'নাচটাকে ওরাই বিখ্যাত করেছে'

যুব বিশ্বকাপে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের এই নাচ এখন বিখ্যাত। ছবি: সংগৃহীত
যুব বিশ্বকাপে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের এই নাচ এখন বিখ্যাত। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিস গেইলের ‘গ্যাংনাম’ নাচের মতো বিখ্যাত হয়ে গেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পা বাঁকিয়ে, শরীর দোলানো নাচটাও। কিন্তু বাংলাদেশ যুব দলে তো আর গেইল নেই, উদ্‌যাপনের জন্য এই বিশেষ নাচ খেলোয়াড়দের শেখাল কে! কীই–বা নাম এই নাচের!

খেলোয়াড়দের এই নাচের গুরু আসলে যুব দলের ফিল্ডিং কোচ ফয়সাল হোসেন। প্রায় ২১ বছরের ঘরোয়া ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দাপটের সঙ্গেই খেলে গেছেন। ১ টেস্ট আর ৬ ওয়ানডের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সে তুলনায় বড় হয়নি। ২০১৬ সালে খেলা ছাড়ার পর কোচিংয়ে আসেন আবাহনীর সহকারী কোচের দায়িত্ব নিয়ে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে এবারের দক্ষিণ আফ্রিকা যুব বিশ্বকাপে ছিলেন ফিল্ডিং কোচের দায়িত্বে। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যুবাদের অসাধারণ ফিল্ডিং নৈপুণ্যের পেছনের গল্প শুনিয়েছেন তিনি। বলেছেন বিশেষ সেই নাচের কথাও—

প্রশ্ন: যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ফিল্ডিং অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। কাল তো বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানও আপনার কাজের প্রশংসা করলেন। তো আপনি আসলে খেলোয়াড়দের কীভাবে ভালো ফিল্ডিংয়ের জন্য প্রস্তুত করেছেন?

ফয়সাল: দেখুন, এই পর্যায়ে যারা খেলতে আসে, তারা ফিল্ডিংয়ের মৌলিক বিষয়গুলো শিখেই আসে। ক্যাচিং, গ্রাউন্ড ফিল্ডিং—এসব নতুন করে শেখানোর তেমন কিছু নেই। টেকনিক্যাল জিনিসগুলোর সঙ্গে আমি তাই বেশি চেষ্টা করেছি ছেলেদের মানসিক সাহস দিতে। ফিল্ডিংয়ে কেউ ভালো, কেউ খারাপ হবেই। আমি চেয়েছি সবাই অন্তত তার সেরাটা দিক। চেষ্টা করলেই পারবে, এই আত্মবিশ্বাস ওদের দিতে চেয়েছি। স্বাভাবিক মুহূর্তে ফিল্ডিংয়ে ভুল কম হয়। ভুল হয় চাপের মুহূর্তে। ওই সময় কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে বল তাড়া করতে হবে, ক্যাচ নিতে হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আর একটা জিনিস, কেউ ফিল্ডিংয়ে খারাপ করলেও আমি সাধারণত এ নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। কারণ কেউ তো ইচ্ছে করে খারাপ ফিল্ডিং করে না! একজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে বা একজন বোলার একটা বাজে বল করলে তার যতটা না জ্বলুনি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় একজন ফিল্ডারকে, যখন সে ক্যাচ ফেলে বা বাউন্ডারি ছাড়ে। কারণ, গোটা স্টেডিয়াম তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রশ্ন: ভালো ফিল্ডিং নাকি তখনই হয় যখন ফিল্ডার ফিল্ডিংটা উপভোগ করে। আপনিও তাই বলবেন?

ফয়সাল: অবশ্যই। মাঠে ফিল্ডিংটা উপভোগ করলেই কেবল ভালো ফিল্ডিং সম্ভব। এমনও দেখেছি প্র্যাকটিসে সহজ ক্যাচ ফেলে দিচ্ছে, কিন্তু মাঠে এর চেয়ে অনেক কঠিন ক্যাচও ওরা সহজেই ধরে ফেলছে। ফিল্ডিং উপভোগ করেছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। সঙ্গে ফিটনেসটাও অত্যন্ত জরুরি। এদিক দিয়ে আমি আমাদের ট্রেনার রিচার্ড স্টনিয়েরকে ধন্যবাদ দেব। খেলোয়াড়দের ফিটনেস ঠিক রাখার পাশাপাশি নানা রকমভাবে তাদের চাঙা রাখত সে। স্টনিয়ের আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে।

পচেফস্ট্রুমে টিম হোটেলের সামনে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে বাংলাদেশ যুব দলের ফিল্ডিং কোচ ফয়সাল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
পচেফস্ট্রুমে টিম হোটেলের সামনে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে বাংলাদেশ যুব দলের ফিল্ডিং কোচ ফয়সাল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন: আপনিও তো কম যাননি খেলোয়াড়দের চাঙা রাখার কাজে। সাফল্য উদ্‌যাপন করার জন্য একটা নাচই ওদের শিখিয়ে দিয়েছেন আপনি। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সেই নাচ তো এখন বিখ্যাত হয়ে গেছে!

