আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথে বেঁচে থাকবেন অমলেশ

আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের ইতিহাসে প্রথম গোল। মোহামেডান গোলরক্ষক আবুল কাশেমকে ফাঁকি দিয়ে গোল করলেন অমলেশ সেন। ছবি সংগ্রহ: নাজমুল আমিন কিরণ
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের ইতিহাসে প্রথম গোল। মোহামেডান গোলরক্ষক আবুল কাশেমকে ফাঁকি দিয়ে গোল করলেন অমলেশ সেন। ছবি সংগ্রহ: নাজমুল আমিন কিরণ
>আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের ইতিহাসে প্রথম গোলটি এসেছিল প্রয়াত অমলেশ সেনের পা থেকে। আজ আরও একটি আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের দিন ২০১৭ সালে পরলোকে পারি জমানো এই ফুটবলারকে মনে পড়বে খুব করেই

প্রয়াত শেখ কামালের হাত ধরে অনেক স্বপ্নের নিয়ে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা হলো আবাহনী ক্রীড়াচক্র। ওই বছর ঢাকার ফুটবল মানচিত্রে দলটির আবির্ভাব। কিন্তু ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম ফুটবল লিগটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় মাঝপথেই। ১৯৭৩ সাল থেকেই মূলত আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের উত্তাপ শুরু। এবং সে বছরই সাদাকালো আর আকাশি নীলের লড়াই দেখল প্রথম গোল। সেটির মালিক প্রয়াত অমলেশ সেন। যাঁর বিপক্ষে গোলটা হয়েছে তাঁর নাম আবুল কাশেম। ইপিআইডিসি, আবাহনী হয়ে আবুল কাশেম তখন মোহামেডানে খেলেন। অমলেশের গায়ে আবাহনীর জার্সি। নারায়ণগঞ্জের আবুল কাশেম ১৯৭২ সালে আবাহনী ছেড়ে পরের বছর চলে যান মোহামেডানে। পুরোনো সতীর্থের বিপক্ষে গোলটি করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান অমলেশ সেন।

৪৭ বছর পর সেই গোলের স্মৃতিচারণা করার কারণ, আজ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আরেকটি আবাহনী-মোহামেডান লড়াই। এটিও লিগ ম্যাচ। অমলেশে সেন অনন্ত লোক থেকে এই ম্যাচটি কী দেখবেন? দেখে থাকলে নিশ্চিত করেই তাঁর সেই গোলটির কথা মনে পড়বে। মনে পড়বে জাকারিয়া পিন্টুর ব্যাক পাস থেকে তিনি যেভাবে গোলটি করে ফেলেন, সেই দৃশ্যটিও। জাকারিয়া পিন্টু তখন মোহামেডানের ডাকসাইটে ডিফেন্ডার। তিনি গোলরক্ষক আবুল কাশেমকে ব্যাক পাস দিতে গিয়েই গোল খাওয়ান মোহামেডানকে।

সেই গোল নিয়ে অমলেশ সেন তাঁর জীবদ্দশায় এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘ ঢাকা স্টেডিয়ামে ম্যাচ চলছিল। পিন্টু ভাই লেফট ব্যাক থেকে গোলকিপার কাশেমকে ব্যাক পাস দেন। আমি ছিলাম ডান পাশে। সেখান থেকেই বলটা তাড়া করি। বলটা কাশেম পিন্টু ভাইকে দেন এবং পিন্টু ভাই আবার ঠেলেন কাশেমকে। বল কাশেমের কাছে যাওয়ার আগেই আমি পেয়ে যাই। আর দেরি নয়। বলটা কাশেমের বাঁ দিক দিয়ে জালে পাঠাই।’

এতেই তৈরি হলো ইতিহাস। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের প্রথম গোলদাতা হয়ে গেলেন অমলেশ সেন। ম্যাচটা আবাহনী জিতেছিল ২-০ গোলে। আবাহনীর দ্বিতীয় গোলটি করেন কাজী সালাউদ্দিন। এসবই এখন স্মৃতির বইয়ের ভুলে যাওয়া গল্প। যেমন ২০১৭ সালে ৭ অক্টোবর অনন্ত লোকে পাড়ি জমিয়ে দেয়ালের গায়ে ছবি হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ফুটবলে উজ্জ্বল মুখ অমলেশ সেন। আবাহনী ক্লাবই কাটান আমৃত্যু, দলটিকে কোচিং করাতে করাতে মৃত্যুর কোলের ঢলে পড়েন। মৃত্যুর দিন কয়েক আগে অমলেশ সেন স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বলেছিলেন, ‘আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ তখন চির দ্বৈরথ হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা বুঝতে পারছিলাম এই লড়াই আর দশটা লড়াই থেকে আলাদা। প্রথম গোলটা করার পর আমাকে সতীর্থরা যেভাবে অভিনন্দন জানাল তা কখনো ভুলব না।’

আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক আবদুস সাদেকের সঙ্গে অমলেশ সেন (ডান দিকে)
আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক আবদুস সাদেকের সঙ্গে অমলেশ সেন (ডান দিকে)

অথচ সময়ের চোরাবালিতে ঘরোয়া ফুটবলের উত্তাপ হারিয়ে গেছে। আজ আর আবাহনী-মোহামেডান লড়াও আন্দোলিত করে না ফুটবলপ্রেমীদের। কিন্তু এই ম্যাচ কত স্মরণীয় ক্ষণ উপহার দিয়েছে হিসেব নেই। তবে সব ছাপিয়ে অমলেশ সেন হয়ে ওঠেন এক মহিরুহ। আবাহনীতে তাঁর নাম লেখানোর গল্পটাও চমকপ্রদ। স্বাধীন বাংলা দলে খেলার পর ১৯৭২ সালে কলকাতায় ছিলেন অমলেশ। শেখ কামাল যখন আবাহনী দলটা গঠন করলেন, তখন কলকাতায় যোগাযোগ করা হলো অমলেশের সঙ্গে। তবে সে বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে মোহামেডানে খেলার কথা ছিল তাঁর। ১৯৭০ সালে মোহামেডানেই কাটান বগুড়া থেকে উঠে আসা এই ফুটবলার।

১৯৭২ সালে আবাহনী প্রতিষ্ঠার পর ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ কলকাতায় গেলেন ক্লাবের জন্য জার্সি আনতে। তখনই অমলেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে নতুন দল আবাহনীতে নিশ্চিত করলেন। সেই সময়ের বর্ণনায় অমলেশ সেন বলেছিলেন,‘স্বাধীন বাংলা দলের জন্য যে দোকান থেকে জার্সি কেনা হয়েছিল, সেই দোকান থেকেই আবাহনীর জার্সি নেওয়া। দোকানির নাম সম্ভবত সুনীল, পুলিশ সার্জেন্ট ছিলেন। পুলিশ দলে খেলতেন। তাঁর এক ভাই ইস্টবেঙ্গলে খেলেন।’

তারপর নদীর পানি অনেক গড়িয়েছে। দিনে দিনে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হয়ে ওঠে কিংবদন্তি গল্প। সেই হারিয়ে যাওয়া গল্পের ভিড়ে গত বছর হলো আরেক ঘটনা। এই দুই দলের লিগ লড়াইয়ে সর্বশেষ ম্যাচে মোহামেডান ৪-০ গোলে উড়িয়ে দেয় আবাহনীকে। সেটি ছিল আবাহনীর জন্য চরম হতাশার এক ম্যাচ। কারণ, মোহামেডান লড়ছিল অবনমন এড়াতে। আবাহনী শিরোপা লড়াইয়ে। এভাবে অনেক বারই একতরফা ম্যাচ হয়েছে দুই দলের। কখনো কখনো আবাহনীর কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে মোহামেডান। কখনো মোহামেডানের কাছে দাঁড়াতেই পারেনি আবাহনী। যেমন ১৯৭৪ সালে একবার মোহামেডানের কাছে ৪-০ গোলে উড়ে যায় ইকবাল স্পোর্টিং থেকে আবাহনী ক্রীড়াচক্রে রূপ নেওয়া সেই দলটি।

সেই ম্যাচের আগে মোহামেডান সমর্থকেরা অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর কাছে দাবি তোলেন, সালাউদ্দিনকে ছাড়া যাবে না। তিনি গোল করলে আপনার ঠ্যাং ভেঙে দেব। সালাউদ্দিন তখন বল পায়ে গতিময় এক ফুটবলার। কিন্তু সেই ম্যাচে পিন্টুর কড়া পাহারার জালে আটকে যান সালাউদ্দিনের মতো স্ট্রাইকারও। পিন্টু বলছিলেন, ‘সেদিন সালাউদ্দিন আমাকে বলল, একটা গোল করব আপনাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি কী আর ছাড়ি! বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়ব না কিছুতেই ( হা হা হা)। এবং সে ম্যাচে সালাউদ্দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দলের গোল হজম দেখে।’ প্রয়াত ওয়াজেদ গাজী চতুর্থ গোলটি করতেই আবাহনী শিবির হতাশায় ডুবে যায়।

আবাহনী মনে রেখেছে মোহামেডানের কাছে ১৯৭৪ আর ২০১৯ সালে সেই ৪-০ হারের কথা। ক্ষয়িষ্ণু শক্তির হলেও মোহামেডান চাইবে আজ আবার আবাহনীকে গুঁড়িয়ে দিত। কিন্তু আজ নিশ্চিতভাবেই বদলা নিতে চাইবে আবাহনী। সেটি পারলে অমলেশ সেন না ফেরার দেশ থেকে হয়তো খুশিই হবেন।