কতটা বদলেছে তামিমের ব্যাটিং?

তামিমের ব্যাটিং নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ছবি: শামসুল হক
তামিমের ব্যাটিং নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ছবি: শামসুল হক
>জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ধীরগতির ব্যাটিং করেছেন তামিম ইকবাল। সংক্ষিপ্ত সংস্করণে তামিমের ব্যাটিং বদলেছে—এ কথা বলা হচ্ছে বেশ আগে থেকেই। কিন্তু তামিমের ব্যাটিং ঠিক কতটা কোথায় বদলেছে কিংবা আদৌও কি বদলেছে?

কিছুদিন ধরেই তামিম ইকবালের ব্যাটিং আলোচনায়। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন নেই। আলোচনাটা সংক্ষিপ্ত সংস্করণে। ইনিংসের এক প্রান্ত ধরে রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন তামিম ইকবাল। এর ফলে রান তোলার গতিটা কমে যাচ্ছে বেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেই যেমন ৪৩ বলে ২৪ রান তোলার পর চলছে কড়া সমালোচনা। এত ধীরগতির ইনিংস চিরচেনা তামিম ইকবালের সঙ্গে নাকি যায় না। আসলেই কি তা–ই?

প্রথমেই তামিমের ক্যারিয়ারে নজর বোলানো যাক। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২০৩ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে মোট ৫৮ বার পঞ্চাশ বা তার বেশি করা তামিম ৬ হাজার ৯১৬ রান করেছেন ৩৫.৪৬ গড়ে। তবে এর সঙ্গে তামিমের ব্যাটিং স্টাইল বা রান তোলার গতির সম্পর্ক নেই। সম্পর্কটা বোঝা যাবে অন্য দুই পরিসংখ্যানে। তাঁর ক্যারিয়ার স্ট্রাইকরেট ৭৭.৬৩।

এ তো গেল পুরো ক্যারিয়ারের হিসেব। কিন্তু তামিমের ক্যারিয়ার তো সব সময় একই ছন্দে এগোয়নি। এই ওপেনারের কথা তোলা মানেই মাথায় আসে শুরুর দিককার আগ্রাসনের কথা। আর মাঝের পরিণত তামিম ও বর্তমানের কিছুটা ধীরগতির তামিম। সে চিন্তা থেকে তামিমের ক্যারিয়ারকে তিন ভাগে ভাগ করে দেখা যাক কী অবস্থা।

২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি অভিষেক হয়েছিল তামিমের। এ সময় যে তামিম বেশ আগ্রাসন নিয়ে খেলতেন—এ নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই, তাই না? এগিয়ে এসে জহির খানকে মারা সেই ছক্কাকে ভুলতে পারবেন! ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তামিমের পরিসংখ্যান কি তা বলে? এ সময়ে ৯১ ইনিংসে ৩০.২৬ গড়ে ২৭৫৪ রান করেছেন। তাতে ৩ সেঞ্চুরি আর ১৭ ছক্কা। প্রতি ৪.৫ ইনিংসে একটি ফিফটি ছাড়ানো ইনিংস। কিন্তু স্ট্রাইক রেট ৭৯.৫৭। যা তার স্ট্রাইক রেটের চেয়ে মাত্র ২ বেশি। অর্থাৎ খুনে মেজাজে খেলা তামিমের স্ট্রাইকরেটও কিন্তু খুব একটা বেশি ছিল না!

এর পরের ধাপে যাওয়া যাক। ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টাই হয়তো তামিমের সবচেয়ে কঠিন সময়। এ সময়ে ৪৫ ইনিংস খেলা তামিম ১২৩৬ রান করেছেন মাত্র ২৮.০৯ গড়ে। মজার ব্যাপার এ সময় কিন্তু প্রতি ৪ ইনিংসেই অন্তত একবার পঞ্চাশ পেরিয়েছেন তামিম (১ সেঞ্চুরি, ১০ ফিফটি)। কিন্তু তাঁর স্ট্রাইক রেটটা ছিল ৭২.৫৭। অর্থাৎ রান তোলা কমার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রাইকরেটও পড়ে গিয়েছিল তামিমের।

ঝড় তোলার ক্ষমতা দেখাবে পারবেন তামিম? ছবি: প্রথম আলো
ঝড় তোলার ক্ষমতা দেখাবে পারবেন তামিম? ছবি: প্রথম আলো

এরপরই নিজের সেরা সময় কাটিয়েছেন তামিম। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত তামিম ৬৭ ইনিংসে ব্যাট করেছেন। ৬৭ ইনিংসে ৪৮.৭৬ গড়ে ২৯২৬ রান। সেটাও ৭৮.১৫ স্ট্রাইকরেটে। যা তাঁর ক্যারিয়ারের স্ট্রাইকরেটের চেয়েও বেশি। আর এ সময়ে ৭ সেঞ্চুরি আর ২০ ফিফটি আছে। অর্থাৎ প্রতি আড়াই ইনিংসেই একবার পঞ্চাশ পাচ্ছেন তামিম। অর্থাৎ বর্তমানের তামিমই সবদিক মিলিয়ে সেরা তামিম।

