ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট পেয়েছেন বাগেরহাটের রাজমিস্ত্রি

>ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে যাবেন বাংলাদেশের ৬ ফুটবলার। তাঁদের মধ্যে একজন পেশায় রাজমিস্ত্রি।
বল পায়ে রাজমিস্ত্রি খালিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
বল পায়ে রাজমিস্ত্রি খালিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ম্যানচেস্টার সিটিতে অনুশীলন করতে যাওয়ার আগে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করছেন?

‘প্র্যাকটিস করছি তো’

কেমন প্র্যাকটিস চলছে?

ফোনের অপর প্রান্তে থেকে যে জবাব পাওয়া গেল, তাতে অবাকই হতেই হলো, ‘কাজ কম করে এখন প্র্যাকটিস করতেছি। জোগালের (রাজমিস্ত্রি) কাজটা এখন কমাই দিয়েছি।’

তিনি মোলাহ খালিদ হোসেন। নিজ এলাকায় যাঁর পরিচয় রাজমিস্ত্রি। এই পেশার পাশাপাশি কোনো রকম পড়াশোনা চালিয়ে ও ফুটবল খেলেই আদায় করে নিয়েছেন ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউনিলিভারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্লিয়ার মেন অনূর্ধ্ব-১৭ স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেরা ছয়জন খেলোয়াড়কে ম্যানচেস্টার সিটিতে স্বল্প সময়ের জন্য অনুশীলন করার সুযোগ এনে দিয়েছে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি। সেই ছয়জনের একমাত্র গোলরক্ষক খালিদ।

চিরুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন খালিদ। খুলনা বিভাগীয় ফাইনালে কালিয়া সরকারি পাইলট স্কুলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ঢাকার চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেন তাঁরা। মূল পর্বে এসে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও এই গোলরক্ষকের পারফরমেন্স উঠে যায় কোচদের নোট বুকে। পুরো টুর্নামেন্ট থেকে বাছাই করা ৩৬ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ডাক পড়ে। সেখান থেকে সেরা ৬ জন বেছে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) আয়োজন করা হয় ২১ দিনের ক্যাম্প। সব বাছাই শেষে সেরা ছয়জনে খালিদ। আগামী মাসেই উড়াল দেবেন পেপ গার্দিওলার ক্লাবের উদ্দেশে।

খালিদের বাবা শারীরিকভাবে অক্ষম, মা গৃহিণী। একমাত্র ছেলে হিসেবে সংসারের চালানোর দায়টা তাঁর কাঁধে এসেই বর্তায়। তাই পড়াশোনা ও ফুটবল খেললেও সংসার চালানোর জন্য রাজমিস্ত্রি পেশাকেই বেছে নিতে হয়েছে। চার বছর ধরে কাজ করলেও এখনো প্রধান রাজমিস্ত্রি হয়ে উঠতে পারেননি। সহকারী হিসেবে (জোগাল) কাজ করে হাতে উঠে দৈনিক ৪০০ টাকা। এই দিয়েই চলে সংসার। সেই মেহনতি হাতেই ফুটবল গেলে লেগে যায় চুম্বকের মতো। এমনি এমনি তো আর ২৭২টি স্কুলের সেরা ছয়জনের মধ্যে নাম ওঠেনি তাঁর।

চার বছর ধরে জোগাল হিসেবে কাজ করলেও ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি নেশা। কোনো রকম চালিয়ে যাচ্ছেন পড়াশোনাও। কাজ থাকলে সকালের অনুশীলন শেষ করে কাজে যোগ দেওয়া। আর কাজ না পেলে বিকেলে অনুশীলন। এভাবেই একটু একটু ভেঙে ভেঙে নিজেকে তৈরি করেছেন খালিদ। তবে এতে প্রধান রাজমিস্ত্রির সহায়তা না পেলে সম্ভব হতো না বলে জানান খালিদ, ‘ফুটবল ভালো খেলি তো, উস্তাদ (আব্বার চাচাতো ভাই) আমাকে খুব আদর করেন। অন্য জোগালেরাও আমারে ভালো জানে। তারা আমাকে খেলার জন্য উৎসাহ দেয়। তাই কাজ একটু কম করলেও কেউ কিছু বলে না।’

এতক্ষণে মনে হতে পারে, ম্যানচেস্টার সিটিতে সুযোগ পাওয়ার পরে বোধ হয় রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়েছে খালিদ। না। ১ জানুয়ারি ক্যাম্প শেষ করে বাগেরহাটে ফিরে ফুটবল চলছে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে পারছেন না রাজমিস্ত্রি পেশা থেকে বের হয়ে আসতে, ‘ক্যাম্প থেকে এসে এবার কাজ কাজ কম করা হয়েছে। ১৫-১৬ দিনের মতো করেছি। এ ছাড়া তো আর উপায় নেই।’

রাজমিস্ত্রির কাজ করায় যে ছেলেটা এত দিন বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা বলার সাহস পাননি, ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট সেই সাহস এনে দিয়েছে খালিদকে, ‘আমি তো বড় ফুটবলারই হতে চাই। কিন্তু কাজও তো আমাকে করতে হয়। ফুটবলে ভালো কিছু করতে পারলে এখন থেকে শুধু ফুটবল নিয়েই থাকব। ওখানে গিয়ে তো অনেক কিছু শিখতে পারব। তা দেশে এসে কাজে লাগাতে হবে।’

ম্যানচেস্টার সিটির একজন গোলরক্ষককে ভালো লাগে খালিদের, কিন্তু খুব চেষ্টা করেও নামটি বলতে পারল না। তবে সেই গোলরক্ষকই যদি স্বল্প সময়ের অনুশীলনে সামনে এসে দাঁড়ান, তখন নিশ্চয়ই মনে পড়বে।