এভাবেও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন সম্ভব হয়েছিল

নেহরু কাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেওয়া পাকিস্তান বিশ্বকাপ জেতার সাহস পেয়েছিল এ টুর্নামেন্ট থেকেই। সংগৃহীত ছবি
নেহরু কাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেওয়া পাকিস্তান বিশ্বকাপ জেতার সাহস পেয়েছিল এ টুর্নামেন্ট থেকেই। সংগৃহীত ছবি
১৯৮৯ সালে দুই দিন আগে পরে শুরু হয়েছিল শারজা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও ভারতের নেহরু কাপ। ভারত, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ অংশ নিয়েছিল দুই টুর্নামেন্টেই


ক্রিকেটে অদ্ভুত কত কিছুই তো ঘটে। যার কিছু নিতান্তই পাকেচক্রে ঘটে। আর কিছু আছে যার পেছনে বড় দায় থাকে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট বড় কর্তাদের। ১৯৮৯ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত নেহরু কাপও আয়োজনটাই যেমন।

তবে টুর্নামেন্টটিকে মানুষ মনে রেখেছে ইমরানের খানের পাকিস্তানের কারণেই। ফাইনালে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২৭৩ রান ৫ উইকেট ও ১ বল হাতে রেখেই পেরিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। শেষ ওভারে ওয়াসিম আকরামের মারা ছক্কাটিও বিখ্যাত হয়ে আছে। পাকিস্তানের জয়ের ভিত্তিটা অবশ্য গড়ে দিয়েছিল সেলিম মালিকের ৬২ বলে খেলা অপরাজিত ৭১ রানের ইনিংসটি।

টুর্নামেন্টটিকে অদ্ভুত বলার কারণ এর সূচি। সে সময়ে টেস্ট খেলত সাতটি দেশ। এই সাত দেশের ছয়টিই খেলেছে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে থাকেন জন্মশতবার্ষিকীটা উপলক্ষ্য মাত্র, আসল কারণ নেহরুর নাতি রাজীব গান্ধীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। সামনেই ছিল লোকসভা নির্বাচন। ১৯৮৪ সালে মা ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর বিপুল জনরায়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রাজীব। পাঁচ বছর পর সেই রাজীবের জনপ্রিয়তা লেখ চিত্র নেমে গিয়েছিল তলানিতে। বিশ্বের প্রায় সব ক্রিকেট শক্তিকে এক করেও অবশ্য লাভ হয়নি। নির্বাচনে হেরে যায় রাজীবের কংগ্রেস।

টুর্নামেন্টে আমন্ত্রণ পায়নি শুধু টেস্ট খেলুড়ে একটি দেশ—নিউজিল্যান্ড। কেন পায়নি সেটিও রহস্য হয়ে আছে। আয়োজকেরা সম্ভবত নিউজিল্যান্ডকে ক্রিকেট শক্তি হিসেবে গোনায় ধরেননি। স্বাগতিক ভারত, চিরবৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান, ক্রিকেট আদি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড, দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও সে সময়ের নবীন টেস্ট দল শ্রীলঙ্কা অংশ নেয় ছয় জাতির টুর্নামেন্টে।

সে সময়ে বিশ্বকাপের বাইরে এত বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা সহজ কাজ ছিল না। কঠিন সেই কাজ করতে গিয়েই সূচি জট পাকিয়ে ফেলেছিল ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই)।

আজকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচি নিয়ে অনেক ক্রিকেটারই অভিযোগ করেন। ব্যস্ততা ওই সময়েও কম ছিল না। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের সেই সময়টায় ১৯ দিনের মধ্যে নেহরু কাপসহ পাকিস্তান খেলেছিল ১১টি ওয়ানডে, ওয়েস্ট ইন্ডিজও ২০ দিনে খেলেছিল ১১টি ওয়ানডে। হিসাবটা নেহরু কাপ ও শারজা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি মিলিয়েই করা।

নেহরু কাপের আগে শারজা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি লেখা গেল না। কারণ শারজার টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার আগেই যে শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৫ অক্টোবর দিল্লিতে নেহরু কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ড যখন মুখোমুখি হয়, সে সময়ে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো বটেই স্বাগতিক ভারতও ছিল শারজায়! চ্যাম্পিয়নস ট্রফির তৃতীয় দলটি ছিল ভারত। মজার ব্যাপার নেহরু কাপ শুরুর মাত্র দুদিন আগে শুরু হয়েছিল ডাবল লিগ পদ্ধতির চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ওই টুর্নামেন্ট খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতে আসে ১৮ অক্টোবর। ভারত-পাকিস্তান তো শারজায় ছিল ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। নেহরু কাপের স্বাগতিকেরা দেশে ফেরার আগেই টুর্নামেন্টের তিনটি ম্যাচ হয়ে যায়।

টুর্নামেন্টে সূচি ও বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে বেশ বিরক্ত হয়েই উইজডেন অ্যালমানাকের সাবেক সম্পাদক ম্যাথু অ্যাঙ্গেল কড়া সমালোচনা করেছিলেন বিসিসিআইয়ের। টুর্নামেন্ট সফল হবে না বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অ্যাঙ্গেল, ‘যারা সেখানে গিয়েছে তাঁদের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। আমি খুব অবাক হব যদি আজ থেকে এক বছর পর কেউ এই টুর্নামেন্টের কোনো কিছু মনে করতে পারে।’

অ্যাঙ্গেলের ভবিষ্যদ্বাণী ফলেনি। জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়েছিল টুর্নামেন্টে। আর তাই মানুষ এখনো মনে রেখেছে নেহরু কাপকে। টুর্নামেন্টে কারও কারও পারফরম্যান্স তো আজকালকার ধুন্ধুমার ক্রিকেটের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ফাইনালে সেলিম মালিকের পারফরম্যান্স তো আছেই, গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৪৪ বলেই অপরাজিত ৮৪ রানের একটি ইনিংস খেলেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভারতীয় পেসার চেতন শর্মা সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলেন।

‘মিনি’ সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ওঠা চার দল ভারত, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবাই গ্রুপ পর্বে তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল। একেবারে খালি হাতে ফেরেনি কোনো দলই। অন্তত একটি করে জয় নিয়ে ফিরেছে সবচেয়ে ব্যর্থ শ্রীলঙ্কাও।