ক্লাব আছে মাঠ নেই, অনুশীলন বিসিবির দয়ায়

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে একাডেমি মাঠে আবাহনীর অনুশীলন। ছবি: বিসিবি
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে একাডেমি মাঠে আবাহনীর অনুশীলন। ছবি: বিসিবি
>নাম আর ঐতিহ্যের ভারে ভারী ক্লাবগুলোরও নিজস্ব অনুশীলন ব্যবস্থা নেই। অনুশীলনের জন্য এবারও তারা দ্বারস্থ বিসিবির

বছরের দুটি সময় যেন রংধনুর দেখা মেলে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠে। লাল, নীল, সবুজ, আকাশি, নীল আরও কত রং! নানা রঙের জার্সি গায়ে ক্রিকেটাররা আসেন অনুশীলনে। অনেক সময় চেনারও উপায় থাকে না, কে কোন দলের ক্রিকেটার। একাডেমি মাঠ এমন রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে বিপিএল আর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সময়।
বিপিএলের সময় এ মাঠে অনুশীলন করে ৭টি দল। প্রিমিয়ার লিগের সময়ও ঘুরেফিরে আসে ৮-১০টি দল। ১৫ মার্চ শুরু হতে যাওয়া প্রিমিয়ার লিগ সামনে রেখে এবারও ক্রিকেটারদের ভিড় জমতে শুরু করেছে একাডেমি মাঠে। কয়েক দিন ধরেই পালা করে আসছে দলগুলো। তড়িঘড়ি করে দুই-তিন ঘণ্টা অনুশীলন করে আরেক দলের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কখনো এক দলের অনুশীলন শেষ হওয়ায় আগেই আরেক দল এসে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের পালা আসার অপেক্ষায়। এভাবে কোনোরকম অনুশীলন করেই দেশের একমাত্র লিস্ট ‘এ’ টুর্নামেন্টের জন্য প্রস্তুতি নেন ক্রিকেটাররা।

অথচ এ অনুশীলনটা তাঁদের করার কথা যাঁর যাঁর ক্লাবের মাঠে। কিন্তু ক্লাবের মাঠ থাকলে তো! মাঠ দূরের কথা, ন্যূনতম অনুশীলন-সুবিধাও নেই অনেক ক্লাবের। অনুশীলনের জন্য বিসিবির দয়াদাক্ষিণ্যই তাদের ভরসা। এই দয়াদাক্ষিণ্য চেয়ে নিতে এমনকি বড় ক্লাবগুলোরও বাধে না। ক্লাবগুলো দাবি করতে পারে, মাঠ ব্যবহারের জন্য তারা বিসিবিকে ভাড়া দেয়। কিন্তু নামমাত্র সেই টাকাও তো বিসিবির কাছ থেকে পাওয়া অনুদান থেকেই দেওয়া হয়ে যায়! ক্যাসিনো-কাণ্ডের প্রভাবেই কিনা এবার নাকি বিসিবির সেই ‘দরিদ্র তহবিল’ ক্লাবপ্রতি ১০ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া শুরুতে লিগের প্রথম তিন পর্ব কক্সবাজারে হওয়ার কথা ছিল বলে সব ক্লাবকে বাড়তি খরচের জন্য অনুদানের বাইরে অতিরিক্ত ১২ লাখ টাকা করে দিয়েছে বিসিবি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এই তিন পর্বের ম্যাচ নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়। ক্লাবগুলোর কাছ থেকে বিসিবি ওই টাকা ফেরত পায় কি না, সেটিই এখন দেখার।

প্রিমিয়ার লিগের গতবারের চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর ধানমন্ডিতে নিজস্ব মাঠ আছে। সেখানে বিভিন্ন একাডেমির অনুশীলনও চলে। অথচ আবাহনী এসে পড়ে থাকে মিরপুরে। এর কারণ জানতে চাইলে ক্লাবের ম্যানেজার শেখ মামুন বলেন, ‘আমাদের নিজেদের মাঠে কমপ্লেক্স বানানোর কাজ চলছে। তাই আমরা একাডেমিতে অনুশীলন করছি। আর আমাদের দলে জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটার। তাদের ভালো
সুবিধা দিতেই হবে।’ সেই সুবিধা দেওয়ার দায়িত্বও যেন বিসিবিরই।

