ভারতের এই ক্রিকেটারকে দেখে পাকিস্তানিদের শিখতে বললেন শোয়েব

>ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ব্যাটসম্যান যশস্বী জয়সোয়ালে মুগ্ধ শোয়েব আখতার। তার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার কষ্টকর অভিযাত্রা থেকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের শেখা উচিত বলে মনে করেন শোয়েব
যশস্বী জয়সোয়াল—কাল পাকিস্তানকে হারানোর পর। ছবি: যশস্বী জয়সোয়ালের টুইটার পেজ
যশস্বী জয়সোয়াল—কাল পাকিস্তানকে হারানোর পর। ছবি: যশস্বী জয়সোয়ালের টুইটার পেজ

যশস্বী জয়সোয়াল—নামটা আলোচিত হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটে। শুধু ভারত কেন, মজেছে পাকিস্তানও। শোয়েব আখতার যেমন ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের এ ক্রিকেটারকে দেখে শিখতে বললেন তাঁর দেশের ক্রিকেটারদের। পাকিস্তানের পেস কিংবদন্তির এমন কথা বলার কারণ যশস্বী জয়সোয়ালের পেছনের পথটা। ভীষণ বন্ধুর পথ পেরিয়ে জয়সোয়াল আজ দেশের জার্সিতে বাইশ গজে।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে কাল পাকিস্তানকে ১০ উইকেটে হারিয়েছে ভারত। অপরাজিত ১০৫ রানের ইনিংস খেলেন ওপেনার জয়সোয়াল। যুব বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ এ রান সংগ্রাহক ভারতে প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন গত বছর বিজয় হাজারে ট্রফিতে। ৫০ ওভারের ম্যাচে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ মেরেছিলেন ১৮ বছর বয়সী এ বাঁহাতি।

ফিল্ডিংয়ে নেমে জয়সোয়াল নিজ থেকে কখনো রোদচশমা পড়তেন না। স্লিপে ফিল্ডিংয়ে দাঁড়ালে সতীর্থরা রোদচশমা দিলে পড়তেন। শুরুতে কোচের মানা ছিল। বিজয় হাজারে ট্রফিতে ডাবল মারার পর তাকে মাঠে রোদচশমা পরার অনুমতি দেন কোচ জওলা সিং। বিষয়টি অনেকের কাছে খুব সামান্য মনে হতেই পারে। তবে জয়সোয়ালের উঠে আসার গল্পটা জানলে তখন অসামান্য।

উত্তর প্রদেশের অঞ্চল ভাদোহি থেকে ১১ বছর বয়সে মুম্বাই এসেছিলেন জয়সোয়াল। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলবেন, শুধু এ ভাবনা থেকেই তাঁর ঘরত্যাগ। মুম্বাইয়ে তাঁর থাকার জায়গা ছিল না। বাধ্য হয়ে শুরুতে থেকেছেন কালভাদেবি অঞ্চলে একটি ডেইরি ফার্মে। দৈনন্দিন কাজে তাঁদের তেমন সাহায্য করতে না পারায় সেখান থেকে চলে আসতে হয় জয়সোয়ালকে। এরপর তার বাবা-মা এক চাচাকে অনুরোধ করেছিলেন ছেলেকে কিছুদিন জায়গা দিতে। সেখানে এক চিলতে জায়গা পেলেও ভাগ্যে বেশি দিন সহ্য হয়নি। সেই চাচাও জয়সোয়ালকে অন্য জায়গা খুঁজে নিতে বলেন।

তবে জয়সোয়ালের একটা উপকার করেছিলেন সেই চাচা। ভাতিজাকে তিনি পাঠিয়ে দেন মুসলিম ইউনাইটেড ক্লাবে। সেখানে খুব সাধারণ হলেও থাকার জায়গা ছিল। পরবর্তী তিন বছর মুসলিম ক্লাবই হয়ে ওঠে জয়সোয়ালের ঘর। গরমের দিনে বাধ্য হয়েই বিছানা ছেড়ে ঘুমোতেন বাইরে। রাতগুলো ভীষণ কষ্টের হলেও জয়সোয়ালের মনে কষ্ট ছিল না। থাকার জায়গা তো জুটেছে! তবে দুশ্চিন্তা অন্যখানে টাকা তো লাগবে! বাঁচতে হলে টাকা লাগেই।