ফয়সাল: (হাসি) আমি আসলে কিছুই করিনি। সেলিব্রেশন করার জন্য সব দলেরই একটা কিছু দরকার। আমি ভাবলাম মজার একটা নাচ হলে কেমন হয়! তো ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ড সফরের কোনো এক ম্যাচের পর সবাইকে আমার রুমে ডেকে এনে মজা করেই একটা নাচ দেখাই। আমি যতটুকু পারি আর কি! রুম ছোট ছিল বলে আমি খাটের ওপর উঠে নাচটা নেচেছি, ওরা সবাই সেটা দেখে রুমের মধ্যে নেচেছে। এরপর তো খেলোয়াড়েরাই এই নাচে এক্সপার্ট হয়ে গেছে। ওরাই নাচটাকে বিখ্যাত করেছে।

প্রশ্ন: কোনো নাম আছে এই নাচের?

ফয়সাল: না, কোনো নাম নেই। তবে এই নাচের সুবিধা হলো এটা যে কোনো মিউজিকের সঙ্গে নাচা যায়, যে কোনো গান গাইতে গাইতে নাচা যায়। এবারের বিশ্বকাপে যেমন কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর হোটেলের মিটিং রুমে একটা পাঞ্জাবি গানের সঙ্গে সবাই এই নাচ নেচেছি। আবার মাশরাফি-তাসকিনের ‘কোপা কোপা’ যে গানটা আছে, সেটার তালেও নেচেছি।

প্রশ্ন: একজন সফল কোচ হতে হলে খেলোয়াড়দের বন্ধু হওয়াটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

ফয়সাল: বন্ধু হয়ে ওদের মনোজগতে মিশে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো। আপনি তখন ওদের চিন্তাটা আরও ভালো করে বুঝবেন। ওরাও আপনার কথায় আস্থা রাখতে পারবে।

প্রশ্ন: আকবর আলীকে তো মনে হয় আপনিই তাঁর বোনের মৃত্যু সংবাদটা প্রথম দিয়েছিলেন...

ফয়সাল: হ্যাঁ, পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের পর মাঠ থেকে ফিরে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার কায়সারের রুমে আকবরসহ সবাইকে ডেকে আনি। আকবর জানত তার বোন সন্তানসম্ভবা। হয়তো সে কারণে আঁচ করতে পেরেছিল খারাপ কিছু হয়েছে। তো আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে শেষে খবরটা দিলাম। ও চমকে উঠে বলল, ‘আমার বোন!’ এরপর একটু কান্নাকাটি করল। ওই পর্যন্ত। আমি আমার ক্যারিয়ারে অনেক খেলোয়াড় দেখেছি। কিন্তু আকবরের মতো ঈশ্বর প্রদত্ত ধৈর্য আর কারও দেখিনি। বোন মারা যাওয়ার খবর শোনার পরদিন সে অনুশীলনে গেছে। আমার আর স্টনিয়েরের মতো আকবরেরও খুব ভোরে নাশতা খাওয়ার অভ্যাস। নাশতার টেবিলে দেখা হলেই বলতাম, ‘আকবর আর কিন্তু দুটি ম্যাচ, একটি ম্যাচ... সব ঠিক আছে তো! পারব তো আমরা?’ ও মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলেছে, ‘চিন্তা করবেন না, ইনশা আল্লাহ ভালো কিছুই হবে।’ পুরো টুর্নামেন্টে ওর কাছ থেকে কোনো নেতিবাচক কথা শুনিনি। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একটা ছেলের মধ্যে এ রকম ম্যাচিউরিটি বিরল।

প্রশ্ন: বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে খেলোয়াড়েরা তেমন উল্লাস করেনি। অধিনায়কের বোনের মৃত্যুর কারণেই কি?

ফয়সাল: বলতে পারেন এটাও একটা কারণ। কারণ দলের মধ্যে আমাদেরই একজনের এ রকম খারাপ সময় যাচ্ছে, ওই সময় এগুলো না করাই ভালো মনে হয়েছে সবার। বোন মারা যাওয়ার খবর পেয়েও যখন আকবরকে ও রকম শক্ত দেখলাম, তখন মনে হলো আকবরের বোনের জন্যই আমাদের কিছু করা দরকার।