ওয়াসিমকে 'দ্বিতীয় জীবন' দেওয়া সেই নারী

ওয়াসিম আকরামকে দ্বিতীয় জীবনের স্বাদ দিয়েছেন শানেইরা। ছবি: এএফপি
ওয়াসিম আকরামকে দ্বিতীয় জীবনের স্বাদ দিয়েছেন শানেইরা। ছবি: এএফপি

গানটি ‘শঙ্খবেলা’ সিনেমার। মুক্তির পর এই ৫৪ বছরে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ গান ভীষণ কাজে লেগেছে প্রেমের স্মৃতিচারণে—‌‘কে প্রথম কাছে এসেছি/ কে প্রথম চেয়ে দেখেছি...।

‌‘কে প্রথম ভালোবেসেছি/ তুমি না আমি।’

শানেইরাকে এমন স্মৃতিচারণই করলেন ওয়াসিম আকরাম। আবার ওয়াসিমকে নিয়েও বললেন শানেইরা। প্রথম দেখা, ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা এরপর বিয়ে। অতঃপর?
‌‘দ্বিতীয় জীবন’

প্রথম জীবনে ওয়াসিম হুমা মুফতিকে ভালোবেসেছিলেন। নব্বই দশকের শুরুতে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের মনোবিদ ছিলেন হুমা। মনের চিকিৎসা করতে ও করাতে গিয়ে দুজনের ঘর বাঁধার পথ খুলে যায়।
১৯৯৫ সালে বিয়ের পর দুজন এক সঙ্গে থাকতে পেরেছেন ১৪ বছর। ২০০৯ সালে মারা যান হুমা। এর দুই বছর পর আবারও প্রেমের সুইংয়ে উইকেট দিয়ে বসেন ‌‘সুলতান অব সুইং’। এবারে ‌‘বোলার’ শানেইরা টম্পসন। অস্ট্রেলিয়ান এ তরুণী তখন মেলবোর্নে জনসংযোগ পেশায় কাজ করতেন। ২০১৩ সালে দুজনে সিদ্ধান্ত নেন একে-অপরকে বিয়ে করবেন। তারপর থেকে পাকিস্তানি পেস কিংবদন্তির সঙ্গে করাচিতে ঘর করছেন ৩৭ বছর বয়সী শানেইরা আকরাম। অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যমকে দুজনে বলেছেন নিজেদের প্রথম দেখা, প্রেম এবং সংসারের গল্প:

ওয়াসিম আকরাম
শানেইরার সঙ্গে প্রথম দেখা ২০১১ সালে। মেলবোর্নে এক ডিনারে আরেক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল। সেখানে ক্রিকেট ধারাভাষ্য দিতে গিয়েছিলাম। সে জানত না আমি কে।দেশে যে আমি তারকা সে কথাও বলিনি। কিন্তু কৌশলটা কাজে লাগেনি। তাকে মুগ্ধ করতেই হতো। ফোন নম্বর নেওয়ার পর খুদেবার্তা, মেইল চালাচালি হয়। এখানে (অস্ট্রেলিয়া) ফিরলেই আমরা দেখা করেছি।

সে আমাকে এ জায়গা চিনিয়েছে। পাকিস্তানের হয়ে খেলার সময় অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর এসেছি। কিন্তু থাকতে হতো দলের সঙ্গে। সেন্ট কিলডা, চ্যাপেল স্ট্রিট কিংবা ব্রাইটনের মতো জায়গায় আর যাওয়া হয়নি। শানেইরার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিল না।

হুমা ২০০৯ সালে চলে যাওয়ার পর ভীষণ ভেঙে পড়ি। তাইমুরের বয়স তখন ১১ বছর, আকবরের ৮। আর ভুলে গেলে চলবে না আমি একজন পাকিস্তানি বাবা। অস্ট্রেলিয়ায় আপনি কাজে ব্যস্ত থাকুন আর না থাকুন ঘরের কাজ করতেই হবে। কিন্তু আমাদের ওদিকে ঘরের সব কাজ মায়েদের। তাই খুব সমস্যায় পড়ে যাই।

২০১৩ সালে আমরা বিয়ে করি। শানেইরা জানত, ওদের মায়ের শূন্যস্থান সে পূরণ করতে পারবে না। সে ওদের বন্ধু ও পরামর্শক হয়ে যায়। পাকিস্তানের জীবনব্যবস্থার সঙ্গে শুরুতে মানিয়ে নেওয়া একটু কঠিন। ওর সমস্যা হয়নি। সহজেই মানিয়ে নেয়। চুল ঢেকে রাখা, উর্দু শেখা ইত্যাদি। আমি অবশ্য পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলি। সে ওটা শিখবে না, কঠিন!

পাকিস্তানে সে এখন বড় তারকা। আমার জন্য নয়। হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সে যেসব দাতব্য কাজ করছে, সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে যেভাবে ভাবছে, সেসবের জন্য। আমার সে কারণে গর্ব হয়।

শানেইরা মা হিসেবেও দারুণ।৫ বছরের আয়লা আমাদের মেয়ে। শানেইরা তাকে স্কুলে আনা নেওয়া করে। নাচ ও জুডোর ক্লাসে নিয়ে যায়। আমার মতো আয়লাকে মাঝে-মধ্যে মনে করিয়ে দিতে হয়, আমিও কিন্তু আছি!

