদ্দিক (ডান পাশে) মেয়েদের প্রথম জাতীয় শরীর গঠন আসরেই জিতেছেন ব্রোঞ্জ। ছবি: প্রথম আলো

 অহনা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন, ‘ফিজিকে অংশ নিলে আমাদের দেশের মেয়েদের পক্ষে পদক আনা সম্ভব। বডিবিল্ডিং উপভোগ করছি। একদিন এটির সর্বোচ্চ আসর অলিম্পিয়ায়ও অংশ নিতে চাই।’ 

ইডেনের ছাত্রী তাসনিয়া সিদ্দিক ছোটবেলায় ছিলেন লিকলিকে। বন্ধুরা এ জন্য হাসিঠাট্টা করতেন। একসময় জিমে যাওয়া শুরু করেন তাসনিয়া। ছেলেবন্ধুরা যখন শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন, আগ্রহ নিয়ে দেখতে যেতেন। এবার প্রথম আসরেই তাসনিয়া জিতেছেন ব্রোঞ্জ।   

লালবাগের রায়হান জিমনেসিয়াম অহনা ও তাসনিয়ার তত্ত্বাবধানে শরীরচর্চায় মগ্ন দুই সদস্য।  ছবি: প্রথম আলো
লালবাগের রায়হান জিমনেসিয়াম অহনা ও তাসনিয়ার তত্ত্বাবধানে শরীরচর্চায় মগ্ন দুই সদস্য। ছবি: প্রথম আলো

অহনা, তাসনিয়ারা ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন। তাঁদের দেখে আরও অনেক মেয়েই শরীর গঠনে আগ্রহী হচ্ছেন, প্রেমে পড়ছেন জিমনেসিয়ামের। অহনাদের লড়াইয়ের হাত ধরে সামাজিক বাধাবিপত্তির আরও একটি ধাপ যেন পেরিয়ে গেল বাংলাদেশের মেয়েরা!