ছেলেদের সঙ্গে খেলা শেফালি এখন 'ডাউন দ্য উইকেটে'র রানি

শেফালি ভার্মা। ছবি: টুইটার
শেফালি ভার্মা। ছবি: টুইটার

অস্ট্রেলিয়ায় নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দৃশ্যটা বেশ পরিচিত। ডাউন দ্য উইকেট এসে বোলারকে তুলে মারছেন শেফালি ভার্মা। দেখে মনে হবে এ শট খেলা কত সহজ!

আসলে কি তা–ই? বিশেষ করে প্রকৃতিগতভাবেই ছেলে ক্রিকেটারদের তুলনায় মেয়েদের ‘রিফ্লেক্স’ একটু কম হওয়ার কথা। সে হিসেবে ডাউন দ্য উইকেট এসে ঠিকঠাকমতো টাইমিং করা বেশ কঠিন। কিন্তু শেফালির খেলা দেখলে তা মনে হয় না। এর রহস্য কী?

কাল মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে ভারত। ৪ ম্যাচে ১৬১ স্ট্রাইকরেটে ১৬১ রান করা শেফালি ভারতকে ফাইনালে তোলার অন্যতম নেপথ্য কারিগর। এ টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৯ ছক্কাও হাঁকিয়েছেন ১৬ বছর বয়সী এ ওপেনার। তবে ডাউন দ্য উইকেট এসে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে মারা শেফালির ছক্কাগুলোই আলোচিত হয়েছে বেশি। এ শট তিনি ঝালাই করেছেন ভারতে রাম নারায়ণ ক্রিকেট একাডেমিতে কোচ অশ্বিনী কুমারের অধীনে।

সংবাদমাধ্যমকে অশ্বিনী কুমারই জানিয়েছেন ডাউন দ্য উইকেটে শেফালির সাফল্যের রহস্য, ‘ওটাসহ আমরা ওকে সব শট খেলতে শিখিয়েছি। ওই (ডাউন দ্য উইকেট) শটটা ও দিনে অন্তত ৫০ বার অনুশীলন করেছে। এভাবে ওর “মাসল মেমোরি” বেড়েছে। ও একজন জাত মারকুটে ব্যাটসম্যান। আমরা ওর ব্যাটিংয়ের ধরনের কোনো কিছু পাল্টাইনি, শুধু ঘষামাজা করেছি।’ মাসল মেমোরি হলো, নির্দিষ্ট একটি শরীরী নড়াচড়ার বারবার পুনরাবৃত্তির পর যখন সেটি অবচেতনভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। প্রচুর অনুশীলনে এটি অর্জন করা যায়। অর্থাৎ শেফালি ডাউন দ্য উইকেট শট প্রচুর অনুশীলন করেছেন বলেই ম্যাচে অবচেতনভাবেই একদম ঠিক জায়গায় গিয়ে খেলতে পারছেন।

মেয়েদের টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে শেফালি এখন শীর্ষ ব্যাটার। হরিয়ানার রোহতাকে জন্মানো শেফালির উঠে আসার গল্পটা চমকপ্রদ। নিজের এলাকায় মেয়েদের কোনো ক্রিকেট শেখানোর একাডেমি না থাকায় শেফালিকে চরম পথই বেছে নিতে হয়েছিল। খেলা শিখেছেন ছেলেদের একাডেমিতে, ছেলেদের ছদ্মবেশ নিয়ে!

শেফালির ক্রিকেটার হয়ে ওঠা মূলত তাঁর বাবা সঞ্জীব ভার্মার জন্য। অনেক অনুরোধ করেও মেয়েকে ছেলেদের একাডেমিতে ভর্তি করতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত বাবা হয়ে মেয়েকে নির্দেশ দেন, চুল কেটে ছেলেদের মতো হয়ে যাও। হরিয়ানার রোহতাক জেলার সবগুলো ক্রিকেট একাডেমিই সঞ্জীব ভার্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। ছোট্ট একটি অলংকার দোকানের মালিক এই ক্রিকেটপাগল বাবা এর আগে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন সেসব দাহকালের কথা, ‘কোনো একাডেমিই ভর্তি করতে চায়নি ওকে। কারণ রোহতাকে মেয়েদের জন্য কোনো একাডেমি ছিল না। ওকে (শেফালি) একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য সবার কাছে আমি বলতে গেলে হাত পেতেছি। কিন্তু কেউ কানে তোলেনি। সব জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ওর চুল কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর ছেলে হিসেবে দেখিয়ে ওকে একাডেমিতে ভর্তি করাই।’

সেই শেফালিই এখন বিশ্লেষকদের চোখে ভারতীয় নারী ক্রিকেটের ‘ভবিষ্যৎ’। শুরু থেকেই বল পেটাতে ভালোবাসেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বললেন শেফালির স্থানীয় কোচ অশ্বিনী কুমার, ‘১২ বছর বয়সে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই শেফালি এত জোরে বল মারতে শুরু করল যে, আমরা দলের অন্য মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ি। এ কারণে ওকে বড়দের দলে টানা হয় এবং তারপর থেকে ও ছেলেদের সঙ্গে খেলা শুরু করে।’

অশ্বিনী কুমারের একাডেমি থেকে বেশ কিছু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার তৈরি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন নেটে বল করেছেন শেফালিকে। হরিয়ানার পেসার আশিস হুদা তাঁদেরই একজন। শেফালির মুখোমুখি হওয়া নিয়ে তাঁর স্মৃতি, ‘রঞ্জি ট্রফির খেলোয়াড় হয়ে একাডেমির নেটে কোনো খুদেকে অবশ্যই কেউ জোরে বল করতে চাইবে না। তাই অল্প রান আপে তাকে বল করে চমকে যাই। এত জোরে বল মারতে পারে! এরপর পুরো রান আপ নিয়ে বল করি। কিন্তু সে এতটুকু ঘাবড়ে না গিয়ে একই রকম ভয়ডরহীন শট খেলেছে। বুঝে যাই এ মেয়ে একদিন ভারতের হয়ে খেলবে। কিন্তু এত দ্রুত খেলবে, তা ভাবিনি।’

বিশ্লেষকদের মতে, শেফালির বয়স মাত্র ১৬ বছর হলেও তাঁর কাঁধ ও হাত যথেষ্ট পরিণত। এর সঙ্গে হাত ও চোখের দুর্দান্ত সমন্বয়ে ভালো টাইমিং পেয়ে থাকেন। কাল ফাইনালে শিষ্যার কাছে অশ্বিনী কুমারের প্রত্যাশা, ‘শুধু ওর ভালো চাই। কোচ ও অধিনায়ক যা বলবে ও যেন তা মাঠে মেনে চলে।’