শানেইরার সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর আবেগ ও স্থির সংকল্প। কিছু একটা গড়বড় মনে করলে সে বলবে এবং কিছু করার চেষ্টা করবে। আমাদের ওখানে সবাই কিছু না বলে এড়িয়ে চলে।

করাচিতে আমরা যেখানে থাকি সেখানে ক্লিফটন নামে সৈকতের মতো একটা জায়গা আছে। কিন্তু পানি নোংরা, সৈকত প্লাস্টিকের ব্যাগ, সিরিঞ্জ আর রক্ত রাখার শিশিতে ভর্তি। গত বছর আমি যখন বিশ্বকাপের জন্য ইংল্যান্ডে, শানেইরা ওখানকার ছবি তুলে পোস্ট করে টুইটারে। সবাই যেন এটা নিয়ে কিছু করে সেজন্য। এক মাসের মধ্যে সৈকত পরিষ্কার। আমরা এখন ওখানে দৌড়াতে যাই।

আমি ভাগ্যবান। জীবনে দুবার এই সৌভাগ্যের দেখা পেয়েছি। ওই মর্মান্তিক বিয়োগান্ত—হুমা আমার শৈশবের ভালোবাসা-ঘটনার পর ভেবেছিলাম বাকি জীবন একাই কাটাতে হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা অসীম দয়ালু, এক সুন্দর রমণীর মাধ্যমে তিনি আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন।

শানেইরা টম্পসন
ওয়াসিমের সঙ্গে পরিচয় ডিনারে। খুব হাসাহাসি হয়েছে সেদিন। আমরা দুজন দুই প্রজন্মের,দেশও আলাদা। কিন্তু কোথায় যেন একটা মিল ছিল। তবে শুরুটা মোটেও রোমান্টিক ছিল না।

তখন ওর বাজে সময়। স্ত্রী মারা গেছে। হঠাৎ অসুস্থতায়, মর্মান্তিক ব্যাপার। কোনোভাবেই থিতু হতে পারছিল না। আমরা এ নিয়ে প্রচুর কথা বলি এবং তাকে (হুমা) নিজেদের পরিবারে বাঁচিয়ে রেখেছি। তার ছবি কোথায় নেই! তার স্মৃতিতে আমরা একটি গাছ লাগিয়েছি। তার জন্মদিন পালন করি, মৃত্যুদিনও পালন করা হয়।

লাহোরে ২০১৩ সালে খুব সাদামাটাভাবে নিকাহ( বিয়ে) হয় আমাদের। ছিমছাম সুন্দর অনুষ্ঠান। তাপমাত্রা ছিল ৪৮ ডিগ্রি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়বড় করায় মেক আপ গলে পড়ছিল। আমার ধারণা, ওয়াসিম বেশ ভয় পাচ্ছিল তখন।

আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করি। ওয়াসিম তখনো বছরে ১০ মাসই কাটায় দেশের বাইরে। ও কাজ করত, আমি ছেলেপুলের দেখাশোনা দেখতাম। ওদের বয়স তখন ১৫ ও ১২ বছর। বুঝলাম, বন্ধু নয় ওদের বাবা-মাকে দরকার। তাই সিদ্ধান্ত সৎ মায়ের চরিত্রে অভিনয় ছাড়তে হবে। নিতে হবে আসল ভূমিকা।
তখন আমার বয়স ২৯ বছর। চার বোনকে বড় করেছি। ছেলেদের কীভাবে দেখাশোনা করতে হয় সে নিয়ে পড়লাম প্রচুর। কোনো সংকোচ ছিল না। সোজা ওদের মাথায় ঢোকার চেষ্টা করেছি। বলেছি,‌ ‘তোমাদের ভালোবাসি। তোমাদের জন্যই আমি।’

আয়লা এসেছে ৫ বছর আগে। ছেলেরা ওকে খুব ভালোবাসে। আয়লা আমাদের এই প্যাকেজের (পরিবার) সোনালি ফিতা।
ওয়াসিম ভীষণ বিনয়ী। সে এটা দিয়েই চমকে দিতে পারে। কারণ ওই ব্যক্তিত্বটা আছে। তাকে ৬ ফুটি বিলবোর্ড কিংবা টিভিতে সব সময় দেখে বোঝা যাবে না। ওটা আসল ওয়াসিম নয়। সে কোনো সম্পদ ছাড়াই বড় হয়েছে, রাস্তায় ক্রিকেট খেলে।

ওয়াসিমের সঙ্গে পরিচয়ের আগ পর্যন্ত ক্রিকেট নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে পাগল। ওই জোয়ার এড়ানো যায় না। ওয়াসিম যখন বলল, দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে সে দাতব্য ম্যাচ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় যাব, খুব গর্ব হচ্ছিল। পাকিস্তানকে নানাভাবে আমি সাহায্য করেছি, চেষ্টা করি। ভালো লাগছিল যে আমার দেশের জন্যও এর দরদ আছে।

সে আসলে বেলুনের মতো। সব সময় নাগালের বাইরে থাকবে। কিন্তু দড়িটা থাকবে পরিবারের কাছে, নিজের শেকড়ে, যেন সব সময় ফিরতে পারে। আমি জানি কেমন মানুষকে বিয়ে করেছি। তার সৌরভের ভাগটা বিশ্বকেও দিতে হচ্ছে। তবে সে কিন্তু সব সময় নিজের ভরসার মানুষ, নিজের নোঙরেই ফিরে আসে।