দাঙ্গা যখন বারোটা বাজিয়েছিল ক্রিকেটের
>আবহাওয়া-সংক্রান্ত কোনো সমস্যা নয়, মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যায় ক্রিকেট ম্যাচ পণ্ড হয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা আছে। অনেকে দেশেই ঘরোয়া ক্রিকেটে দর্শক হাঙ্গামার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দর্শকদের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাঘাত ঘটার ঘটনা কিন্তু খুব বেশি নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে এ ধরনের চারটি ঘটনা তুলে ধরা হলো...
অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, স্যাবাইনা পার্ক, কিংস্টোন, ১৯৭৮
এটি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বাজে ঘটনা হয়ে আছে। সেবার অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করছিল। ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফির পঞ্চম টেস্ট একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে দর্শক-হাঙ্গামায় পণ্ড হয়ে গিয়েছিল। প্রথম চার টেস্টের তিনটিতে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন এগিয়ে ৩-১ ব্যবধানে। জ্যামাইকার কিংস্টোনের স্যাবাইনা পার্কে শেষ টেস্টে দারুণ ক্রিকেট খেলে অস্ট্রেলিয়া জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। ৩৬৯ রানের লক্ষ্যে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে উইন্ডিজের অবস্থা তখন তথৈবচ—২৫৮ রান তুলতে নেই ৯ উইকেট। ঠিক সে সময় স্যাবাইনা পার্কের দর্শকেরা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। গ্যালারি থেকে শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ।
ব্যাপারটির শুরু নবম উইকেট পতনের সময় থেকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভ্যানবার্ন হোল্ডার তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া কট বিহাইন্ডের সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে পারেননি। তাঁর বিরক্তি প্রকাশের ধরনই আসলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল গ্যালারিতে। দর্শকদের ইট-বৃষ্টির মধ্যে টেস্ট জয় দূরে থাক, সে সময় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের মাথা বাঁচানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত টেস্টটি জেতার আশা ত্যাগ করতে হয় তাদের। খেলাটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
ইংল্যান্ড-পাকিস্তান, ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি, হেডিংলি ২০০১
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানকে নিয়ে সেবার আয়োজিত হয়েছিল ত্রিদেশীয় ন্যাটওয়েস্ট ওয়ানডে সিরিজ। প্রতিটি ম্যাচেই বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল দর্শকদের মাঠে ঢুকে পড়ার বিষয়টি। হেডিংলিতে রাউন্ড রবিন লিগে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান ম্যাচে দর্শকদের আচরণ সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওয়াকার ইউনিসের দুর্দান্ত বোলিংয়ে সে ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১৫৬ রানে গুটিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান। ম্যাচটা পাকিস্তান এমনিতেই জিতে যেত, কারণ ব্যাটসম্যানরা দারুণভাবেই সামলাচ্ছিলেন ইংলিশ বোলারদের। ম্যাচটি যখন শেষের দিকে তখনই অতি উৎসাহী দর্শকেরা মাঠে ঢুকে পড়ে। এদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তানি সমর্থক। আতঙ্কিত ইংলিশ ক্রিকেটাররা এমন অবস্থায় মাঠে থাকার ঝুঁকিটা নিতে চায়নি। ব্যাপারটা খারাপ পর্যায়ে চলে যায় উচ্ছৃঙ্খল দর্শকেরা একজন পুলিশকে প্রহার করলে। সে ঘটনার পর ইংলিশ অধিনায়ক অ্যালেক স্টুয়ার্ট বাকি ম্যাচটি খেলার আর কোনো কারণই দেখেননি।
পাকিস্তান-ইংল্যান্ড টেস্ট, করাচি, ১৯৬৯
গোটা পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এ অবস্থায় তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড পা রাখে দেশটিতে। ইংল্যান্ডের টেস্ট তিনটি ছিল লাহোর, ঢাকা ও করাচিতে। উত্তেজনা থাকলেও লাহোর আর ঢাকার টেস্ট দুটিতে বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। কিন্তু করাচিতে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটি পণ্ড হয়ে যায় দর্শক-পুলিশ সংঘর্ষে।
প্রথম দুই টেস্ট ড্র হয়েছিল। করাচি টেস্টের প্রথম দুই দিনে ইংল্যান্ড স্কোরবোর্ডে ৬ উইকেটে তোলে ৪১২ রান। অ্যালান নট তখন ৯৬ রানে অপরাজিত। ঠিক সে সময় পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গা বেঁধে যায় দর্শকদের। সে সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে হাজার হাজার দর্শক মাঠে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়। পিচও খুড়ে ফেলা হয়। তছনছ করা হয় করাচি ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের ভিআইপি এনক্লোজার। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে ইংল্যান্ড দল সে রাতেই লন্ডনের ফ্লাইট ধরে পাকিস্তান ত্যাগ করে।
ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কলকাতা, ১৯৬৭
প্রথম টেস্ট জিতে সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এগিয়ে ১-০ ব্যবধানে। শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ভারত দ্বিতীয় টেস্টে মাঠে নামে কলকাতায়। খেলাধুলা-পাগল কলকাতার দর্শকদের কাছে সে ম্যাচের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। ইডেন গার্ডেনের দর্শক ধারণ-ক্ষমতা তখন ছিল ৮০ হাজারের ওপর। অতিরিক্ত দর্শক-চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট বড়ই ছিল ঐতিহাসিক মাঠ ইডেনের ব্যাপ্তি। কিন্তু সমস্যা বাঁধে অসাধু টিকিট-বিক্রেতাদের কারণে। তারা কালো বাজারে টিকিট জাল করে বিক্রি করা শুরু করে। টেস্টের প্রথম দিন দর্শকদের চাপে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে হাজার হাজার দর্শককে গ্যালারিতে জায়গায় দেওয়া যায়নি। বাউন্ডারি লাইনের বাইরে মাঠে বসেই তারা টেস্টের প্রথম দিনের খেলা উপভোগ করেছিল। দ্বিতীয় দিন দর্শকদের ওপর পুলিশি লাঠিপেটা পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ করে তোলে। ক্ষুব্ধ দর্শকেরা ইডেন গার্ডেনে আগুন ধরিয়ে দেয়। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ পর্যন্ত পণ্ড হয়ে যায়। এ অবস্থায় সিরিজ বাতিল করে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিল ক্যারিবীয় দল। কিন্তু অনেক অনুরোধ, দেন-দরবারের পর তারা টেস্টটি শেষ করতে রাজি হয়। ম্যাচে ভারত হেরে যায় ইনিংস ব্যবধানে।