জয়সোয়ালের ভাষায়, ‘ক্লাবের তাঁবুতে থাকলেও খাবার কেনার জন্য আমার টাকা ছিল না। তাই রামলীলার সময় পানিপুরি বিক্রি শুরু করি। এ ছাড়াও কেউ না চাইলেও বল বয় হিসেবে কাজ করেছি। মোট কথা, টাকা রোজগারের জন্য আমি যা যা সম্ভব সব-ই করেছি।’ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের এক সকালে জয়সোয়ালের ভাগ্য ফিরতে শুরু করে। মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানে তার স্ট্রোক-প্লে দেখে মুগ্ধ হন কোচ জওলা সিং। তাকে ডেকে কথা বলে জানতে পারেন জয়সোয়ালের সঙিন পরিস্থিতি। জওলা সিং নিজেও গোর্খাপুর থেকে মুম্বাইয়ে এসে প্রায় একইরকম কষ্ট করে ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। নিজে না পারলেও জয়সোয়ালকে বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। শুরু হলো গুরু-শিষ্যের পথচলা। জয়সোয়াল এখনো এই ‘গুরু’ জওলার বাসার বাসিন্দা।

শোয়েব আখতার। ছবি: টুইটার
শোয়েব আখতার। ছবি: টুইটার

কোচের সঙ্গে যাত্রা শুরুর ১৫দিন পর অনুশীলন শুরু করেন জয়সোয়াল। জাইলস শিল্ডে ৩১৯ রান ও ১২ উইকেট নিয়ে চমকে দেন সবাইকে। এ ছাড়াও ছিল ডাবল সেঞ্চুরি ও এক ম্যাচে ১২ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের পর কোচের কাছ থেকে উপহার পেলেন হেলমেট। জওলা সিং তাকে কোনো কিছুই এমনিতে দেননি। অর্জন করে নিতে হয়েছে। রোদচশমা পড়ার অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চয়ই এবার পরিষ্কার!

স্কুল ক্রিকেটে দুর্দান্ত খেলে মুম্বাইয়ের জুনিয়র দল হয়ে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ঠাঁই পান জয়সোয়াল। এ ছাড়াও বিজয় হাজারে ট্রফিতে মহাকাব্যিক ডাবলের আগে মেরেছেন ৪ সেঞ্চুরি। বরুণ অ্যারন ও শাহবাজ নাদিমদের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার ম্যাচে ১২ ছক্কা ও ১৭টি চার মেরেছিলেন জয়সোয়াল। যতগুলো শট খেলেছিলেন এর মধ্যে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে মারা স্ট্রেট ড্রাইভ তার ভীষণ প্রিয়, জয়সোয়ালের ভাষায়, তার কারণ ‘এটা শচীন টেন্ডুলকারের পছন্দের শট’।

শোয়েব আখতার এমন অদম্য ক্রিকেটারে মুগ্ধ। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে জয়সোয়ালের প্রশংসা করে পাকিস্তানি কিংবদন্তি বলেন, ‘ভারতের ছেলেটা জয়সোয়াল, সে গ্রাম ছেড়ে মুম্বাইয়ে এসে ডেইরি ফার্মে ঘুমিয়েছে। মাঠকর্মী তাকে বলেছিল, তোমাকে থাকার জায়গা দেব যদি কাল অপরাজিত থাকতে পারো। সে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে দুটি সেঞ্চুরি মেরে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হয় সকালেই। সকালে তাকে পানি পুরি বেচতে হয়েছে। নিজে একটু খেতে পাওয়ার জন্য সে সতীর্থদের কাছেও পানি পুরি বিক্রি করেছে।’

শোয়েব এরপর বলেন, ‘একবার ভেবে দেখুন, এমন একটা ছেলে দলে জায়গা পেতে লড়াই করছে। রাজস্থান রয়্যালস তাকে কিনেছে, আমি বলে রাখছি এই ছেলে অনেক দূর যাবে। নিশ্চিত থাকুন সে জাতীয় দলে খেলবে। জয়সোয়ালের উঠে আসা দেখে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের শেখা উচিত। আড়াই কোটি রুপিতে তাকে কিনেছে রাজস্থান। সে ছুটছে সাফল্যের পেছনে, তার পেছনে ছুটছে টাকা।’