প্রথম শ্রেণিতে 'দ্বিতীয়'কে কেউ মনে রাখেনি

তাঁকে বলা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ছবি: সংগৃহীত
তাঁকে বলা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরির ‘সেঞ্চুরি’ কার?

খোলাসা করা যাক। ১০০ সেঞ্চুরি আর কি। শচীন টেন্ডুলকারের এ কীর্তি আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ২০১২ সালে মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে তিনি ছুঁয়েছিলেন এ অনন্য রেকর্ড। তখন মনে হয়েছে এ তো অভূতপূর্ব!

হ্যাঁ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওটা প্রথমই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম ১০০ সেঞ্চুরি দেখা গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। ইংরেজ ক্রিকেট রোমান্টিকদের ভাষায় সে সময়টা ক্রিকেটের ‘সোনালি যুগ’( ১৮৯০ থেকে ১৯১৪)। এর মাঝে ১৮৯৫ সালে সমারসেটের বিপক্ষে ২৮৮ রানের ইনিংস খেললেন ওই বুড়োমতো দাড়িওয়ালা লোকটা।

কে আবার ডব্লিউ জি গ্রেস! প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম শততম সেঞ্চুরি হিসেবে ওটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৮৮৮ সালের দিকে গ্রেসের ক্যারিয়ারে দুটি ম্যাচ প্রথম শ্রেণির ছিল না। অর্থাৎ, গ্রেসের শততম সেঞ্চুরিটি এসেছে ওই ইনিংস খেলার দুই সপ্তাহ পর মিডলসেক্সের বিপক্ষে।

দেখেছেন, ধান ভানতে কেমন শিবের গীত চলছে!

এ লেখা ক্রিকেটের বিখ্যাত দাড়িওয়ালা ‘বুড়ো’কে নিয়ে নয়। কিন্তু অবচেতনভাবেই উঠে আসছে তাঁর কথা। ওই যে, প্রথম অর্জনের জন্য। কে দ্বিতীয়, মানুষ মনে রাখে না। এভারেস্টে প্রথম কে উঠেছে, তা প্রায় সবাই জানে। যদি বলা হয় কে দ্বিতীয়, মাথা চুলকোতে হবে অনেককেই। এ জগতের নিয়মই যে এই।

টম হেওয়ার্ড পড়েছেন জগতের এ নিয়মের গ্যাঁড়াকলে। ১৯৩৯ সালে ৬৮ বছর বয়সে জীবনের উইকেট দেওয়ার পর উইজডেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল, সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিন্তু বেশির ভাগের কাছেই তাঁর নামটি বিস্মৃত। অন্তত, গ্রেস, ট্রাম্পার, ব্র্যাডম্যান থেকে হালের কোহলিদের নিয়ে গল্পের টেবিলের তাঁর নাম উঠলে প্রশ্ন উঠবে, ইনি কে?

১৮৭১ সালে কেমব্রিজে ক্রিকেট খেলুড়ে পরিবারে জন্মেছিলেন হেওয়ার্ড। দাদা ড্যানিয়েল হেওয়ার্ড কেমব্রিজ ও সারের হয়ে খেলেছেন। চাচা টমাস হেওয়ার্ড তো তাঁর সময়ে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা পেশাদার ব্যাটসম্যান। অনেকের মতে ইংল্যান্ডের প্রথম পেশাদার ব্যাটসম্যানও। এ পরিবার থেকে টমকে তাই ক্রিকেটার হতেই হতো।

সারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ‘মিটচ্যাম’দের একজন হয়ে। এটি সারের আঞ্চলিক তকমা। এক পরিবারের কয়েক প্রজন্ম সারের হয়ে খেলায় এ তকমা। দাদার পর তাঁর বাবা ড্যানিয়েল হেওয়ার্ডও সারের হয়ে খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট।