না, এতটা মোটা দাগে দেখাটা হয়তো ভুল হচ্ছে। বরং ২০১৮ সাল থেকে হিসাব করা যাক। কারণ, সেবারই প্রথম তামিমের ক্ষেত্রে ইনিংসের এক প্রান্ত ধরে খেলার কথা ব্যবহৃত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজে ভালো করার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ওভাবে দুটি সেঞ্চুরিও পেয়েছেন। দেশের মাটিতেও উইন্ডিজের বিপক্ষে সেরা পারফরমার ছিলেন। তামিমও ধীরে ইনিংস গোছানোর মন্ত্র ধরে রেখেছেন। শুরুতে ভালোই ফল মিলছিল। কিন্তু নিকট অতীত বলছে দীর্ঘ মেয়াদে এটা তাঁর ও দলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালেই ২ সেঞ্চুরি ও ৬ ফিফটি করা তামিম পরের ১৪ মাসে পেয়েছেন মাত্র ৩ ফিফটি। ৪২.৫৯ গড়টা তাঁর ক্যারিয়ারের চেয়ে ভালো। কিন্তু ৭৪.১৯ স্ট্রাইক রেট বলছে, এ গড় দলের অন্যদের ওপর রান তোলার গতি ধরে রাখার জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

তামিম আসলেই বদলে গেছেন কি না—এ প্রশ্নের উত্তর আরেকভাবেও দেওয়া যেতে পারে। সেটা হলো চার-ছক্কা মারায় তামিমের আগ্রহ এখন কেমন সেটা দেখা। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৭৫৬টি চারের সঙ্গে ৮২টি ছক্কা মেরেছেন তামিম। যে ইনিংসগুলোতে শূন্য পেয়েছেন, সেগুলো বাদ দিলে ইনিংস প্রতি ৪টি চার মেরেছেন। আর প্রতি ০.৪৪ ইনিংসে এক ছক্কা।

ক্যারিয়ারের প্রথমভাগে অর্থাৎ ২০১১ পর্যন্ত তামিম কিন্তু ইনিংস প্রতি ৩.৭৫টি চার মারতেন। আর ছক্কার বেলায় সেটা ০.৫১ ইনিংসে। তরুণ তামিম যে ছক্কা মারায় আগ্রহ বেশি ছিলেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে এতে। কিন্তু মোটা দাগের পরিসংখ্যান যা বলছে না, তরুণ তামিম প্রথম দিকে অধিকাংশ ম্যাচেই শুরুতে ফিরে যেতেন। আর যেদিন টিকে যেতেন সেদিন বাউন্ডারির ফুলঝুরি ছোটাতেন। এ কারণেই এ সময়ের ইনিংস প্রতি গড়টা ক্যারিয়ারের কাছাকাছিই দেখাচ্ছে। এ সময়ের ২১টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের মাত্র ৪টিতেই ৮০-এর নিচে স্ট্রাইকরেট ছিল তামিমের। 

বর্তমান অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে ‘ধীরে এগোনো’ নীতে চলা তামিম প্রতি ইনিংসে মারছেন ৩.৭৬টি চার। ছক্কার ক্ষেত্রে তো আরও বেশি কিপটে হয়ে গেছেন তামিম। প্রতি ১০ ইনিংসে ৩টি ছক্কার দেখা মিলছে ইদানীং (৩১ ইনিংসে ৯ ছক্কা)। যেটা ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে বেশ কম। যে ১১ বার পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, তাতে মাত্র একবার এক শর বেশি স্ট্রাইকরেট। এর মাঝে পাঁচ ইনিংসেই স্ট্রাইকরেট ৮০-এর নিচে।

২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়টা যে তামিমের জন্য কতটা খারাপ ছিল সেটাও পরিসংখ্যান আবার বলে দিচ্ছে। এ সময় খালি হাতে ফেরা ইনিংসগুলো বাদ দিলে ইনিংস প্রতি ৩.৫১টি চার ও চার ম্যাচে একটি ছক্কার দেখা মিলত। যে ১১ বার পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, তাতে পাঁচ ইনিংসেই স্ট্রাইকরেট ৮০-এর নিচে। তিনবার ছিল এক শর বেশি স্ট্রাইকরেট।

তার মানে, তামিম যে বদলেছেন, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু মোটাদাগে যতটা দেখাচ্ছে, ততটাও কিন্তু নয়।