১৯-এর দলের উপহার ১৩ অধিনায়ক

>
অনূর্ধ্ব-১৯ দল উপহার দিয়েছে সেরা অধিনায়কদের। ফাইল ছবি
অনূর্ধ্ব-১৯ দল উপহার দিয়েছে সেরা অধিনায়কদের। ফাইল ছবি

১৯৮৯ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ দল গঠিত হওয়ার পর বয়সভিত্তিক এ দল থেকেই দেশের ক্রিকেট পেয়েছে জাতীয় দলের ১৩ অধিনায়ককে।

১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছিল না। কীভাবে থাকবে, ক্রিকেটে তখন যে আমাদের হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা। তারপরও বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সে সময়ের উদীয়মান ক্রিকেটার আমিনুল অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন। তিনি খেলেছিলেন আইসিসি একাদশে। সেবার আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর উদীয়মান ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল আইসিসি একাদশ। আমিনুল ছিলেন সে দলের অন্যতম সদস্য।

সেই আমিনুলই পরবর্তী সময়ে দেশের ক্রিকেটের অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন। বিশ্বকাপে হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক। টেস্ট ক্রিকেটে দেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘হল অব ফেমে’র অংশ তিনি। আমিনুল বাংলাদেশের প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সদস্যও ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে ঘরের মাঠে আয়োজিত এশীয় যুব ক্রিকেটে তিনি মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ৬৬ বলে সেঞ্চুরি করে জানিয়ে দিয়েছিলেন দেশের ক্রিকেটে রাজত্বটা একদিন তিনি ঠিকই নিজের করে নেবেন। রাজত্বটা তিনি নিজের করেছিলেন ১৯৯৮ সালে। জাতীয় ক্রিকেট দলের অষ্টম অধিনায়ক হয়েছিলেন তিনি।

আমিনুলকে দিয়েই শুরু। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট এরপর একে একে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছে আরও ১২ অধিনায়ককে। খালেদ মাহমুদ, নাঈমুর রহমান, খালেদ মাসুদ, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, মুমিনুল হক, তামিম ইকবাল, রাজিন সালেহ আর শাহরিয়ার নাফীস—তাঁরা সবাই ক্রিকেটে নিজেদের হাত মকশো করেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলে। নির্দিষ্ট করে বললে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে কেবল গাজী আশরাফ হোসেন, মিনহাজুল আবেদীন, আকরাম খান আর মাশরাফি বিন মুর্তজাই কেবল কখনো অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেননি। তবে মাশরাফি এই জায়গায় কিছুটা আপত্তি তুলতে পারেন। তিনিও নিজেকে অনূর্ধ্ব-১৯ দল না হলেও বয়সভিত্তিক দলের আবিষ্কার বলতে পারেন। ২০০১ সালে দেশের মাঠে একটি আন্তর্জাতিক অনূর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, মাশরাফি খেলেছিলেন সেই টুর্নামেন্টে। তবে তাঁর উঠে আসার পেছনে ক্যারিবীয় কিংবদন্তি অ্যান্ডি রবার্টসের একটি পেস বোলিং ক্যাম্পের অবদান এতটাই যে তাঁর অনূর্ধ্ব-১৭ পরিচয়টাই অলক্ষ্যে ঢাকা পড়ে গেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতি থেকে।

বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, বিশেষ করে অনূর্ধ্ব-১৯ দল সব সময়ই উজাড় করে দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। ১৯৮৯ সালে গড়ে তোলা দেশের প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ দলটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিগন্ত বদলে দিয়েছিল—এটা জোরগলাতেই বলা যায়। খালেদ মাহমুদ আর সেলিম শাহেদ ছিলেন পালা করে সে দলের নেতৃত্বে। তবে এই দলটিকে প্রথম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদই। দলটিকে হিসাবে নিলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা বড় প্রভাব থাকবে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় গড়ে ওঠা অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলটির। নাঈমুর রহমান যে দলটির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৯৪ সালে কেনিয়ায় আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থতা বাংলাদেশকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। দেশের ক্রিকেট তখন হন্যে হয়েই জাতীয় দলে নতুন পারফরমারের সন্ধানে ছিল। দেশের ক্রিকেটের একটা প্রজন্ম তখন শুনছে নিজেদের বিদায়ের সুর। এমন সময় মালয়েশিয়ায় যুব এশিয়া কাপ জয় করে বাংলাদেশ। ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে জেতা সেই টুর্নামেন্ট ছিল দেশের ক্রিকেটের সাফল্যখরায় একপশলা শীতল বৃষ্টি। মালয়েশিয়ায় ট্রফি জেতা সে দলটির দুজন—নাঈমুর রহমান ও খালেদ মাসুদ পরবর্তীকালে টেস্ট ক্রিকেটে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ দলটিই ১৯৯৫ সালে ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় করেছিল। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সে জয়টি ভিত গড়েছিল পরবর্তীকালের অনেক সাফল্যের। দলটির বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই দেশের হয়ে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। নাঈমুর তো টেস্ট ক্রিকেটেই দেশের প্রথম অধিনায়ক।

২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রতি মনোযোগের মাত্রাটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দেশের ক্রিকেটে ভবিষ্যতের পাইপলাইন হিসেবে অনূর্ধ্ব-১৯–সহ বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তত্ত্বাবধানে। ২০০০ সালে শ্রীলঙ্কায় যুব বিশ্বকাপ খেলা বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজিন সালেহ। তিনি ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দুটি ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০০ সালের পর প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাফিস ইকবাল। তামিম ইকবালের এই বড় ভাইকে একসময় সম্ভাবনাময় তারকা হিসেবেই দেখা হতো। অনেকেই বলতেন, নাফিস ভবিষ্যতে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু নানা কারণে সেটি হয়নি। তবে তাঁর দলেই খেলা মোহাম্মদ আশরাফুল জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন।

শাহরিয়ার নাফীস আর মাহমুদউল্লাহর ২০০৪ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে একসঙ্গে খেলার কথা ছিল। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ সে আসরে খেললেও নাফীস রহস্যজনকভাবে বাদ পড়েছিলেন। অথচ, বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত নাফীস ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অপরিহার্য অংশ। সে যা–ই হোক, নাফীস পরবর্তী সময়ে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাহমুদউল্লাহকে অবশ্য এ দায়িত্ব পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও বেশ কয়েক বছর। ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচটিতে তিনি টস করতে নেমেছিলেন নাফীস।

টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে উঠে আসা জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি নাম সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিমই। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা বাংলাদেশ যুবদলে একসঙ্গে খেলেছিলেন এ দুজন। সঙ্গে ছিলেন তামিম ইকবাল। সাকিব ২০১১ সালে এক দফা অধিনায়কত্ব করে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। মুশফিক টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের যুবদল সতীর্থ তামিমেরও নিয়মিত না হলেও অধিনায়কত্বের স্বাদ পাওয়া হয়ে গেছে। মুমিনুল হালে সাকিবের নিষেধাজ্ঞাজনিত অনুপস্থিতিতে টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব সামলাচ্ছেন। একই কাজ টি-টোয়েন্টিতে করে যাচ্ছেন মাহমুদউল্লাহ।

দক্ষিণ আফ্রিকায় যুব বিশ্বকাপ জিতে আকবর আলী-তৌহিদ হৃদয়-পারভেজ হোসেন-শরিফুল ইসলাম, তানজীদ হাসানরা তাদের পূর্বসূরিদের অনেক ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে গেছেন। আর এ ব্যাপারটাই আশার পরিমাণটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে এসে আমিনুল-নাঈমুরদের পর সাকিব-মুশফিকরা যেমন দেশের ক্রিকেটকে দুহাতে উজাড় করে দিয়েছেন, ঠিক তেমনি আকবর-তৌহিদ হৃদয়রা দেশের ক্রিকেটকে নিয়ে যাবেন অন্য উচ্চতায়—এমন কিছু আশা করাটা বোধ হয় খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না।