দৌড়ে রান নিতে এত অনীহা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের!
এক-দুই রান নেওয়ার চেয়ে চার-ছক্কা মারার দিকে বেশি মনোযোগী ব্যাটসম্যানরা। ফলে প্রতিপক্ষ বোলার-ফিল্ডারদের ওপর যেমন চাপ তৈরি করতে পারেন না, তেমনি নিজেরাও থিতু হতে পারেন না ব্যাট হাতে।
টেস্ট ক্রিকেট ধৈর্যের খেলা, সাধনার খেলা। এ সংস্করণে একসময় ওভারপ্রতি গড়ে ৩ রানকে বলা হতো ‘ম্যাজিক ফিগার’। দিন বদলেছে, পাল্টেছে ব্যাটিংয়ের ধাঁচ। বড় দলগুলো এখন ওভারপ্রতি গড়ে ৪–এর ওপরে রানরেট নিয়েও দিন শেষ করে। সেখানে বাংলাদেশ? অনেকে মজা করে বলেন, টি–টোয়েন্টি খেলে ওয়ানডের মেজাজে, ওয়ানডে খেলে টি–টোয়েন্টির মেজাজে, কখনো টেস্টেরও। আর টেস্ট খেলে ওয়ানডে কিংবা আরেকটু ভালো ছন্দে থাকলে টি–টোয়েন্টির মেজাজে!
এমন কথার সত্য–মিথ্যা নির্ণয়ে তর্কে না গিয়ে খেলা দেখাই ভালো। তবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের খেলায় অন্য একটি বৈশিষ্ট্য থাকবেই। স্ট্রাইক অদলবদল করা মানে সিঙ্গেলস–ডাবলস নিয়ে ফিল্ডারের ওপর চাপ বিস্তার করার ধাঁচ খুব বেশি নেই। রান তোলার মূল অস্ত্র বাউন্ডারি মারা। সেটি হয় মাটি কামড়ে, নয়তো বাতাসে ভাসিয়ে। টি–টোয়েন্টিপ্রেমীদের বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিং দেখে তাই মজা পাওয়ার কথা। কিন্তু তাতে দলের লাভ হয় কতটুকু?
রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে আজ বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের কথাই ধরা যাক। প্রথম দিন পার করতে পারেনি বাংলাদেশ। ৮২.৫ ওভার ব্যাট করলেও অলআউট হয়েছে ২৩৩ রানে। ওভারপ্রতি রানরেট ২.৮১। খেলা না দেখে শুধু এই রানরেট বিবেচনায় নিলে মনে হতেই পারে, বাংলাদেশ তো টেস্ট মেজাজেই ব্যাট করেছে! ‘শুভংকরের ফাঁকি’টা ঠিক এখানেই। প্রথম ইনিংসে চার–ছক্কা যথাক্রমে ৩৩ ও ১টি। বাউন্ডারি থেকে মোট রান এসেছে ১৩৮। মি. ‘এক্সট্রা’ মানে অতিরিক্ত থেকে ১০ আসায় বাকি ৮৫ রান সিঙ্গেলস–ডাবলস। তাহলে এই ইনিংসের ‘মৌলিক ভিত্তি’ কী? এক কিংবা দুই রান নয়, চার–ছক্কা।
অথচ টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৩ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত কোনো ব্যাটসম্যানই একমত হবেন না, টেস্ট ব্যাটিংয়ের ভিত্তি বাউন্ডারি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা হাঁটছেন এ পথেই। এর আগে সবশেষ চার ইনিংসের ব্যাটিংও একই তালের। ইডেন গার্ডেনস টেস্টে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। সে ইনিংসে বাউন্ডারি থেকে এসেছে ৬৮ রান, অতিরিক্ত থেকে ১৪ মিলিয়ে মোট ৮২। সিঙ্গেলস–ডাবলস থেকে মাত্র ২৪!
সে টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯৫ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১১৮ রানই বাউন্ডারি থেকে। সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ২২ যোগ করলে ১৪০। সিঙ্গেলস–ডাবল থেকে মাত্র ৫৫! ক্লান্ত লাগলে একটু দম নিয়ে ফিরে তাকান ইন্দোর টেস্টে। সেখানে প্রথম ইনিংসে ১৫০ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। বাউন্ডারি থেকে এসেছে ৭৮ অতিরিক্ত আরও ৪। মোট ৮২ রান। বাকি ৬৮ রান সিঙ্গেলস–ডাবলস থেকে। দ্বিতীয় ইনিংসে উঠেছে ২১৩ রান। বাউন্ডারি থেকে এসেছে ১১৮ রান, সঙ্গে অতিরিক্ত ১৩ রান যোগ করলে হয় ১৩১। সিঙ্গেলস–ডাবলস থেকে ৮২।
সহজ কথায়, প্রতিটি ইনিংসেই সিঙ্গেলস–ডাবলস থেকে বাউন্ডারির আধিক্য। শতকরা হিসাবে তা অর্ধেকের বেশি, কিছু ইনিংসে তো দৃষ্টিকটুভাবে বেশি। তবে টেস্ট খেলার আরেকটু গভীরে তাকালে অন্য একটি বিষয়ও চোখে পড়বে। টেস্টের ফিল্ডিং হয় আক্রমণাত্মক। পেসাররা বল করার সময় ব্যাটসম্যানের পেছনের চেয়ে সামনে ফাঁকা জায়গা বেশি থাকে। স্পিনারদের সময় মিডউইকেট, কাভার ও স্ট্রেটেও ফাঁকা জায়গা থাকে। সেটি ব্যাটসম্যানদের প্রলুব্ধ করতে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে টেস্টে বাউন্ডারি মারার সুযোগ কিন্তু ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টির চেয়ে বেশি। কিন্তু সেটি কখন?
