দাবায় মাহমুদার আকাশছোঁয়ার গল্প

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী সংগঠক হয়েছেন মাহমুদা হক চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী সংগঠক হয়েছেন মাহমুদা হক চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
>একজন দাবাড়ুর সর্বোচ্চ খেতাব গ্র্যান্ডমাস্টার। আর দাবা সংগঠকদের জন্য সর্বোচ্চ স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সংগঠক বা আইও। মাহমুদা এই মাইলফলক ছুঁয়েছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং একমাত্র নারী দাবা সংগঠক

দাবা বোর্ডের সঙ্গে পরিচয় ছোটবেলায়। সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে পরে। বাংলাদেশে পুরুষ ও নারী মিলিয়ে প্রথম এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক দাবা সংগঠক হিসেবে নিজেকে তুলে আনেন অনেক ওপরে। দক্ষিণ এশিয়ারই প্রথম এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক নারী দাবা সংগঠক হয়েছেন বাংলাদেশের মাহমুদা হক চৌধুরী (মলি)।

একজন দাবাড়ুর সর্বোচ্চ খেতাব গ্র্যান্ডমাস্টার। আর দাবা সংগঠকদের জন্য সর্বোচ্চ স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সংগঠক বা আইও। মাহমুদা এই মাইলফলক ছুঁয়েছেন গত বছর সেপ্টেম্বরে। ২০১৬ সালে আজারবাইজানের বাকুতে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে মাহমুদা এবং তাঁর স্বামী বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবউদ্দিন শামীম আইও হতে পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় অংশ নেন ১১৪টি দেশের সংগঠক। বিশ্ব দাবা সংস্থা ফিদের নিয়ম অনুসরণ করে এরপর ৩টি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টুর্নামেন্ট পরিচালক হিসেবে সফলভাবে কাজ করেছেন মাহমুদা। সংগঠকের জন্য কাঙ্ক্ষিত আইও স্বীকৃতিটা আসে এরপরই।

মাহমুদার স্বামীও আইও স্বীকৃতি পেতে পারেন এ মাসেই। সেটি চলে এলে দাবার ৬৪ ঘরের নানা মারপ্যাঁচ ছাপিয়ে এই জুটি একটা রেকর্ডই গড়ে ফেলবেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই আইও! মাহমুদা বলেন, ‘পুরো বিশ্বেই পুরুষ ও নারী দাবা আন্তর্জাতিক সংগঠক হাতে গোনা। তাই এই স্বীকৃতিটা বাংলাদেশের দাবার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।’

মাহমুদার পরিচয় অবশ্য অনেক। দাবায় দাবায় সারা বেলা কাটিয়ে এ মাসেই তিনি ফিদের আরবিটরও (বিচারক) হয়েছেন। জাতীয় স্তরে দাবা খেলেছেন তাঁরা তিন বোনই। তিনজনেরই ফিদে প্রোফাইল আছে। সবার ছোট মাহমুদা ও বড় বোন আফরোজা হক চৌধুরী ফিদে-স্বীকৃত জাতীয় ইনস্ট্রাক্টর। মেজ বোন ফিরোজা হক চৌধুরী বাংলাদেশের হয়ে ২০০০ সালে মুম্বাইয়ে বিশ্ব দাবা জুনিয়রে খেলেন। ইংল্যান্ডপ্রবাসী ফিরোজা এখন ব্রিটেনে জাতীয় স্তরে দাবা খেলেন। দাবা খেলতেন তাঁদের মা নুরজাহান হক চৌধুরীও। মায়ের উৎসাহেই মেয়েরা দাবার ঘুঁটিতে চিনেছেন জীবনের অলিগলি। আজকের সফল দাবা-মুখ মাহমুদা বলেন, ‘পত্রিকায় দেখে চট্টগ্রামে নারী দাবায় আমার দুই বোনকে নিয়ে যান আম্মা। ছোট ছিলাম বলে তখন আমাকে নেননি (হাসি)। পরে আমিও দাবা খেলায় আসি আম্মার উৎসাহে।’

মাহমুদার বাবা মসরুল হক চৌধুরী ছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অন্য বাবাদের মতো তিনিও খেলার চেয়ে পড়াশোনায়ই বেশি জোর দিতেন। মাহমুদা তাই লুকিয়ে লুকিয়েই খেলেন ১৯৯৯ সালের জাতীয় মহিলা সাব-জুনিয়রে (অনূর্ধ্ব-১৬)। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন চট্টগ্রাম আলহাজ ইয়াকুব আলী স্কুলের ছাত্রী মাহমুদা। কথা প্রসঙ্গে স্মৃতিটা তুলে আনেন এভাবে, ‘আব্বার পোস্টিং চাঁদপুরে। আমরা থাকতাম চট্টগ্রামে। আম্মা আমাকে লুকিয়ে ঢাকায় পাঠালেন সাব-জুনিয়রে খেলতে। একদিন আব্বা বাসায় ফোন করে মেজ বোনকে জিজ্ঞেস করেন মলি (মাহমুদা) কই? মেজ বোন বলে ও প্রাইভেট পড়তে গেছে। পরে পত্রিকায় আমার ছবি দেখে আব্বা ব্যাপারটা জেনে অবাক হন। খুশিও হন এবং সহকর্মীদের দেখান। এরপর থেকে দাবায় তাঁর আগ্রহ বাড়ে।’

মহিলা ক্যান্ডিডেট মাস্টার মাহমুদার পৈতৃক বাড়ি সিলেটে। বাবার চাকরির সুবাদে থাকতেন চট্টগ্রামে। জাতীয় প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের পক্ষে খেলেছেনও। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা নারী চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঢাকায় খেলা শুরু। সেই থেকে জাতীয় দাবায় খেলেন ২০০৫ পর্যন্ত। পঞ্চম হওয়াই তাঁর সেরা সাফল্য হলেও রানী হামিদসহ দেশের শীর্ষ প্রায় সব নারী দাবাড়ুকেই হারিয়েছেন। ২০১২ সালে ইস্তাম্বুলে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশের হয়ে। বাংলাদেশ দলের নন-প্লেইং অধিনায়ক ছিলেন ২০১৬ বাকু ও ২০১৮ জর্জিয়ায় বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে।

তাঁর অধিনায়কত্বে প্রিমিয়ার লিগে দুবার চ্যাম্পিয়ন সাইফ স্পোর্টিং। সংগঠক, দলনেতা হিসেবে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। আর নিজেও অনেক আগেই নেমেছেন দাবাড়ু তৈরির কাজে। জাতীয় সাব জুনিয়র দাবায় রানারআপ হয়েছে তাঁর ছেলে। ধানমন্ডি ও উত্তরায় খুলেছেন দাবা শেখার ‘স্কুল’ এলিগেন্ট ইন্টারন্যাশনাল চেস একাডেমি।

বাংলাদেশে মেয়েদের খেলাধুলার অনেক সমস্যার মধ্যেও মাহমুদা যেন আশার মশাল।