কিন্তু ব্যাটিংয়ের ধাঁচ ছিল চাচার মতো। অমিত ধৈর্য , বল ছাড়া এবং খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিচক্ষণতা, সোজা ব্যাট এবং সৌন্দর্য। রান করতেন উইকেটের চারপাশেই। সিগনেচার শট ছিল কাট ও অফ ড্রাইভ। বলা হতো, অফ ড্রাইভে তাঁকে কেউ ছাপিয়ে যেতে পেরেছে কি না সন্দেহ! ১৮৯৩ সালে সারের হয়ে অভিষেকের পাঁচ বছর (১৮৯৮)পর খেললেন জীবনের সেরা ইনিংস, ওভালে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে ৩১৫।

১৫ বছর পর হেওয়ার্ড গ্রেসের মতো মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলেন এই ওভালেই, সেই ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে। ১৩৯ রানের ইনিংস দিয়ে তুলে নেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের শততম সেঞ্চুরি। ওই ইনিংসে তাঁর সঙ্গে অন্য প্রান্তে ছিলেন ‘দ্য মাস্টার’ জ্যাক হবস এবং অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম। পরে শততম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন দুজনেই।

ইংল্যান্ডের হয়ে ৩৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে হেওয়ার্ডের তিন সেঞ্চুরির মধ্যে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩০ রানের ইনিংসটি স্মরণীয়। সেটি খেলেন দলের ভীষণ প্রয়োজনের মুহূর্তে। হেওয়ার্ড ব্যাটিং কতটুকু ধারণ করতেন তার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে টানা ২০ বছর (১৮৯৫-১৯১৪) প্রতি মৌসুমে ন্যূনতম ১০০০ রান করেছেন। এর মধ্যে ১৯০৪ সালে তুলেছেন ৩১৭০, আর ১৯০৬ সালে ৩৫১৮—প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যা তখনকার রেকর্ড। ১৮৯৯ সালে ওভালে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে অ্যাবেকে নিয়ে গড়েছিলেন চতুর্থ উইকেটে তখনকার বিশ্বরেকর্ড জুটি, ৪৪৮।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে কেমব্রিজেরই সেই ‘মাস্টার’ হবসকে নিয়ে অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটি ছিলেন তাঁরা। ওপেনিং জুটিতে তাঁরা ন্যূনতম এক শ রান তুলেছেন এমন নজির আছে ৪০বার। এর মধ্যে ১৯০৭ সালে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা ওপেনিং জুটিতে ন্যূনতম এক শ তুলেছেন চার বার। ১৯০৬ সালে ওই এক মৌসুমেই ১৩ সেঞ্চুরি করে সিবি ফ্রাইয়ের (১৯০১) রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছিলেন হেওয়ার্ড। আটবার ব্যাট ‘ক্যারি’ করার বোঝা যায় ব্যাটিংয়ের খিদে ছিল কতটা!

১৯১৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৩ বছর বয়সে নিজের শেষ ম্যাচটা খেলেছেন হেওয়ার্ড। ৭১২ ম্যাচে ৪১.৭৯ গড়ে রান করেছেন ৪৩৫৫১। সেঞ্চুরি ১০৪টি। প্রথম শ্রেণিতে শততম সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া ২৫ ব্যাটসম্যানের একজন তিনি।

ক্রিকেটের সেই সোনালি যুগে এখনকার মতো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। খেলার চেতনাকে তুলে ধরার একটা চেষ্টা ছিল সবার মধ্যে। তাই বলে সেঞ্চুরি করা এত সহজ ছিল না। ভেবে দেখুন, এখনকার মতো হেলমেট, চেস্ট গার্ড, নী গার্ড, থাই প্যাড ছিল না। গ্লাভস এবং পায়ের প্যাড যা ছিল, সেগুলো হয়তো এখনকার প্রজন্মের অনেকের কাছেই হাসির খোরাক। উইকেট বলে আলাদা কিছু সেভাবে ছিল না। প্রায় ঘাসই বলা যায়! বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। সাক্ষাৎ নরক! আর বোলাররা হয়তো আধুনিক কালের মতো এত কুশলী ছিলেন না। তবে গতিটা তো আদিম। সুইং ও স্পিন তখনো ছিল। আর তা মোকাবিলা করতে ছিলেন হেওয়ার্ডের মতো জাত ব্যাটসম্যানরা।

টমাস ওয়াল্টার হেওয়ার্ড ১৮৭১ সালে জন্মেছিলেন আজকের এই দিনে।