অভিষেকের সৈনিকেরা এখন কে কোথায়

স্বপ্ন দেখার শুরু করেছিলেন যাঁরা। ফাইল ছবি
স্বপ্ন দেখার শুরু করেছিলেন যাঁরা। ফাইল ছবি
>৩৪ বছর আগে ৩১ মার্চ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের। মোরাতুয়াতে ইমরান খান, আবদুল কাদির, মহসিন খানদের পাকিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচে খেলা বাংলাদেশের ১১ ক্রিকেটার এখন কোথায় আছেন, কী করছেন…

সেটি ছিল বড় এক স্বপ্নের শুরু। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের দিনটি সে কারণেই আলাদা আবেগ ছড়িয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়ায় এশিয়া কাপের সে ম্যাচটিতে ইমরান খান, আবদুল কাদির, মহসিন খানদের শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়-পরাজয় মুখ্য কিছু ছিল না। আসল ছিল পথচলার শুরুটাই। আজ ৩৪ বছরে বাংলাদেশ খেলেছে ৩৭৬টি ওয়ানডে, ১৩৩ জন ক্রিকেটার অংশ হয়েছেন এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের। কিন্তু অভিষেকের সেই ১১ ক্রিকেটার চিরদিনই আলাদা একটা জায়গায় থেকে যাবেন। দেশের ক্রিকেটের প্রতিটি বাঁকবদল, প্রতিটি সাফল্যেই অলক্ষ্যে চলে আসবেন তাঁরাও। তাঁরাই যে সেদিন শুরু করেছিলেন নিরন্তর এক পথচলার।
ক্যালেন্ডারে পাতায় ঘুরেফিরে আজ আবার সেই ৩১ মার্চ। অভিষেক ম্যাচের সেই ১১ ক্রিকেটার এখন কে কী করছেন, কেমন আছেন, একবার দেখে নিলে কেমন হয়…

রকিবুল হাসান
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের দিনটিতে অবশ্য তিনি অধিনায়ক ছিলেন না। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ক্রিকেটে বাংলাদেশ রকিবুলের নেতৃত্বেই শিরোপা জিতেছিল। হংকং, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে হারিয়ে জেতা সে ট্রফিটিই বাংলাদেশকে জায়গা করে দিয়েছিল ১৯৮৬ এশিয়া কাপে। ওয়ানডে মর্যাদা না থাকলেও সুযোগ করে দিয়েছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার। রকিবুল পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকের ম্যাচে ওপেন করেছিলেন। ১৪ বলে ৫ রান করে শেষ হয়েছিল তাঁর ইনিংস। জাকির খানের বলে উইকেটরক্ষক জুলকারনাইনের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। রকিবুল ৩৪ বছর পরেও ক্রিকেটের সঙ্গেই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। জাতীয় দলের ম্যানেজার, কোচ ও নির্বাচক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্যানেলভুক্ত ম্যাচ রেফারি হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। টেলিভিশনে টুকটাক ক্রিকেট বিশ্লেষণ, পত্র-পত্রিকায় কলাম লেখা—এসব তো চলছেই।

নুরুল আবেদীন
রকিবুল হাসানের ওপেনিং সঙ্গী নুরুল আবেদীন অভিষেকের ম্যাচটিতে মোটেও ভালো করতে পারেননি। অথচ, এশিয়া কাপের আগে তিনি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়েই আলাদা নজর কেড়েছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেদিন ৩ বল খেলে কোনো রান করতে পারেননি তিনি। তাঁকে ফিরিয়েছিলেন ইমরান খান, উইকেটের পেছনে ক্যাচ নিয়েছিলেন জুলকারনাইন। মিনহাজুল আবেদীনের বড় ভাই নুরুল আবেদীন ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন দারুণ পারফরমার। তবে জাতীয় দলের হয়ে খুব সফল নন তিনি। ক্রিকেট থেকে বিদায়ের পর তাঁর বসতি চট্টগ্রামে। নুরুল এখন চট্টগ্রামে বিসিবির বিভাগীয় কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গাজী আশরাফ হোসেন
১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ অভিষেক ম্যাচে দেশের হয়ে টস করতে নেমেছিলেন তিনিই। দেশের ক্রিকেটের অন্যতম মেধাবী এই অধিনায়ক এরপরেও আরও ৬টি ওয়ানডেতে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচে গাজী আশরাফ ওয়াসিম আকরামের বলে শূন্য হাতে ফিরেছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন তিনি ১৯৯৫ পর্যন্ত। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নানা ভূমিকায় । ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ী বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। বিসিবির পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। এখন ঢাকায় ব্যবসা করছেন। টেলিভিশনে ক্রিকেট বিশ্লেষণ করেন। পত্র-পত্রিকায় ক্রিকেট বিষয়ক কলামও লেখেন নিয়মিতই।