নিশ্চয়ই ব্যাটসম্যান ‘সেট’ হওয়ার পর। কিংবা এক–দুই করে নিয়ে ফিল্ডারদের চাপে ফেললে খেলাটা সহজ হয়ে আসে। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক তখন বাধ্য হয়েই প্ল্যান ‘এ’ থেকে ‘বি’ ‘সি’ কিংবা ‘ডি’ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ব্যাটসম্যানও সুযোগ বুঝে তখন খেলতে থাকেন নিজের মতো। পাকিস্তানের বিপক্ষে আজ প্রথম ইনিংসে কি এ কৌশলের প্রতিফলন ছিল? ওভারপ্রতি ৩–এর নিচে রানরেট দেখে মনে হবে বাংলাদেশ আক্রমণাত্মক ব্যাট করেনি। কিন্তু উইকেটে কেউ সেভাবে থিতুও হতে পারেননি। ৮০ ওভারের বেশি ব্যাট করার পর যেটি অন্তত একজনের কাছ থেকে হলেও প্রত্যাশিত ছিল।
এই ইনিংসেই সিঙ্গেলস–ডাবলসের সংখ্যা বেশি হলে স্কোরবোর্ডও যেমন আরও সমৃদ্ধ হতো, তেমনি প্রথম দিনটাও সম্ভবত পাড়ি দেওয়া যেত। কীভাবে? ধরুন ৫০টি সিঙ্গেলস বেশি নিয়েছে বাংলাদেশ। তখন কিন্তু সময় বেশি লাগত ; মানে প্রতিটি রানে প্রান্ত বদল করলে পরের বলটা করার আগে এমনিতেই বেশি সময় লাগে। এর সঙ্গে যোগ করুন ফিল্ডারদের ক্লান্তি, বোলারদের বল করার আগে প্রস্তুতি। আর মৌলিক বিষয়টি তো বলাই হলো না! এক–দুই রানে ব্যাটসম্যানরা দ্রুত খাপ খাইয়ে নেন কন্ডিশন ও উইকেটের সঙ্গে।
বাংলাদেশের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ফিরে তাকানো যাক হারারেতে সম্প্রতি শেষ হওয়া জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কা টেস্টের দিকে। প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুয়ে রান করেছে ৪০৬। কীভাবে? ২১৮ রান এসেছে চার-ছক্কা ও অতিরিক্ত থেকে। বাকি ১৮৮ রান এক-দুই থেকে। প্রায় অর্ধেকের মতো।
এবার দেখুন ইংল্যান্ড–দক্ষিণ আফ্রিকার চতুর্থ টেস্টে। সম্প্রতি জোহানেসবার্গে সে টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান তোলে ইংল্যান্ড। সেখানে বাউন্ডারি (২৩৪) আর অতিরিক্ত (১৬) থেকে এসেছে ২৫০ রান। বাকি ১৫০ রান সিঙ্গেলস–ডাবলস। বাউন্ডারিসংখ্যা বেশি দেখে ভ্রুকুটির কিছু নেই। স্কোরবোর্ডে ৪০০ ওঠার পেছনে সিঙ্গেলস–ডাবলসের প্রভাব বেশি। কারণ ওই ১৫০ রানে ব্যাটসম্যানরা ইনিংস টেনে বাউন্ডারিগুলো মেরেছেন।
সে টেস্টে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসেও তাকানো যাক। ২৪৮ রানের মধ্যে বাউন্ডারি (১৩৮) ও অতিরিক্ত (১৩) মিলিয়ে এসেছে ১৫১। সিঙ্গেলস–ডাবলস থেকে বাকি ৯৭ রান। পোর্ট এলিজাবেথে তৃতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসে প্রায় একই ধাঁচে ব্যাট করেছে ইংল্যান্ড। ৪৯৯/৯ রানে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছিল ইংল্যান্ড। এর মধ্যে বাউন্ডারি থেকে এসেছে ২৭৪ রান। অতিরিক্ত ২৪ যোগ করে মোট ২৯৮। বাকি ২০১ রান সিঙ্গেলস–ডাবলস থেকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই বাউন্ডারিগুলোর ভিত্তি ছিল সিঙ্গেলস–ডাবলস। উইকেটে সেট হয়ে মেরেছেন বেন স্টোকস–পোপরা। তাতে যে খটকাটা লাগে, টেস্টে অন্য দলগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইনিংসে বাউন্ডারির আধিক্য বেশি? নিখুঁত হিসেব বের করতে চাইলে পরিসংখ্যান বের করে বসে পড়তে পারেন। তবে চোখের দেখায় যে বিষয়টি বোঝা যায়, রানের চাকা একেবারে আটকে গেলে কিংবা বোলারের চাপ কাটিয়ে উঠতে বাউন্ডারি মারেন ব্যাটসম্যানরা।
অথচ সিঙ্গেলস–ডাবলস পুরোদমে চালু থাকলে চাপটা কিন্তু উল্টো প্রতিপক্ষ বোলারদের!