'মার্চ' মাসটা ঘটনাবহুল বাংলাদেশের ক্রিকেটে

নানা কারণেই মার্চ মাস বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ঘটনাবহুল। কেন সেটা দেখে নিন...


মার্চ—ইংরেজি ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার মাস। এ মাসই আবার নানা কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যও স্মরণীয়।

কাকতালীয় হলেও মার্চ মাসে এমন অনেক ঘটনা আছে, যার কিছু বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আনন্দদায়ক, আবার কিছু শোক এবং দুঃখে মুহ্যমান করে দেওয়ার মতোও। আছে প্রাপ্তি, আবার খুব কাছে গিয়েও না পাওয়ার বেদনা।


দীর্ঘ ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে দেশের ক্রিকেটের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটাও অতীতে এ মাসেই লেখা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস লেখার সময় তাই ঘুরে-ফিরে বারবারই ফিরে আসবে এই মার্চ মাসের কথা।


প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ
আজ থেকে ৩৪ বছর আগে এমনই একটা মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়াতে পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপে প্রথম মাঠে নামে বাংলাদেশ। শুরুটা হার দিয়ে হয়েছিল, কিন্তু সেটি ছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বাঁকবদলের লগ্ন। ওই দিনটিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখার সূচনা।

বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরির নায়ক। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরির নায়ক। ফাইল ছবি


প্রথম সেঞ্চুরি
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। বড় স্বপ্নের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তখন বাংলাদেশ । বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়ে গেছে, অপেক্ষা টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য। ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ এমন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েই একদিনের ক্রিকেটে দেশের হয়ে প্রথম তিন অঙ্ক ছুঁলেন মেহরাব হোসেন। ঢাকায় একটি ত্রিদেশীয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মেহরাবের সেঞ্চুরিটি উপভোগ করতে সেদিন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে খুব বেশি মানুষের উপস্থিতি না থাকলেও সেটি ছিল ইতিহাসের এক শুরু।

অনেক আরাধনার জয়
১৯৯৭ সালে ওয়ানডে মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। সে বছরই আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপে খেলা। ১৯৯৮ সালের মে মাসে প্রথম ওয়ানডে জয়, এর পরপরই বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ড আর পাকিস্তানকে হারানো। স্বপ্নের মতোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু এর পরপরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। জয় হয়ে যায় দূর আকাশের তারা। ১৯৯৯ সালের ৩১ মে পাকিস্তানকে হারানোর পর টানা ৪৭ ম্যাচে হারের তেতো স্বাদ নিতে হয় বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর কোনো দলকেই এতগুলো ম্যাচ জয়হীন থাকতে হয়নি। বাংলাদেশ এই জয়খরা কাটায় ২০০৪ সালের ৪ মার্চ। হারারেতে জিম্বাবুয়েকে ৮ রানে হারিয়ে। সেই জিম্বাবুয়ে কিন্তু এখনকার জিম্বাবুয়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তখনো হিথ স্ট্রিক নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জিম্বাবুইয়ান দলকে।

এখনো আক্ষেপ জন্ম দেন রানা। ফাইল ছবি
এখনো আক্ষেপ জন্ম দেন রানা। ফাইল ছবি

রানাকে হারানোর শোক
ডেভ হোয়াটমোর যখন কোচ হয়ে আসেন, তখন তিনি একটা কথা খুব বলতেন ‘ইউটিলিটি প্লেয়ার’। মানে যিনি বোলিং-ব্যাটিং দুটিই মোটামুটি ভালো পারেন। হোয়াটমোর দক্ষিণের এক তরুণের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন ‘ইউটিলিটি’ খেলোয়াড়ের গুণাবলি। মানজারুল ইসলাম রানা বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবির্ভূত হয়েছিলেন ধূমকেতুর মতোই। খুব অল্প আয়ু নিয়ে এ পৃথিবীতে আসা মানজারুল রানা ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ খুলনা অঞ্চলে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ২৫ ওয়ানডেতে ২৩ উইকেট আর ৬ টেস্টে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন রানা। টেস্ট-ওয়ানডে দুটিতেই ব্যাট হাতে ছিল ফিফটি। কিন্তু ক্যারিয়ারের ফুলটা পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফুটিত হওয়ার আগেই চলে গেলেন!

বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রথম দ্বিতীয় পর্বে তোলা জয়। ফাইল ছবি
বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রথম দ্বিতীয় পর্বে তোলা জয়। ফাইল ছবি

বিশ্বকাপে ভারত-জয়

২০০৭ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপে পড়েছিল ভারত আর শ্রীলঙ্কা। সঙ্গে ছিল বারমুডা। প্রথম রাউন্ডে মাত্র তিনটি ম্যাচ। দুটিতেই হারলেই পরের রাউন্ডের আশা বাদ দিতে হবে। সমীকরণ ছিল এমনই। শক্তিশালী ভারত আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ হারবে—সবার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল এমনই। কিন্তু কী আশ্চর্য! পোর্ট অব স্পেনে প্রথম ম্যাচেই ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচে ভারত শ্রীলঙ্কার কাছেও হেরে বিদায় নিল বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার কাছে হারলেও বারমুডাকে হারিয়ে চলে যায় পরের রাউন্ডে। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সেই মুহূর্ত অনেক কারণেই চিরস্মরণীয় বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে।

সেই আক্ষেপের মুহূর্ত। ফাইল ছবি
সেই আক্ষেপের মুহূর্ত। ফাইল ছবি

এশিয়া কাপ: এত কাছে তবু কত দূরে
২০১২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো এশিয়া কাপ। ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ চলে গেল টুর্নামেন্টের ফাইনালে। চারদিকে সাজ সাজ রব। বিশাল প্রত্যাশা। ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ জিতবে, গোটা দেশ ভাসবে আনন্দে। কিন্তু বিধিবাম। ফাইনালে হাতের নাগালে পেয়েও ফসকে যায় এশিয়া কাপ। পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ২ রানে হেরে যায় দল। প্রত্যাশার ফানুস চুপসে গোটা দেশ ডুবে যায় বিষাদের অন্ধকারে।

ইংল্যান্ডকে ছিটকে দেওয়া সে জয়। ফাইল ছবি
ইংল্যান্ডকে ছিটকে দেওয়া সে জয়। ফাইল ছবি


বিশ্বকাপের শেষ আট
২০১৫ বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক দারুণ অধ্যায়। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার গৌরব দেশের ক্রিকেটকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। ২০১৫ সালের ৯ মার্চ ইংল্যান্ডকে ৯ রানে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখার সেই মুহূর্ত চির আনন্দের এক স্মৃতি।

এই মুহূর্ত মুশফিক কখনো ভুলবেন না। ফাইল ছবি
এই মুহূর্ত মুশফিক কখনো ভুলবেন না। ফাইল ছবি

বেঙ্গালুরু ট্র্যাজেডি

২০১৬ সালে ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বেদনার এক স্মৃতি হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। বেঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি তো রীতিমতো জাতীয় ট্র্যাজেডি। জয়ের খুব কাছে গিয়েও শেষ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ ১ রানে হেরে যায় ম্যাচটি। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের সে ম্যাচে শেষ ওভারে একপর্যায়ে ৩ বলে মাত্র ২ রান প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হয়তো অনেক ম্যাচ জিতবে, অনেক গৌরবের সাক্ষী হবে ক্রিকেট, কিন্তু বেঙ্গালুরুর সেই রাতটি কোনো দিন ভুলতে পারবে না বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।

এশিয়াতে প্রতিপক্ষের মাঠে বাংলাদেশের প্রথম জয়। ফাইল ছবি
এশিয়াতে প্রতিপক্ষের মাঠে বাংলাদেশের প্রথম জয়। ফাইল ছবি


শততম টেস্টে জয়ের গৌরব
২০১৭ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কা সফর করেছিল বাংলাদেশ। দুই টেস্ট আর তিন ওয়ানডে আর দুই টি-টোয়েন্টির সেই সফর দেশের ক্রিকেটের স্মরণীয় এক অধ্যায়। দিনটি ফরম্যাটেই সিরিজ ছিল অমীমাংসিত। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি ছিল বাংলাদেশের শততম টেস্ট ম্যাচ। কলম্বোর পি সারাভানামুত্তু ওভালে সেই টেস্টটিতে উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর জয় পায় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা প্রথমে ব্যাটিং করে ৩৩৮ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর জবাবে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে করে ৪৬৭। দ্বিতীয় ইনিংসে লঙ্কানরা ৬ উইকেটে ১৯১ করে ইনিংস ঘোষণা দিলে জয়ের জন্য বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ১৯১ রান। পি সারা ওভালের উইকেটে পঞ্চম দিনে ১৯১ রান করা সহজ কিছু ছিল না মোটেও। তামিমের ৮২ আর সাব্বির রহমানের ৪১ রানে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন সাকিব আল হাসান। গোটা টেস্টেই বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন সাকিব ও মোস্তাফিজুর রহমান।