শহীদুর রহমান
অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ সংগ্রহ তাঁরই। শুরুর বিপর্যয়ের পর তাঁর ৩৭ রানের ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ স্কোরবোর্ডে ৯৪ রান তুলতে পেরেছিল। ইনিংসটা বড় করতে পারেননি আবদুল কাদিরের বলে কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে। শহীদুর এখন নিভৃত জীবন যাপন করেন। থাকেন চট্টগ্রামে। সেখানেই একাধিক ব্যবসায় আছে তাঁর।

মিনহাজুল আবেদীন
দেশের অভিষেকের দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল দুই সহোদরের। নুরুল আবেদীনের সঙ্গে ছোট ভাই মিনহাজুল আবেদীনের। পরবর্তীকালে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান অভিষেক ম্যাচে ভালো করতে পারেননি। ৬ রান করে ওয়াসিম আকরামের বলে মনজুর ইলাহীর হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। দেশের প্রথম বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন ব্যাট হাতে সেরা পারফরমার। মিনহাজুল আবেদীন এখন দেশের ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রফিকুল আলম
আশির দশকে দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান অভিষেক ম্যাচে ১৪ রান করেছিলেন। ওয়াসিম আকরামের বলে রমিজ রাজার হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে রফিকুল আলম দেশের ক্রিকেটের নানাভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন জাতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১১ সালের বিশ্বকাপের সময় তিনি ছিলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী আবাস গড়ে ক্রিকেট থেকে নিজেকে দূরেই রেখেছেন রফিকুল।

গোলাম ফারুক
আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। বোলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটটাও খুব ভালো চালাতে পারতেন। জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। অভিষেক ম্যাচে রফিকুল আলমের সঙ্গে একটা জুটি গড়েছিলেন তিনি। রান করেছিলেন ১৪। আউট হন আবদুল কাদিরের বলে উইকেটরক্ষক জুলকারনাইনের হাতে ধরা পড়ে। ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েও ক্রিকেটের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি তিনি। বিসিবির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন ক্রিকেট কোচ হিসেবে। বর্তমানে তিনি বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের হাই পারফরম্যান্স কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা
দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেটশিকারীও তিনি। অভিষেক ম্যাচে ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও বল হাতে তিনি ছিলেন দারুণ সফল। তুলে নিয়েছিলেন মহসিন খান ও রমিজ রাজার উইকেট, তাও মাত্র ১০ রানের ব্যবধানে। খেলা ছেড়েছেন অনেক দিন। বিসিবির সঙ্গে সেভাবে জড়িত ছিলেন না কখনোই। টেলিভিশনে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন।এখন ঢাকায় নিভৃত জীবন-যাপন করছেন।

হাফিজুর রহমান
অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশ দলের উইকেটরক্ষক ছিলেন তিনি। সে ম্যাচে তাঁর ক্যাচেই জাভেদ মিয়াঁদাদকে ফিরিয়েছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন। ব্যাট হাতে ইমরান খানে বলে বোল্ড হওয়ার আগে করেছিলেন ৮ রান। দেশের হয়ে দুটি ওয়ানডে খেলা হাফিজুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে প্রবাস জীবন যাপন করছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

গোলাম নওশের
বাংলাদেশ দলের মূল বোলার সেদিন ছিলেন তিনিই। নতুন বল হাতে নিয়েছিলেন তিনিই। ৭ ওভার বোলিং করে ১ মেডেনে ৩২ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য। বাঁ হাতি পেসার গোলাম নওশের এরপর ১৯৯২ পর্যন্ত খেলেছেন জাতীয় দলে। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট বিসিবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অনেক দিন জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন।

সামিউর রহমান
নতুন বলে গোলাম নওশেরের সঙ্গী সামিউর রহমান অভিষেক ম্যাচে উইকেট না পেলেও দারুণ বোলিং করেছিলেন। মহসিন খান, রমিজ রাজা, জাভেদ মিয়াঁদাদদের বিপক্ষে বোলিং করে নিজের প্রথম ম্যাচে ৭ ওভারে মাত্র ১৫ রান দেওয়া মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, কোনো উইকেট পাননি তিনি। খেলা ছেড়েছেন দীর্ঘদিন। ক্রিকেট কখনোই ছাড়তে পারেননি। এখনো ক্রিকেটের সঙ্গে ভালোভাবেই জড়িয়ে তিনি। বিসিবির প্যানেলভুক্ত ম্যাচ রেফারি হিসেবে যথেষ্ট ব্যস্ত সময় কাটান সামিউর।