'শেষ' চ্যালেঞ্জে জয়ী হবেন মাশরাফি?

‘শেষ’ চ্যালেঞ্জে জেতার অপেক্ষায় মাশরাফি। ফাইল ছবি
‘শেষ’ চ্যালেঞ্জে জেতার অপেক্ষায় মাশরাফি। ফাইল ছবি

শিরোনামের ‘শেষ’ শব্দটাতে আপত্তি থাকতে পারে মাশরাফি বিন মুর্তজার। চ্যালেঞ্জ নিতে নিতেই তো এত দূর আসা। শেষ চ্যালেঞ্জ আবার কী?

উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় আট মাস আগে। গত বছর ৫ জুলাই লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের শেষ ম্যাচ থেকে এ পর্যন্ত ক্রিকেটে মাশরাফির সময়টা কেমন কাটল? জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ওয়ানডের সিরিজ খেলতে আজ সন্ধ্যায় যাঁদের নিয়ে তিনি সিলেটের উদ্দেশে উড়াল দেবেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের সুতোয় এই আট মাসে কি একটুও টান পড়েনি?

বাংলাদেশ দলে মাশরাফির জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন কখনোই ছিল না। সুখ-দুঃখে ক্রিকেটারেরা সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে তাঁকেই জানেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও অন্য সবার চেয়ে মাশরাফির ওপর আস্থা রেখে বেশি স্বস্তি পায়। অধিনায়ক বলে তো বটেই, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের কারণেও বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা সেতুবন্ধের মতো তাঁর ভূমিকা। কিন্তু সময় যে সবকিছুই বদলে দেয়!
বিশ্বকাপের পর থেকে মাশরাফিকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনাই হয়েছে বেশি। বোতলের ছিপি খুলে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে অধিনায়ক মাশরাফির পারফর্ম করতে না পারা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সেরা পারফরমার। আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে সাকিব এখন দলে নেই। কিন্তু যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গেও কি মাশরাফির সম্পর্কটা আগের মতোই স্বাভাবিক আছে?

কাছের মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, তাঁদের উপেক্ষা মাশরাফির মনেও দাগ কাটতে বাধ্য। যাঁরা ভাবছেন, বিসিবি আর সতীর্থদের কাছ থেকে পাওয়া গত সাত মাসের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও মাশরাফি আগের মতোই থাকবেন, তাঁরা হয়তো বোকার স্বর্গে বাস করছেন। সিলেটে অধিনায়ক হিসেবে শেষ সিরিজে মাশরাফি নিশ্চিতভাবেই মাঠে তাঁর সর্বোচ্চটা ঢেলে দিতে চাইবেন। কিন্তু যখন দেখবেন তাঁর আশপাশে থাকাদেরও অনেকেই এই আট মাসে নেতা মাশরাফিকে ‘না’ ভোট দিয়ে রেখেছেন, তখন কতটা আত্মবিশ্বাসী থাকবেন তিনি!
মাশরাফিও জানেন বিশ্বকাপে তিনি প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের মন্তব্যের কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি হয়তো সে কারণেই। তবে এটিও সত্যি, প্রিয় সতীর্থের ওই কথা তাঁর বুকে শেল হয়ে বিঁধেছে। খারাপ খেললে সমালোচনা হয়, ক্রিকেটাররা তা মেনেও নেন। কিন্তু ড্রেসিংরুমের একজনও যদি সমালোচকদের কাতারে চলে যান, প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মন থেকে তা মেনে নেওয়া কঠিন। দিন শেষে মাশরাফিরাও তো মানুষ!

মাশরাফি সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছেন গত অক্টোবরে ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের আন্দোলনের সময়। মাঠে, মাঠের বাইরে ক্রিকেটারদের নেতা হয়ে থাকতেই অভ্যস্ত তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে নজিরবিহীন ওই আন্দোলনে সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ থেকে শুরু করে মাশরাফির খুব কাছের তরুণ ক্রিকেটারটিও যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলেন-মাশরাফি তাঁদের নেতা নন। ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত ক্রিকেটাররা ওয়ানডে অধিনায়ককে বুঝতে দেননি তাঁরা এমন কিছু করতে যাচ্ছেন। উল্টো পুরো বিষয়টি সচেতনভাবে গোপন করা হয় মাশরাফির কাছ থেকে। ক্রিকেটারদের ভয় ছিল, মাশরাফি তো এখন আর শুধু খেলোয়াড়ই নন, তাঁর একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সে পরিচয় না আবার কোনোভাবে দাবি আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়!
ড্রেসিংরুমের দীর্ঘদিনের সঙ্গীদের এই অনাস্থা একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল মাশরাফির জন্য। হতভম্ব অধিনায়কের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ক্রিকেটারদের অনেকের সঙ্গে এরপর তিনি যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন, নিজেকে নিয়েছেন গুটিয়ে। হতে পারে মাশরাফিকে নিয়ে ক্রিকেটারদের ভাবনা অপ্রিয় বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিল, তবে মাশরাফির অভিমানও অযৌক্তিক নয়। যাঁদের সঙ্গে এক থালায় খাওয়ার সম্পর্ক, যাঁদের তিনি পরিবারের সদস্যের মতো দেখতেন, তাঁরা তাঁকে এতটা দূরের মানুষ ভাবেন, সেটি মানা সত্যিই কঠিন।

বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ আলোচিত বিষয় সম্ভবত ‘মাশরাফির অবসর’। ক্যারিয়ারজুড়ে চোটের সঙ্গে লড়াই করা ৩৬ বছর বয়সী মাশরাফি ক্রিকেটকে কবে বিদায় বলবেন, এটি শোনার জন্য যেন পুরো জাতির অপেক্ষা! বিসিবি যেমন বলেছে, মাশরাফি কবে অবসর নেবেন, সে সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন, তেমনি প্রসঙ্গ এলেই বোঝাতে চেয়েছে মাশরাফির উচিত এখন সরে যাওয়া। তাঁর জন্য বিদায়ী ম্যাচ আয়োজনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে বোর্ডের শীর্ষ পর্যায় থেকে। জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে তো বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান ঘোষণাই দিয়ে দিলেন, এই সিরিজই হতে চলেছে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির শেষ।
সাকিবের সমালোচনা, সতীর্থদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, বোর্ড সভাপতির ঘোষণা-সিলেটে ১ মার্চ মাশরাফি যখন দল নিয়ে মাঠে নামবেন, এসব কি প্রতিধ্বনিত হবে না তাঁর কানে! মাশরাফি কি পারবেন সব ভুলে আরও একবার সবার নেতা হয়ে উঠতে?
অধিনায়ক মাশরাফির শেষ চ্যালেঞ্জটা এখানেই। মাঠের খেলায় হার-জিত পরে, আগে দলের ভেতর জিততে হবে অধিনায়ককে।