মোহাম্মদ আলীকে মনে করিয়ে দিলেন টাইসন ফিউরি

আবারও বক্সিং দুনিয়ার চূড়ায় উঠলেন ব্রিটেনের টাইসন ফিউরি। পাঁচ বছর ধরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন থাকা যুক্তরাষ্ট্রের দিওন্তে ওয়াইল্ডারের বিপক্ষে আগাগোড়া আধিপত্য দেখিয়ে জিতে নিলেন হেভিওয়েট শিরোপা
ফিউরির সামনে দাঁড়াতেই পারেননি ওয়াইল্ডার। ছবি: ইএসপিএন টুইটার
ফিউরির সামনে দাঁড়াতেই পারেননি ওয়াইল্ডার। ছবি: ইএসপিএন টুইটার

এমন দিনও জীবনে আসবে, খোদ টাইসন ফিউরি ছাড়া অন্য কেউ ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না।

এই তো কয়েক বছর আগের কথা। মার্কাস ট্রেসকোথিক, জোনাথান ট্রটরা যে কারণে ক্রিকেট ছেড়েছিলেন, সে একই কারণে টাইসন ফিউরি বক্সিং ছাড়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিলেন। ঠিক ধরেছেন, সেই মানসিক অবসাদ। মানসিক অবসাদের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের অভিশাপ তো ছিলই। ওজন বেড়ে হয়ে গেল ৪০০ পাউন্ড, স্বাভাবিক ক্ষিপ্রতা হারালেন, ড্রাগ নেওয়া শুরু করলেন। আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন।

এই মানসিক অবসাদের কারণে একে একে আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশন (আইবিএফ), বিশ্ব বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউবিএ), বিশ্ব বক্সিং সংস্থা (ডব্লিউবিও), আন্তর্জাতিক বক্সিং সংস্থা (আইবিও), ‘দ্য রিং’ ম্যাগাজিন প্রণীত প্রত্যেকটি হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর কাছ থেকে, রিং এর মধ্যে কেউ তাঁকে হারাতে পারেননি। দুই বছর ধরে মানসিক অবসাদের সঙ্গে লড়ে কয়েক মাস আগে আবারও ফিরেছেন এই তারকা। এসেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বিশ্ব বক্সিং কাউন্সিলের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের দিওন্তে ওয়াইল্ডারকে। ওয়াইল্ডারকেও ফিউরির মতো কেউ এর আগে হারাতে পারেননি।

দুজনের সেই প্রথম দেখায় জিতেননি কেউই, ম্যাচটা ড্র হয়েছিল। যদিও অনেকের মতে সে ম্যাচে ফিউরির প্রতি অবিচার করেছিলেন বিচারকেরা। না হয় জিততেন ফিউরিই। সে অবিচারের ‘বদলা’ আজ সুদে-আসলে নিলেন নিজেই। আবারও বক্সিং সাম্রাজ্যের অধিপতির আসনে আসীন হলেন ব্রিটেনের এই বক্সার। দ্বিতীয়বারের দেখায় লাস ভেগাসে ওয়াইল্ডারকে সাত রাউন্ডে পর্যুদস্ত করে জিতে নিলেন বিশ্ব বক্সিং কাউন্সিল, দ্য রিং ম্যাগাজিন ও লিনেয়াল হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ। আর ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো দ্য রিং ম্যাগাজিনের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলীর পাশে দাঁড়ালেন ফিউরি। আলীও এই চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন দুবার। আলী আর ফিউরির চেয়ে বেশিবার এই চ্যাম্পিয়নশিপ আর কেউ জিতেননি।

বর্তমান বক্সিং ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচের আগে মাইক টাইসন, ভ্লাদিমির ক্লিচকো, অ্যান্থনি জোশুয়া, ফ্রাঙ্ক ব্রুনো, লেনক্স লুইস, জর্জ ফোরম্যানের মতো সাবেক ও বর্তমান কিংবদন্তিরা টাইসন ফিউরির পক্ষ নিয়েছিলেন। ওদিকে ইভান্ডার হলিফিল্ড ও ডেভিড হায়ের মতো কিংবদন্তি বক্সাররা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দিওন্তে ওয়াইল্ডারের। ওয়াইল্ডারের ঘুষি বিশ্ববিখ্যাত। এই ঘুষি দিয়েই ‘নক আউট’ করেছেন বার্মান স্টিভার্ন, লুইস অর্তিজের মতো তারকাদের।

কিন্তু বক্সিং-বিধাতা যে নির্ধারণ করেই রেখেছিলেন, আজ শুধুই টাইসন ফিউরির পুনরুত্থান কাব্য রচিত হবে লাস ভেগাসে। সেটাই হলো।

প্রথম রাউন্ড থেকেই দুর্নিবার ফিউরি। মাথার দুর্দান্ত মুভমেন্টে ওয়াইল্ডারের নকআউট করার প্রত্যেকটা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছেন। উল্টো ফিউরির দেওয়া কিছু ‘জ্যাব’ এর জবাব জানা ছিল না ওয়াইল্ডারের। আস্তে আস্তে নিজের ভারসাম্য হারিয়েছেন, সুযোগ বুঝে ওয়াইল্ডারের কানে আঘাত করে রক্তবন্যা বইয়েছেন ফিউরি। এমনকি নিজের পায়ের কাছ থেকেও তেমন সাড়া পাচ্ছিলেন না ওয়াইল্ডার। নিজের ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠতম ম্যাচটা খেলে ওয়াইল্ডারকে সাত রাউন্ডের মধ্যে হারিয়ে দিতে তাই বেগ পেতে হয়নি ফিউরির। ওয়াইল্ডারের ভগ্নদশা দেখে সপ্তম রাউন্ডে তাঁর ক্যাম্পের লোকজনই সাদা তোয়ালে ছুড়ে মেরে ফিউরির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেন, ম্যাচ থামাতে বাধ্য হন রেফারি। আর তাতেই টাইসন, লুইস, জোশুয়া, ক্লিচকোদের ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে ফিউরি হয়ে যান হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। আর ওয়াইল্ডারের কপালে জোটে ক্যারিয়ারের প্রথম পরাজয়।

এই জয়ের মাধ্যমে ফিউরি এমন দুই বক্সারকে হারালেন যারা ন্যূনতম দশ বার নিজের চ্যাম্পিয়নশিপ সফলভাবে ‘ডিফেন্ড’ করেছিলেন - ভ্লাদিমির ক্লিচকো (১৮ বার) ও দিওন্তে ওয়াইল্ডার (১০ বার)। ইতিহাসের প্রথম বক্সার হিসেবে ক্যারিয়ারে অন্ততপক্ষে একবার ডব্লিউবিএ, ডব্লিউবিসি, ডব্লিউবিও, আইবিও, আইবিএফ, দ্য রিং, লিনেয়াল হেভিওয়েট শিরোপা জিতলেন ফিউরি। এ কৃতিত্ব মোহাম্মদ আলী বা মাইক টাইসনেরও নেই।

অপেক্ষা এখন আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশন (আইবিএফ), বিশ্ব বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউবিএ), বিশ্ব বক্সিং সংস্থা (ডব্লিউবিও), আন্তর্জাতিক বক্সিং সংগঠন (আইবিও) হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন অ্যান্থনি জোশুয়ার সঙ্গে লড়াই করার। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি ম্যাচটা হবে কি না, তবে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর সে ম্যাচ যদি হয়, ও টাইসন ফিউরি যদি জিতে যান, বক্সিং জগতের একাধিপতি হবেন তিনিই।