একই মাঠে প্রায় একসঙ্গেই অনুশীলন করছে পারটেক্স দল। ছবি: বিসিবি
একই মাঠে প্রায় একসঙ্গেই অনুশীলন করছে পারটেক্স দল। ছবি: বিসিবি

অনুশীলনের জন্য আদর্শ মাঠ নেই ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের। তাদের অনুশীলনের জায়গাও একাডেমি মাঠ। দলের কর্মকর্তা সাবেক ক্রিকেটার সাজ্জাদ আহমেদের সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমাদের ক্লাবে অনুশীলনের সুযোগ নেই। যে মাঠ আছে সেখানে একাডেমির অনুশীলন হয়। কোনো টার্ফ নেই। প্রিমিয়ার লিগের অনুশীলনের জন্য আদর্শ না। আমরা বাধ্য হয়েই একাডেমিতে অনুশীলন করি।’ বাংলাদেশে ক্লাব-সংস্কৃতির খুঁতটাও ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি, ‘এখানে ক্লাবগুলো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ক্লাব মানেই যে একটা বড় জায়গা থাকবে, সব অবকাঠামো থাকবে, এমন নয়। বেশির ভাগ দলের অবস্থাই এক।’

তবে চাইলেই যে ভালো অবকাঠামো দাঁড় করানো যায়, তার উদাহরণ শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। অনুশীলনের জন্য পরমুখাপেক্ষী নয় তারা। অনুশীলন করে নিজেদের মাঠে। খেলাঘর সমাজকল্যাণ সমিতিরও নিজেদের মাঠ আছে। নিজস্ব মাঠ না থাকলেও বিকেএসপিতে নিজেদের ব্যবস্থাপনায়ই অনুশীলন করে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স। এই দুই ক্লাব ছাড়া অনুশীলনের জন্য নিজস্ব ঠিকানা নেই আর কারোরই। প্রাইম দোলেশ্বর ও লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ মাঝেমধ্যে ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামেও অনুশীলন করে।

প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব প্রিমিয়ার লিগে এসেছিল দারুণ পেশাদারি মনোভাব দেখিয়ে। প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো যেখানে ভাঙাচোরা বাসে চড়েই অভ্যস্ত, সেখানে প্রাইম ব্যাংকই প্রথম শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ক্রিকেটারদের মাঠে আনা-নেওয়া শুরু করে। অথচ এত বছরে তাদেরও নিজস্ব অনুশীলন-সুবিধা গড়ে ওঠেনি।

একই মাঠে টানা অনুশীলন হওয়ায় একাডেমির উইকেটগুলোর অবস্থা মৃতপ্রায়। পেসারদের জন্য তেমন কিছুই থাকছে না সেখানে। এক ক্রিকেটার কাল বলছিলেন, ‘সব উইকেট মন্থর। এই গরমে এমন মরা উইকেটে অনুশীলন করলে অনেক পেসারই ভেঙে পড়তে পারে।’ আরেক ব্যাটসম্যানের আক্ষেপ, ‘ভারতে ফ্ল্যাট উইকেট মানে উইকেট ফ্ল্যাটই হবে। স্পিন উইকেট মানে আপনি জানেন যে বল স্পিন করবে। পেসবান্ধব উইকেটও তা-ই। আর আমাদের একাডেমিতে এক উইকেটেই দেখা যায় তিন-চার রকমের আচরণ করে। এভাবে তো ভালো ব্যাটসম্যান তৈরি হবে না!’

এত দলকে একসঙ্গে অনুশীলনের সুবিধা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিসিবিও। জাতীয় দল, ‘এ’ দল, হাইপারফরম্যান্স ইউনিট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট ও নারী দলের ক্রিকেটে এমনিতেই সারা বছর ব্যস্ত থাকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম ও একাডেমি মাঠ। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ক্লাবের অনুশীলনের চাপ। বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটির ব্যবস্থাপক আবদুল বাতেন কাল আত্মসমর্পণের সুরে বলছিলেন, ‘অনুশীলনের সুযোগ না দিয়ে কী উপায় আছে! অনেক ক্লাবেরই তো মাঠ নেই।’

প্রিমিয়ার লিগের সব ক্লাবের সঙ্গেই সম্পৃক্ত এক বা একাধিক বোর্ডের পরিচালক। তাদের জন্য একাডেমি মাঠের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া ছাড়া আসলেই উপায় নেই।