চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা 'অযোগ্য' একাদশে কে কে আছেন?

তাঁরা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য কতটুকু যোগ্য? ছবি: এএফপি
তাঁরা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য কতটুকু যোগ্য? ছবি: এএফপি
>

তাঁদের কথা অনেকেরই মনে নেই। মনে রাখার মতো কোনো ক্যারিয়ারও নয়। কিন্তু তাঁরা চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী। তাঁদের অর্জনের খাতায় জ্বলজ্বল করছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সোনার সেই মেডেল। যেটা ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে প্রার্থিত দলগত পুরস্কার।

রোনালদো লুইস নাজারিও দে লিমা।

নামটা শুনলেই ফুটবলপ্রেমীরা হারিয়ে যাবেন সুখস্বপ্নে। বল পায়ে সেই অবিশ্বাস্য কারিকুরি, মুহূর্তের মধ্যে নিজের ত্বরণ বাড়িয়ে ফেলে ডিফেন্ডারদের ছিটকে ফেলার সেই ক্ষমতা, দৃষ্টিনন্দন সব গোল করা—কজন পারেন? ব্রাজিলের হয়ে দুবার বিশ্বকাপ জেতা ও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে একবার লিগ জেতা এই তারকার জীবনের একমাত্র আক্ষেপ, বিশ্বের সেরা কিছু ক্লাব দলের হয়ে খেলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হয়নি তাঁর। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান, ইন্টার মিলান, পিএসভি—কোথাও দেখা পাননি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার।

একই দশা সুইডিশ তারকা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচেরও। সারা জীবন আয়াক্স থেকে শুরু করে জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান, বার্সেলোনা, পিএসজি, এসি মিলান, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবে খেলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিটায় চুমু এঁকে দেওয়ার সুযোগ পাননি একবার।

তবে রোনালদো-ইব্রাহিমোভিচদের বিপরীত ভাগ্যের মানুষও আছেন। যাদের ক্যারিয়ার তেমন আহামরি না, গোটা ক্যারিয়ারে অর্জন যৎসামান্য। তাঁদের ক্যারিয়ারের একমাত্র ‘সাফল্য—তাঁরা সঠিক সময়ে সঠিক ক্লাবে থাকতে পেরেছিলেন, যে কারণে কপালে জুটেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ীর তকমা। এমনই এগারো জনকে নিয়ে আজকের এই আয়োজন। আসুন দেখে নেওয়া যাক কে কে তাঁরা।

গোলরক্ষক: আলবার্ত জরকেরা (বার্সেলোনা, ২০০৬ ও ২০০৯)
ভদ্রলোক বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন দুবার। কোনোবারই মূল একাদশের অংশ হয়ে নয়। সেটা হলেও মানা যেত, কিন্তু এক যুগ ধরে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে মাত্র ১৩০ টি লিগ ম্যাচ খেলা একজন ফুটবলার কীভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার যোগ্যতা রাখেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বার্সার হয়ে সাত বছরে ম্যাচ খেলেছেন সাতটি, অর্জনের ভান্ডারে জ্বলজ্বল করছে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা!

রাইটব্যাক: হোসেমি (লিভারপুল, ২০০৫)
রাফায়েল বেনিতেজ যখন লিভারপুলের কোচ হিসেবে এলেন, তাঁর হাত ধরে প্রচুর স্প্যানিশ খেলোয়াড় পা রেখেছিলেন লিভারপুলে। তাঁদেরই একজন এই হোসেমি। খেলতেন রাইটব্যাক হিসেবে। লিভারপুলের রক্ষণভাগের ডানদিকটা তখন সামলাতেন আইরিশ রাইটব্যাক স্টিভ ফিনান। ফিনানকে সরানোর মতো তেমন খেলা দেখাতে পারেননি হোসেমি কখনই। ফলাফল, দেড় বছরেই ইংল্যান্ড ছেড়ে আবারও পাড়ি জমান স্পেনে। তবে তত দিনে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ!

সেন্টারব্যাক: বার্নার্দ কাসোনি (অলিম্পিক মার্শেই, ১৯৯৩)
ইউরোপিয়ান কাপ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগ নাম হওয়ার পর প্রথম আসরেই শিরোপা জেতে ফরাসি ক্লাব মার্শেই। কাসোনি ছিলেন সেই দলের বেঞ্চে থাকা একজন ডিফেন্ডার। ফ্রান্সের হয়ে ৩০ ম্যাচ খেলা এই ডিফেন্ডার নিজেকে কোথাও মূল খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। অধিকাংশ সময়ে বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে বেঞ্চেই জায়গা হতো তাঁর।

সেন্টারব্যাক: মার্ক মুনিয়েসা (বার্সেলোনা, ২০০৯)
বার্সেলোনার বিখ্যাত ‘লা মাসিয়া’ একাডেমির গ্র্যাজুয়েট ছিলেন মুনিয়েসা। পেপ গার্দিওলার অধীনে লা মাসিয়ার অন্যান্য গ্র্যাজুয়েট (মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, পিকে, পুয়োল, পেদ্রো, ভালদেস) মূল একাদশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও মুনিয়েসা বেঞ্চেরই খেলোয়াড় ছিলেন। চার বছরে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে নামতে পেরেছেন মাত্র চার ম্যাচে। পরে স্টোক সিটিতে গিয়ে খেলেছেন।

