আতহারদের আগেই ইডেনে খেলেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা

১৯৮৩ সালে ইডেনে গার্ডেনসে কোচ আলতাফ হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশের দুই নারী ক্রিকেটার। ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৩ সালে ইডেনে গার্ডেনসে কোচ আলতাফ হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশের দুই নারী ক্রিকেটার। ছবি: সংগৃহীত
>

১৯৯০ সালে বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো খেলেছিল কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেনে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সে ম্যাচ স্মরণীয় আতহার আলী খানের এক দুর্দান্ত ইনিংসে। কিন্তু অনেকেই জানেন না ছেলেদের অনেক আগেই ইডেনের ঐতিহাসিক মাঠে খেলেছিল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল

বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ইডেন গার্ডেনসে প্রথম ম্যাচ খেলেছে কবে?

নব্বই দশকের ক্রিকেটপ্রেমীরা জবাব দেবেন এক লহমায়। ওই আতহার আলীর ঝকঝকে ৭৮, অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীনের ৩৩, গোলাম নওশেরের উইকেট নেওয়া, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা! সালটা ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে, একদম ঠিক করে বললে নব্বইয়ের একদম শেষ দিন—৩১ ডিসেম্বর। টুর্নামেন্ট ছিল এশিয়া কাপ। ৭১ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ইডেন গার্ডেনসে ওটাই বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ।

হ্যাঁ, তথ্যে ভুল নেই। ইডেনে বাংলাদেশ দলের ওটাই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। কিন্তু প্রশ্নটা ছিল—বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা প্রথম খেলেছেন কবে? সেটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের বাইরেও। খেলাটির পাঁড় ভক্ত না হলে উত্তর পেতে বেগ পাওয়াই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক ম্যাচের বাইরে প্রীতি ম্যাচের নথিপত্র তো খুব একটা সংরক্ষণ করা হয় না। সত্তর-আশির দশকের প্রীতি ম্যাচ হলে তো কথাই নেই। তখন স্মৃতিই ভরসা।

এ যেন মেয়েদের ক্রিকেটের মতো। বড় কোনো সাফল্য না পেলে কেউ সালমা-জাহানারাদের তেমন একটা খোঁজ রাখে না। অথচ এই মেয়েরাই ইডেনে খেলেছিল প্রথম ম্যাচ। এই মেয়েরাই ভারতের ওই ‘নন্দনকানন’খ্যাত ইডেনে খেলেছে এশিয়া কাপের ওই ম্যাচের ৭ বছর আগে। ১৯৮৩ সালে পশ্চিম বঙ্গের স্থানীয় একটি দলের বিপক্ষে ইডেনে প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা।

সেটি কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ ছিল না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলেও আবাহনীর ব্যানারে মেয়েদের সে দলটাকে ইডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন দেশের ক্রিকেটের কারিগর খ্যাত প্রয়াত কোচ সৈয়দ আলতাফ হোসেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান টেস্ট দলে ডাক পাওয়া প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। সে যা–ই হোক, ৩৭ বছর পর ইডেনে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের স্মৃতি উসকে দিলেন পারভীন নাসিমা নাহার।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি ‘পুতুল আপা’ নামে খ্যাত। ইডেনে প্রথম ম্যাচ খেলা মেয়েদের ওই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেট দল ও হকি দলে খেলা সাবেক এ ক্রীড়াবিদ পরে মেয়েদের জাতীয় দলের সহকারী কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন। মুঠোফোনে তাঁকে ধরতেই ওপাশ থেকে ওয়েলকাম টিউনে ভেসে এল মান্না দের নস্টালজিক গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...।’ আবহটা তো ঐতিহাসিক সেই ম্যাচটির মতোই। প্রায় তিন দশক আগের সেই ম্যাচও তাঁকে নস্টালজিয়ায় ভোগাল।

আশির দশকে মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে ক্রিকেট খেলত মেয়েরা। তখনকার একটি ছবি। ছবি: সংগৃহীত
আশির দশকে মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে ক্রিকেট খেলত মেয়েরা। তখনকার একটি ছবি। ছবি: সংগৃহীত

ম্যাচের প্রসঙ্গ তুলতেই পুতুল বললেন, ‘ম্যাচটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় একটি দলের বিপক্ষে। আমরা হেরেছিলাম। আমি ছিলাম উইকেটরক্ষক। অধিনায়ক ছিল আইভি। দলে ছিল মনোয়ারা মিনু, আফসানা, লাভলী...। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আবাহনীর কর্মকর্তারা (সড়কপথে) নিয়ে গিয়েছিলেন। সে অনেক আগের কথা। তবে ভেবে গর্ব লাগে ইডেনে আমরা ছেলেদের আগে খেলেছি।’

প্রথম আলোতেই প্রায় ৯ বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে পুতুল ওই ম্যাচ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তখন সবে ক্রিকেট শুরু করেছেন। খেলোয়াড়দের সবাই উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষ কিংবা তার কাছাকাছি পড়ত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তখন অনেক কাভারেজ দেওয়া হয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন পুতুল। সে প্রসঙ্গ আজ নতুন করে তুলতেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়লেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত এ মুখ, ‘ওরা খুব সমাদর করেছিল। ওখানকার রেডিওতে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। কথা বলেছিল সংবাদপত্রও।’

ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। সেখানকার মেয়েরা প্রথম টেস্ট খেলেছে তার ৩ বছর পর। আর বাংলাদেশে মেয়েদের জাতীয় দল প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলেছে ২০১১ সালে। আশির দশকে মেয়েরা ক্রিকেট খেললেও তার ব্যাপ্তি খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের মেয়েদের ক্রিকেট অবকাঠামো থেকে বিস্তর পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আইভি-পুতুলদের সেই দলকে খোলামনেই বরণ করে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ স্থানীয় দলটির ক্রিকেটাররা।

পুতুলের ভাষায়, ‘ওরা খুব ভালো আতিথেয়তা দিয়েছিল। দলটাও আমাদের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। ওরা বলেছিল, “দিদি আমরা কিন্তু অনেক ভালো দল। তোমরা নতুন এসেছ। খেলা উপভোগ করো, আমাদের দেখে শেখো।” ম্যাচ শেষে আমাদের ট্রফিও দেওয়া হয়েছিল।’

তখনকার প্রেক্ষাপটে ভারতে গিয়ে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা ছিল বেশ বড় ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই সে ম্যাচের দু-একটি স্মৃতি পুতুলের মনে গেঁথে থাকার কথা। এ প্রসঙ্গে মজার এক স্মৃতিই ভাগ করে নিলেন তিনি, ‘দোয়া ইউনুস আমি মনে রাখতে পারতাম না। ফিল্ডিং করার সময় মনে মনে এ দোয়া পড়ার চেষ্টা করতাম। সেদিন একটি চার বাঁচাতে গিয়ে এ দোয়াটি আনমনেই পুরোটুকু পড়ে ফেলেছি। চারটা বাঁচিয়ে সে যে কী আনন্দ!’ কোচ আলতাফ হোসেনের একটি কথাও স্মরণ করলেন পুতুল, ‘স্যার আমাকে বলেছিলেন, পুতুল তুমি তো উইকেটরক্ষক। ওখান থেকে গোটা মাঠ কাভার করতে পারো। এটা কিন্তু শুধু উইকেটরক্ষকেরাই পারে। সব সময় খেলার মধ্যে থাকবে।’

আশির দশকের শুরুতে সে সময় মেয়েদের ক্রিকেটে কোনো পারিশ্রমিক ছিল না। পুতুল-লাভলিরা ভেতরকার তাড়না থেকেই ক্রিকেট খেলতেন। সামাজিক বিধিনিষেধও ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি স্মৃতিও ভাগ করলেন পুতুল, আশির দশকে নারায়ণগঞ্জ পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক এলাকা। সেখানে পেশাদার ক্রিকেটারদের সঙ্গে মেয়েদের একটি ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। মেয়েরা ছেলেদের বিপক্ষে খেললে অনেক সমালোচনা হবে, বলা হয়েছিল। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে খেলতে গেলে আমাদের ফুলের তোড়া ও বড় সাদা তোয়ালে উপহার দেওয়া হয়েছিল।

বাঁ থেকে—শাহীন, দুর্দানা, লাভলি, আফসানা, মনোয়ারা, সাবা ও পুতুল—ইডেনে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে খেলেছিলেন তাঁরা সবাই। ছবি: সংগৃহীত
বাঁ থেকে—শাহীন, দুর্দানা, লাভলি, আফসানা, মনোয়ারা, সাবা ও পুতুল—ইডেনে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে খেলেছিলেন তাঁরা সবাই। ছবি: সংগৃহীত

মেয়েদের ক্রিকেটে শুরুর সময়টা নিয়েও প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণা করেছিলেন পুতুল, ‘১৯৭৮ সালে আমাদের মহিলা হকি দলের পাকিস্তান যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি। তখন আলতাফ ভাই ছেলেদের ক্রিকেট অনুশীলন করান। আমরা মেয়েরা একদিন তার কাছে গিয়ে বললাম আমরাও ক্রিকেট খেলব। স্যার আনন্দেই আমাদের নিলেন। আমরা ছেলেদের সঙ্গেই অনুশীলন করতাম। সেই শুরু।’

সেই সময়ে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা কতটা কঠিন ছিল তা নিয়েও বলেছিলেন পুতুল, ‘আমরা সাদা সুতি কাপড়ের শার্ট পরতাম, সাদা ট্রাউজার। আলতাফ স্যার দড়িতে বল ঝুলিয়ে দেড়-দুই শ বার মারতে বলতেন। সাদা রুমাল বিছিয়ে রুমালে বল ফেলার পরীক্ষা নিতেন। সেন্টার উইকেটে অনুশীলনের সময় বোলারকে বলতেন, ব্যাটসম্যানের মাথায় মার। আরও কত–কী!’

সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে মেয়েদের ক্রিকেটও অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। মেয়েরা এখন এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন। তবে মেয়েদের ক্রিকেটের সুলুক-সন্ধান করতে গেলে ইডেনে ওই ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠে আসবেই। পুতুলের ভাষায়, ‘ম্যাচটা খেলতে পেরে খুব গর্ব লাগে। খেলে টাকাপয়সা তো তখন পাইনি। কিন্তু এই গর্বটা তো অমূল্য।’

আজ নারী দিবসে পুতুলের এই গর্ব তো দেশের তামাম মেয়ে ক্রিকেটারেরও। পুতুল-লাভলি-আইভিরা তখন দুর্গম পথে স্বপ্নের রথ ছুটিয়েছিলেন বলেই আজ ভিত পেয়েছে মেয়েদের ক্রিকেট, যার শিকড়ে জড়িয়ে আছে পুতুলদের নাম আর নন্দনকাননের ধাম!