মাথাটা উঁচুই থাকবে তো আকবরদের?

ভবিষ্যতে আকবরদের মাথা উঁচু রাখতে বিসিবিকেই নিতে হবে ভূমিকা। ছবি: আইসিসি
ভবিষ্যতে আকবরদের মাথা উঁচু রাখতে বিসিবিকেই নিতে হবে ভূমিকা। ছবি: আইসিসি

সবার মধ্যেই একটা চাপান-উতোর। আকবর আলীকে কীভাবে কথাটা বলা যায়! সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে বোনের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চয়ই সহ্য করতে পারবেন না ১৮ বছর বয়সী তরুণ।

 কিন্তু অবাক হয়ে সবাই দেখলেন, এমন দুঃসংবাদ শুনেও ভেঙে পড়েননি আকবর! পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে হোটেলে ফেরার পর ফিল্ডিং কোচ ফয়সাল হোসেন অনেক ভূমিকা করে বললেন, ‘...তোমার বোন আরও দুই দিন আগে মারা গেছে।’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আকবর একটু ধাক্কা খেলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘আমার বোন!’ দুই চোখ ভিজে উঠল জলে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

 টুর্নামেন্টের বাকি দিনগুলোয় আর একবারের জন্যও বোনের মৃত্যুর প্রসঙ্গে একটি কথা বলেননি আকবর। প্রতি ম্যাচের আগে অন্যরা যখন বোন হারানো অধিনায়ক আর ম্যাচ নিয়ে টেনশনে, আকবর স্মিত হেসে আশ্বস্ত করেছেন, ‘ইনশা আল্লাহ, আমরা ভালো খেলব।’

 আকবরের চরিত্রের এই দৃঢ়তাই নাজমুল আবেদীনের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে—বাংলাদেশের ক্রিকেটের এর পরের স্তরগুলোয় এই ছেলে টিকে থাকতে পারবেন তো? টিকে থাকলেও এই মানসিক দৃঢ়তা কি থাকবে তখন?

 নাজমুল আবেদীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক ন্যাশনাল গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। কয়েক মাস হলো বিসিবির চাকরি ছেড়ে ক্রিকেট পরামর্শক হয়ে ফিরে গেছেন পুরোনো কর্মস্থল বিকেএসপিতে। সাকিব, মুশফিকদের তিনি চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। এখনো দুঃসময়ে এই ক্রিকেটারদের বিপর্যস্ত মনোজগতের সবচেয়ে বড় অবলম্বন ‘ফাহিম স্যার’ (নাজমুল আবেদীন)। একজন ভালো ক্রিকেটারকে তিনি শুধু ব্যাট-বলের পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করেন না; তাঁর বিচারিক মানদণ্ডে থাকে ওই ক্রিকেটারের পরিবার, শিক্ষা, আর্থসামাজিক অবস্থান, মানসিকতা, দর্শন এবং ব্যক্তিত্ব।

 যুব বিশ্বকাপে আকবর আর তাঁর সতীর্থদের খেলা যেমন দেখেছেন, তাঁদের মানসিক দৃঢ়তা সম্পর্কে যতটুকু জানেন, সবকিছুর যোগফলে এই ক্রিকেটারদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু যেন চিন্তিত নাজমুল আবেদীন, ‘ওরা যে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এই পর্যন্ত এসেছে, নিজেদের পরিমণ্ডল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের যে জীবনবোধ, সেখানে তারা মাথা নিচু করে খেলে না। কিন্তু একটু বড় হয়ে এরাই যখন ক্লাব ক্রিকেট, জাতীয় লিগে খেলতে যাবে, তখন এই পরিবেশ পাবে না। আত্মমর্যাদা ভুলে তাদের পরিস্থিতির সঙ্গে আপোস করতে হতে পারে। ওটাই হবে ওদের অগ্রগতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’

 বাংলাদেশের ক্লাব ক্রিকেটের সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে না বললেও চলে। যত বড় আর যত ভালো ক্রিকেটারই হোক, টিকে থাকতে হলে ক্লাবের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এমনকি সে ইচ্ছা নীতিবহির্ভূত হলেও। ঘরোয়া ক্রিকেটের এই পরিবেশের সঙ্গে যদি আকবর-অভিষেক মানিয়ে নিতে না পারেন, তখন কী হবে! শঙ্কার সঙ্গে একটা আশাও অবশ্য দেখালেন নাজমুল আবেদীন, ‘অনেক ক্রিকেটার বুদ্ধি খাটিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকতে পারে। ওরাও হয়তো পারবে। তবে আত্মমর্যাদা যেন না হারায়, দর্শন যাতে না বদলায়। এসব না থাকলে এই খেলাটাও হারিয়ে যাবে।’

 জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবির সাবেক পরিচালক গাজি আশরাফ হোসেনের মধ্যেও চিন্তাটা আছে। তাঁর মতে, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেট খেলেও কেন বেশির ভাগ ক্রিকেটার এগোতে পারেন না, সেটি নিয়ে এত দিনে একটি গবেষণাই হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আকবরদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁর পরামর্শ, ‘বিসিবির উচিত এই খেলোয়াড়দের পূর্ণ অভিভাবকত্ব নিয়ে নেওয়া। এরপর ওরা কোথায় খেলবে, ক্লাব ক্রিকেটে বা জাতীয় লিগে খেললে কে কোন লিগ বা দলে খেলবে...বিসিবির উচিত এই জিনিসগুলোও দেখা।’

 আকবর আলীর দলের যুব বিশ্বকাপ জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামনে নিয়ে এসেছে দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, বয়সভিত্তিক পর্যায়ের খেলার এই মান খেলোয়াড়েরা পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারেন কি না। আরেকটি চ্যালেঞ্জ, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে এমন সাফল্য অব্যাহত রাখা।

 বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের বর্তমান ধাপগুলো নতুন খেলোয়াড় সরবরাহের কাজটা ভালোভাবেই করছে। অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৮ পর্যায়ে প্রথমে জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়। জেলা পর্যায়ের সেরা দলগুলোকে নিয়ে হয় বিভাগীয় প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে বাছাই করা খেলোয়াড়দের নিয়ে জাতীয় ক্যাম্প হয়, তিন দলের একটা টুর্নামেন্ট হয়। সেখান থেকে নির্বাচিত ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠন করা হয় বিসিবির বয়সভিত্তিক দল।

 বিসিবি স্কুল ক্রিকেটও আয়োজন করে প্রতিবছর। মাঠের সংকট, অনেক স্কুল ও অভিভাবকদের উৎসাহের অভাব, এ রকম বাস্তব কিছু কারণে এই টুর্নামেন্ট থেকে খুব বেশি ক্রিকেটার উঠে আসে না।

 অংশগ্রহণটাই এখানে বড়। গাজী আশরাফ হোসেন যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটি বাস্তবতা পেলে অবশ্য বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাবানরাও নিজেদের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিতে পারবে, ‘একা বিসিবির পক্ষে সব করা সম্ভব নয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্রিকেট উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। ওই পর্যায়ে তাদের যে কমিটিগুলো আছে, সেগুলো সক্রিয় হলেই এটা সম্ভব। সরবরাহ সারিতে ক্রিকেটার বাড়াতে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এ রকম কিছু করা যায়।’

 এসব আলোচনায় সব সময় অবধারিতভাবেই উঠে আসে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বহুল আলোচিত আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা গঠনের প্রসঙ্গটিও। ক্রিকেট বোর্ডে যাঁরাই আসেন, তাঁরাই স্বীকার করে নেন, দেশের ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নে অঞ্চল ভিত্তিতে ক্রিকেট বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। কিন্তু আসল কাজটি কেউই করে না। বর্তমান বোর্ড মাঝেমধ্যে এ নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও সিলেটে নামমাত্র একটি একাডেমি শুরু করা ছাড়া কার্যত আর কিছুই হয়নি।

 বিসিবির সাবেক উপদেষ্টা এবং একসময়ে একাডেমির দায়িত্বে থাকা শাকিল কাসেম কাল আবারও তুললেন সেই প্রসঙ্গ, ‘আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা গঠন করে যদি সব কটি অঞ্চলে একটা করে একাডেমি গঠন করা যায়, তাহলে প্রতিটি একাডেমি থেকেই আমরা বিভিন্ন বয়সের ক্রিকেটার তুলে আনতে পারব। তারা তাদের অঞ্চলের একাডেমিতে তৈরি হবে এবং পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আসার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।’

 দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়ের পর আনন্দ-উল্লাস অনেক হয়েছে। আরও নিশ্চয়ই হবে। ক্রিকেটারদের জন্য বিভিন্ন রকম পুরস্কারের ঘোষণাও আসতে পারে। কিছু হলেই পুরস্কারে ভাসিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি অনেকের পছন্দ না হলেও নাজমুল আবেদীনের চিন্তা ভিন্ন, ‘৮ থেকে ১০ বছর ধরে অনূর্ধ্ব-১৩, ১৪, ১৬ ক্রিকেট পার হয়েই তারা এ পর্যন্ত এসেছে। খেলার জন্য ওরা শিক্ষাজীবন বিসর্জন দিয়েছে। এখন নিজেদের অন্য পেশার জন্য তৈরি করা তাদের জন্য কষ্টকর হবে। বিশ্বকাপ জেতার জন্য না হলেও এই ত্যাগ স্বীকারের জন্যও তাদের পুরস্কৃত করা যেতে পারে।’

 কথাটা বলেই যেন নতুন চিন্তায় পড়ে গেলেন ক্রিকেটারদের এই অভিভাবক। অর্থ–পুরষ্কার– যশ–খ্যাতি মিলিয়ে বিশ্বজয়ী ক্রিকেটারদের আর্থ–সামাজিক জীবনে যে পরিবর্তন সমাগত, সে সবই না আবার তাদের উন্নত মস্তককে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়।