লেফটব্যাক: জিমি ট্রায়োরে (লিভারপুল, ২০০৫)
যেকোনো পাঁড় লিভারপুল সমর্থককে জিমি ট্রায়োরে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শতকরা নব্বই জনই নাক সিঁটকাবেন। খেলোয়াড় হিসেবে তেমন আহামরি কেউ ছিলেন না, ভুল করতেন প্রচুর। ২০০৫ সালের সেই ফাইনালে লিভারপুল এক মিনিটের মধ্যে পাওলো মালদিনির কাছে গোল খেয়েছিল ট্রায়োরের ভুলেই। যদিও ম্যাচের একদম শেষদিকে শেভচেঙ্কোর একটা নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে নিজের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগ মেডেল থাকার যথার্থতা এখনো হয়তো প্রমাণ করেন ট্রায়োরে! পরে জন আর্ন রিসার আসার পর আর জায়গা হয়নি দলে। পরে খেলেছেন চার্লটন ইউনাইটেড, পোর্টসমাউথে।

মিডফিল্ডার: জোনাথান গ্রিনিং (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ১৯৯৯)
রায়ান গিগস, পল স্কোলস, নিকি বাট ও ডেভিড বেকহামদের মিডফিল্ডে কখনই নিয়মিত জায়গা হয়নি জোনাথান গ্রিনিংয়ের। পরে ওয়েস্টব্রমের অধিনায়ক হয়ে প্রিমিয়ার লিগে অনেক ম্যাচ খেললেও ক্যারিয়ারের একমাত্র বড় অর্জন হয়ে আছে বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে ১৯৯৯ সালে পাওয়া ওই চ্যাম্পিয়নস লিগের মেডেলটাই।

মিডফিল্ডার: অ্যান্ডারসন (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ২০০৮)
একটু ভেবে দেখুন, একজন ফুটবলার বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড় হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও মানুষ তাঁকে মনে রাখছে তাঁর জঘন্য ও হাস্যকর পারফরম্যান্সের জন্য। এমনটাই হয়েছে অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ারে। পোর্তো থেকে ২০০৭ সালে যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসলেন, বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ফুটবলারের পুরস্কার ‘গোল্ডেন বয় অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ার-গ্রাফটা শুধুই নিম্নমুখী। বিখ্যাত সতীর্থদের স্কোয়াডের অংশ ছিলেন বলে ইউনাইটেডের হয়ে অনেক কিছুই জিতেছেন, একটা চ্যাম্পিয়নস লিগও। কিন্তু এত কিছু জেতা সত্ত্বেও সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এখন তাঁর পরিচয় একজন অতিসাধারণ মানের ফুটবলার হিসেবে। ২০১৯ সালে তিনি যে অবসর নিয়েছেন, কয়জন জানেন সেটা?

মিডফিল্ডার: ম্যাকডোনাল্ড মারিগা (ইন্টার মিলান, ২০১০)
প্রথম কেনিয়ান তারকা হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন তিনি। যদিও ওয়েসলি স্নাইডার, দেয়ান স্টানকোভিচ, হাভিয়ের জানেত্তি, এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোর মিডফিল্ড-রসায়ন ভেঙে কখনই ঢুকতে পারেননি মূল একাদশে। পরে রিয়াল সোসিয়েদাদ ও পারমাতে খেললেও স্বমহিমায় জ্বলে ওঠেননি কোথাও।

রাইট উইঙ্গার: আন্তোনিও নুনেজ (লিভারপুল, ২০০৫)
মাইকেল ওয়েন যে চুক্তিতে লিভারপুল ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখালেন, সে চুক্তির অংশ হিসেবে উল্টো পথে লিভারপুলে যোগ দিয়েছেন এই উইঙ্গার। জীবনে কোনো দলের মূল একাদশের অংশ হতে পারেননি। তবে লিভারপুলের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন ঠিকই!

লেফট উইঙ্গার: ইয়াসপার ব্লমকিস্ট (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ১৯৯৯)
যে পজিশনে রায়ান গিগসের মতো খেলোয়াড় খেলে, সেখানে কারও জায়গা হয় কী করে? সুইডিশ উইঙ্গার ইয়াসপার ব্লমকিস্টের অবস্থাও হয়েছিল ঠিক অমন। সঙ্গে যন্ত্রণা হিসেবে যোগ হয়েছিল চোট। ফলে গোটা ক্যারিয়ারে কিছুই করতে পারেননি তেমন। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে এতটাই উদ্বেলিত হয়েছিলেন যে, আনন্দের আতিশয্যে নিজের মেডেলটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরে আবার খুঁজে পান যদিও।

স্ট্রাইকার: পিটার ফন ভোসেন (আয়াক্স, ১৯৯৫)
রবিন ফন পার্সি, ডেনিস বার্গক্যাম্প, ক্লাস ইয়ান হান্টলারদের মতো কিংবদন্তি ডাচ স্ট্রাইকারদের তালিকায় আর যাই হোক, পিটার ফন ভোসেনকে রাখবেন না কখনো আপনি। তবে এই ডাচ স্ট্রাইকারের একটা অর্জন আছে, যা ফন পার্সিরা জীবনেও জিততে পারেননি। একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ১৯৯৫ সালে আয়াক্সে খেলার সুবাদে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের বেঞ্চে বসার সৌভাগ্যও হয়েছিল তাঁর। প্যাট্রিক ক্লাইভার্টের গোলে পাওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার স্বাদ বাকি সতীর্থদের মতো ফন ভোসেনও পান।

বেঞ্চ: টমাস কুস্যাক (গোলরক্ষক, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), রায়ান বার্ট্রান্ড (ডিফেন্ডার, চেলসি), ভিক্টর সানচেজ (মিডফিল্ডার, রিয়াল মাদ্রিদ), ফ্লাভিও কনকেইচ্যাও (মিডফিল্ডার, রিয়াল মাদ্রিদ), ফ্লোরেন্ত সিনামা পোঙ্গোল (উইঙ্গার, লিভারপুল), নিল মেলোর (স্ট্রাইকার, লিভারপুল), পেদ্রো মুনিতিস (স্ট্রাইকার, রিয়াল মাদ্রিদ)